রেজানুর রহমান ||
কথায় আছে ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের হাজার ফোঁড়ের সমান’। অর্থাৎ সময় থাকতেই ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। ধরা যাক, বন্যার পানি বাড়তে শুরু করেছে। বাঁধ না দিলেই কিন্তু গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তখন যদি আমরা ভাবি, দেখি না কী হয়? তাহলে ভুল হবে। দেখি না কী হয় ভেবে বসে থাকলাম। বন্যার পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো। তখন কি শত চেষ্টা করেও আদৌ বাঁধ রক্ষা করা যাবে? বোধকরি না।
এত কথা বলার একটি উদ্দেশ্য আছে। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে রিপোর্ট বেরিয়েছে, শুধু ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে গত ৬ মাসে প্রায় ৩ শতাধিক কিশোর-কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই ‘বন্ধু’র কাছে যাচ্ছি অথবা একটু কাজ আছে এই কথা বলে নিজ পরিবার থেকে বেরিয়ে গেছে। থানা-পুলিশের সহায়তায় কাউকে কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাকিরা এখনও নিখোঁজ। পুলিশ সূত্র বলছে, শুধু ঢাকার মিরপুর নয়, গোটা দেশের চিত্র আরও ভয়াবহ।
মোবাইল ফোন নাকি এই সর্বনাশের কারণ। মোবাইল ফোন এখন দেশের মানুষের কাছে অনেকটা খেলনার মতো। যার দরকার নাই সেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতেও দেখা যায় দামি মোবাইল ফোন। আদরের সন্তান আবদার তুলেছে তার একটা দামি মোবাইল ফোন দরকার। ‘একটা মোবাইল ফোনই তো...’– অনেক বাবা-মা গভীর আগ্রহে সন্তানকে দামি মোবাইল কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু এর ফলে সন্তানের যে ক্ষতিটা হচ্ছে তা বোধকরি অনেকেই খেয়াল করছেন না। অথবা খেয়াল করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এই সুযোগে কোমলমতি শিশু-কিশোররাও মোবাইল ফোনের প্রতি অত্যধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। পড়ার টেবিলে মোবাইল ফোন, খাবার টেবিলে মোবাইল ফোন। এক হাতে খায় অন্য হাতে মোবাইল টিপে, ক্লাসেও তার হাতে মোবাইল ফোন। শিক্ষক লেকচার দিচ্ছে, ছাত্রছাত্রী লুকিয়ে লুকিয়ে মোবাইল ফোনে রঙিন দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে। পুলিশ সূত্র বলছে, যারা নিখোঁজ হয়েছে তাদের প্রায় সবাই মোবাইল ফোনে বন্ধুত্ব গড়েছে। বন্ধু বলেছে, চল বেরিয়ে যাই। ব্যস। বন্ধুর কথায় ঘর ছেড়েছে অনেক কিশোরীও। এই সুযোগ নিয়েছে নারী পাচারকারী চক্রও। যারা এখনও নিখোঁজ, ধারণা করা হচ্ছে তাদের অনেকেই নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছে।
একটি ঘটনা বলি। আমার এক আত্মীয়ের পরিবারে সদস্য সংখ্যা পাঁচ। স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে এবং একটি কাজের মেয়ে। পাঁচ জনের মোবাইল সেট রয়েছে ৭টি। স্বামী-স্ত্রী দুটি করে মোবাইল সেট ব্যবহার করেন। আর বাকিদের আছে একটি করে মোবাইল সেট। পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য ৯ বছরের একটি ছেলে। স্কুলে পড়ে। তাকেও দেওয়া হয়েছে একটি দামি মোবাইল ফোন। কাজের মেয়েটিও ব্যবহার করে দামি মোবাইল ফোন। এমনও হয়, একঘর থেকে অন্য ঘরে মোবাইল ফোনেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে নেয়। একদিন রাতে ওই বাসায় গিয়েছিলাম। খাবার টেবিলে বসা সবাই মোবাইল ফোন টিপছে। ছোট ছেলেটিও মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তার মা মৃদু ধমক দিল– ‘অ্যাই, এখন মোবাইল রাখো...’।
কে শোনে কার কথা? মায়ের ধমক খেয়ে সে খাবার টেবিল থেকে উঠে গেলো। ছেলেটির মা তখন আপন মনে বলতে থাকলেন- কী যে করি... ওর হাতে মোবাইল তুলে দেওয়াই ভুল হয়েছে...।
জিজ্ঞেস করলাম– কেন এই ভুলটা করলেন? মায়ের উত্তর- ওর বয়সী সবার হাতেই তো এখন মোবাইল ফোন আছে। তাই ওর আবদার উপেক্ষা করতে পারিনি।
ছেলে কি স্কুলেও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়?
হ্যাঁ।
স্কুল কি এটা এলাউ করে?
মা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আমতা আমতা করতে থাকলেন।
বোঝা গেলো স্কুলের নিষেধ আছে, তবু ছেলের ব্যাগে মোবাইল ফোন দিয়ে দেন মা। যুক্তি দেখালেন এভাবে– ওর কাছে মোবাইল থাকলে মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে পারি। বোঝেনই তো... চার পাশে কত কিছুই না ঘটছে...।
আরেকজন মায়ের কথা বলি। স্কুল পড়ুয়া একমাত্র ছেলেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ছেলের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছিলেন। একসময় দেখলেন ছেলে মোবাইল ফোন ছাড়া কিছুই বোঝে না। সারা রাত নিজের ঘরে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে। সকালে স্কুলে যেতে চায় না। বাবা ছেলের কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন। তারপর ওই ফোনে যা দেখলেন তা সত্যিকার অর্থে খুবই ভয়াবহ। অশ্লীল দৃশ্যে ভরা ছিল ফোনটি। ছেলের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেওয়া হলো। ফলে বাধলো বিপত্তি। মোবাইল ফোন না দিলে ছেলে নাকি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে...।
এ কথা সত্য, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর এই যুগে মোবাইল ফোন খুবই জরুরি অনুষঙ্গ। মোবাইল ফোন ছাড়া যেন জীবন চলেই না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। হাতে যদি থাকে একটি মোবাইল ফোন তাহলে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব। এটাই সময়ের দাবি। কিন্তু কোমলমতি শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়াও কি সময়ের দাবি? পৃথিবীর অনেক দেশে শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি বয়সের আগে কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না– এমন নির্দেশ আছে অনেক দেশে। আমরা কেন এ ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছি না? স্কুল ব্যাগে কেন মোবাইল ফোন থাকবে? কোন যুক্তিতে?
লেখার শুরুতে যে প্রসঙ্গটি তুলে ছিলাম সে প্রসঙ্গেই আবার ফিরে যেতে চাই। এই যে বন্ধুত্বের আহ্বানে যারা নিখোঁজ হয়েছে তারা মোবাইল ফোনেই বন্ধু খুঁজে নিয়েছে। এক্ষেত্রে দোষ কি মোবাইল ফোনের? বোধকরি উত্তরটা হবে- না! এখানে মোবাইল ফোনের দোষ কোথায়? দোষ যদি করে থাকে সেটা করেছে ফোন ব্যবহারকারী ব্যক্তি। দেশে যখন ভিসিআর প্রযুক্তি এসেছিল তখন একটা ‘ছি, ছি’ রব উঠেছিল। কারণ, ভিসিআরে নীল ছবি দেখা যায়। কিন্তু ভিসিআরে যে ভালো ছবিও দেখা যায় সে কথা জোর দিয়ে বলেননি কেউ। আসলে ব্যবহারের মানসিকতার ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটছে।
সবকিছুরই একটা বয়স আছে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়স আছে। চাকরি পাবার বয়স আছে। বিয়ে করার বয়স আছে। তেমনই দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বয়সের একটি স্তর নির্ধারণ করা উচিত। তা না হলে আরও ভয়াবহ বিপদ আসন্ন। আসুন এখনই সোচ্চার হই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো