করোনাভাইরাস এ
দেশের কন্যাশিশুদের যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে
বাল্যবিবাহ। পুতুল খেলার বয়স শেষ না হতেই তাদের জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে
বিয়ের পিঁড়িতে। সম্প্রতি রাজশাহী জেলা শিক্ষা দপ্তর করোনাকালে, অর্থাৎ গত
দুই বছরে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের যেসব ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে,
তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এতে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা শুধু
দুর্ভাবনারই নয়, চরম লজ্জাকরও। জেলায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া
সাড়ে ছয় হাজার শিশুর বিয়ে হয়েছে এই সময়ে। তালিকায় প্রাথমিক পর্যায়ের কোনো
তথ্য নেই। থাকলে সেখানেও এমন চিত্রই হয়তো পাওয়া যেত।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, এই চিত্র শুধু রাজশাহীর নয়, সারা দেশেরই। কোথাও কোথাও বাল্যবিবাহের
চিত্র এর চেয়েও ভয়াবহ। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে,
করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে ১৩ শতাংশের
মতো। প্রকাশিত অন্য এক খবরে জানা যায়, বাগেরহাটের শুধু একটি উপজেলায় ছয়
শতাধিক কন্যাশিশুর বিয়ে হয়েছে গত দুই বছরে। উপজেলাটির নাম শরণখোলা। এখানে
প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। প্রায় একই ধরনের খবর পাওয়া
যায় রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার
কালিকাপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার বানু
জানান, করোনা মহামারির আগে তাঁর বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত
ছাত্রী ছিল ৭০ জন। করোনার পর স্কুল খোলা হলে তিনি জানতে পারেন এদের মধ্যে
৩০ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই বছর আগে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল যে পাপিয়া
আক্তার, তার কোলে এখন এক পুত্রসন্তান। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীদের
বয়স কত? গড়পড়তা ১২ থেকে ১৪ বছর। এই বয়সে বিয়ে তো হত্যারই শামিল। এমন
শিশুদের বিয়ের কথা কোনো সভ্য সমাজ ভাবতে পারে কি? কিন্তু আমরা শুধু ভাবতে
পারা নয়, প্রতিনিয়ত তা দেখছি, শুনছি এবং নির্বিকার জীবনযাপন করছি!
শুধু
বিয়ে নয়, আরো অনেক কারণেই কন্যাশিশুরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে। তাদের
এভাবে ঝরে পড়া কি শুধু তাদের ব্যক্তিগত ক্ষতি? এটা কি রাষ্ট্রকেও
ক্ষতিগ্রস্ত করছে না? এদের মধ্যে এমন অনেক মেধাবী শিশু পাওয়া যাবে, সামান্য
যত্ন পেলে যারা অনেক ভালো কিছু করার ক্ষমতা রাখে। তাহলে সেই সব সম্ভাবনার
এমন অপমৃত্যুর জন্য দায়ী কে? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু আইন করে কিংবা
শাস্তি দিয়ে বাল্যবিবাহ রোধ করা যাবে না। বাল্যবিবাহের সঠিক কারণগুলো
অনুসন্ধান করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। দরিদ্র পরিবারের
কন্যাশিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থাসহ অন্যান্য উদ্যোগের
কথা ভাবতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে আরো গতিশীল হতে হবে। জোরদার সামাজিক
আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।