অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
জাতিসংঘের উদ্যোগে ১ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সনে এবং এখন হতে যাচ্ছে ২৬তম সম্মেলন। বিশ্ববাসীর সম্মুখে জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কুফল দৃশ্যমান। ১৯০১ সনের তুলনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তিনগুন বেড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় দুই মিটার বৃদ্ধি পাবে বলে সকলের ধারনা। সমুদ্র অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষ ব্যাপক প্লাবনের সম্মুখীন হবে। বাস্তুচ্যুত হবে ব্যাপক হারে। এখন দাবি উঠেছে যে সব দেশের কারণে জলবায়ু শরণার্থীর সৃষ্টি, সেসব দেশকেই তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। ২০২০ সালে পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা খরার সম্মুখীন হয়েছে। এর সবকিছু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। সম্প্রতি কানাডায় ঘটেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাবানল। নজিরবিহীন বন্যা হয়ে গেল ইউরোপে। প্লাবিত হয়ে গেল বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড। দাবানলের মাত্রা অত্যাধিকভাবে দেখা দিল সাইবেরিয়া, ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল, যুক্তরাষ্ট্রের কেলিফোর্নিয়ায় ও উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চলে। সমগ্র বিশ্বে প্রায় ১৩৪টি দেশ এখন দাবানলের হুমকির সম্মুখিন। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নি:সরণ। এ সংকটটির আগমন হয়েছে শিল্পায়নের সূচনা যখন হয়েছে। যেসকল দেশ যতখানি শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছে সেসব দেশ পরিবেশকে ঠিক ততটুকুই দূষিত করেছে। দু:খজনক হলেও সত্যি ধনী দেশগুলোর উপরই এর দায়ভার বর্তায় বেশী। কিন্তু এর কুফলটা বেশি করে ভূগছে শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো। বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ বা সহনীয়রূপে রাখতে হলে বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়ন অবশ্যই করতে হবে। ধরিত্রীকে বসবাসের উপযোগী রাখতে বিশ্বজলবায়ু সম্মেলনে সকল দেশকে ঐকমত্যে পৌছতে হবে আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে।
বিবিসির খবরে বলা হয় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০ এর নেতারা ইতালীর রোমের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ৩০শে অক্টোবর ২০২১। তাঁদের এবারের আলোচনায় উঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনা ভাইরাস মোকাবেলার বিষয়টি। করোনা শুরুর পর এই প্রথম জি-২০ নেতারা একত্রিত হলেন। কার্বন নির্গমন কমাতে জরুরী পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির সতর্কবার্তার মধ্যেই এবার জি-২০ অনুষ্ঠিত হল। বিশ্বের ১৯টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে গড়া জি-২০ গ্রুপ বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ কার্বন নি:সরণের জন্য দায়ী। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বিশ্বনেতারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে বৈশ্বিক সভ্যতার দ্রুত পতন হবে। এক্ষেত্রে যথাযথ অগ্রগতি না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষুধা, সংঘাত এবং গণঅভিবাসনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রোমে ৩০.১১.২০২১ইং শুরু জি-২০ সম্মেলনের প্রাক্কালে এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, “প্রস্তাবিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আমাদের সভ্যতা পিছিয়ে যাবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এমন জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, যার সঙ্গে আমরা কোনদিন একমত হতে পারব না।” তবে বরিস জনসন স্বীকার করেন, জি-২০ সম্মেলন বা নভেম্বর’২১ এ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনের কোনটিতেই বৈশ্বিক উষ্ণতা ঠেকাতে পারবে না। তিনি বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ আশা করতে পারি বৈশ্বিক উষ্ণতার গতি কমিয়ে আনার বিষয়টিতে।” বরিস জনসন সতর্ক করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিশ্ব নেতাদের অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে প্রাচীন রোম সম্রাজ্যের যেভাবে দ্রুত পতন হয়েছিল, বৈশ্বিক সভ্যতা সেভাবেই ভেঙ্গে পড়বে। গত ২৯শে অক্টোবর’২১ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বনেতাদের সতর্ক করে বলেছেন, জি-২০ নেতাদের মধ্যে নতুন করে আস্থা সৃষ্টি না হলে গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলন ব্যর্থ হতে পারে।
৩১শে অক্টোবর থেকে ১২ই নভেম্বর’২১ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর এটিই বৃহত্তম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন। প্রায় ২০০টি দেশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর পরিকল্পনা হাজির করতে বলা হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রধান কারণ এই গ্যাস। সম্প্রতি দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক কলামে সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, বিশ্বে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় সত্যিকার অর্থে কাজ করার মত কোন নেতা নাই। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মত উচ্চ আয়ের দেশগুলো নিজেদের জলবায়ু বিষয়ক অগ্রদূত বলে জাহির করলেও মূলত: তারাই এ সংক্রান্ত নিয়ম ভাঙ্গছে এবং সংকটকে আরও প্রকট করছে। যুক্তরাজ্যের মত দেশও কাজের চেয়ে কথা বেশি বলছে বলে তিনি দাবী করেন। গ্রেটা থুনবার্গ তার কলামে লিখেছেন, “জলবায়ু ও পরিবেশগত সংকট অস্বীকারের বিষয়টি এতটাই গভীরে প্রবেশ করেছে যে সেদিকে প্রকৃত নজর কেউ খুব কমই দেয়। যেহেতু কেউই এ সংকটকে “সংকট” বলছে না তাই বিদ্যমান সতর্কবানীসমূহ লোক দেখানো সবুজ কর্মসূচি এবং সংবাদ প্রচারেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কয়েক দশকের নিষ্ক্রিয়তায় আমাদের নেতারা প্রকৃতপক্ষে এ পথটাই বেছে নিয়েছেন। বক্তৃতা- বিবৃতির মাধ্যমেই দশকের পর দশক পার করে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আমাদের যদি ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের নির্ধারিত লক্ষমাত্রার চেয়ে নীচে থাকতে হয় তাহলে “অপরিবর্তনীয় পর্যায়ক্রমিক বিক্রিয়া” বন্ধ করার ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। যেহেতু আমাদের কাছে প্রযুক্তিগত সমাধান নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে শুধু এর কাছাকাছি যাওয়া যাবে, তাই ঝুঁকি হ্রাসের অর্থ হচ্ছে সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনতেই হবে।
কপ-২৬ সম্মেলনে জলবায়ু সংকট নিরসণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে বিশ্বনেতৃবৃন্দ আলোচনা করবেন। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নি:সরণ কমিয়ে আনাও ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানোর লক্ষ্যমাত্রায় কয়লাকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা, বনভূমির উজাড় বন্ধ, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রচলনের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। জীববৈচিত্র ও জনজীবন রক্ষায় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনে ওয়ার্নিং সিস্টেম গড়ে তোলাকেও কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ারপারসন। এবারের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর দিকগুলো মোকাবেলায় পরিকল্পনা নেয়া হবে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান বিশেষ গুরুত্ববাহী। ১ নভেম্বর’২১ তিনি গ্লাসগোতে উচ্চ পর্যায়ের একটি সভায় অংশ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন ৭ বছরে জলবায়ু সংক্রান্ত ব্যয় দ্বিগুন করেছে বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন প্রদানের প্রতিশ্রুতি পুরণ করা উচিত। বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সমাধান করা উচিত। কবি ইরসা ডেলি ওয়ার্ড এর কবিতা পাঠ ও একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনী দিয়ে সম্মেলন শুরুর পর বাস্পীয় ইঞ্জিন জেমস ওয়াটের জন্মভূমি স্কটল্যান্ডে শুরু হওয়া জলবায়ু সম্মেলনের তাৎপর্য বা শিল্পায়নের সূচনার ইঙ্গিত করে বরিস জনসন বলেন, এখান থেকেই টাইম বোমা সচল হয়েছে। তিনি সম্মেলন স্থলের বাইরে বিক্ষোভরতদের কথা উল্লেখ করে বললেন, “তরুণরা ক্ষুব্ধ। আমরা এখানে ষাটোর্ধ সবাই যদি তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে তা তাদের আরও ক্ষুব্ধ করবে। বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মোটলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মুখে টিকে থাকা বা অভিযোজনে অর্থায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কেনিয়ার তরুণ পরিবেশবাদী এলিজাবেথ ওয়াতহুতি অশ্রুত থাকা শতকোটি মানুষের স্মরনে এক মুহূর্ত নীরবতা পালনের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, বিশ্ব এখন জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে-ভয়াবহতার শিকার ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। শীর্ষ নেতাদের উদ্বোধন পর্ব শেষে শুরু হয় নিজ নিজ দেশ কি করবে তা নিয়ে নেতাদের বক্তৃতা । জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় হালনাগাদ করা ন্যাশনেলি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন বা এনডিসি থেকে বোঝা যাবে চলতি শতকের শেষে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫০ সে: এর মধ্যে সীমিত রাখতে তাঁরা কি কি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল