অভাবের দিনগুলোতে জীবিকার বিন্যাস
Published : Friday, 12 November, 2021 at 12:00 AM
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা ||
কিছুদিন জাতিসংঘের ‘স্পেশাল রিপোর্ট অন ড্রট ২০২১’ শীর্ষক খরাবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে খুব শিগগির আরো একটি ‘মহামারি’ আসছে, যার নাম ভয়াবহ খরা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু ও ঋতুগুলোর সময়ের দ্রুত পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপচয় এবং পৃথিবীজুড়ে জনঘনত্ব বৃদ্ধিই ভয়াবহ এ খরার কারণ হবে। আইপিসিরি রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়েছে। রিপোর্ট মতে, ২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে আফ্রিকা ও মধ্য-আমেরিকার দেশগুলোর অন্তত ১৬ কোটি ৬০ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে এরই মধ্যে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, যে গভীরতায় খনন আধুনিক প্রযুক্তির পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে উত্তরোত্তর। গত দুই দশকে বিশ্বে খরাক্লিষ্ট হয়েছেন অন্তত দেড় শ কোটি মানুষ। যার জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের অর্থনীতি।
হাদিসের ভাষ্যমতে, মহান আল্লাহ এই উম্মতকে দুর্ভিক্ষ দিয়ে সমূলে ধ্বংস করবেন না, যেহেতু রাসুল (সা.) মহান আল্লাহর কাছে তাঁর উম্মতের জন্য দোয়া করেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৭১৫০)
তবে কখনো কখনো বৈশ্বিক কিংবা এলাকাভিত্তিক দুর্ভিক্ষ আসবে বলে হাদিসে ইঙ্গিত রয়েছে। এ সময় মুমিনের করণীয় কী হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন রাসুল (সা.)। নবীজি (সা.)-এর যুগেও মদিনায় দুর্ভিক্ষ এসেছিল, এই দুর্ভিক্ষ থেকে উম্মতকে বাঁচাতে সবাইকে ভাগাভাগি করে খাবার গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করেছিলেন, যাতে ক্ষুধার জালায় কোনো অসচ্ছল ব্যক্তি কষ্ট না পায়। জাবালা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা মদিনায় কিছুসংখ্যক ইরাকি লোকের সঙ্গে ছিলাম। একবার আমরা দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হই, তখন ইবনু জুবায়ের (রা.) আমাদের খেজুর খেতে দিতেন। ইবনে উমর (রা.) আমাদের কাছ দিয়ে যেতেন এবং বলতেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকে তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া একসঙ্গে দুটো করে খেজুর খেতে নিষেধ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২৪৫৫)
সুবহানাল্লাহ, প্রিয় নবী (সা.) একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। সমাজে অভাব-অনটন দেখা দিলে তিনি এমন এমন পদক্ষেপ নিতেন, যাতে সমাজের নিম্নবিত্তরা অভাবের চাকায় পিষ্ট না হয়ে যেতে হয়। এবং মহান আল্লাহর কাছে পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য বেশি বেশি দোয়া করতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াকিদ (রা.) বলেন, তিন দিনের ওপরে কোরবানির গোশত খেতে রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রহ.) বলেন, আমি বিষয়টি ‘আমরাহ (রা.)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ইবনে ওয়াকিদ সত্যই বলেছেন। আমি আয়েশা (রা.)-কে বলতে শুনেছি যে রাসুল (সা.)-এর যুগে ঈদুল আজহার সময় বেদুঈনদের কিছু পরিবার শহরে আগমন করে, তখন রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা তিন দিনের পরিমাণ জমা রেখে বাকি গোশতগুলো সদকা করে দাও। পরবর্তী সময়ে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), মানুষ তো কোরবানির পশুর চামড়া দিয়ে পাত্র প্রস্তুত করছে এবং তার মাঝে চর্বি গলাচ্ছে। রাসুল (সা.) বলেন, তাতে কী হয়েছে? তারা বলল, আপনিই তো তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত খাওয়া থেকে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমি তো বেদুঈনদের আগমণের কারণে এ কথা বলেছিলাম। অতঃপর এখন তোমরা খেতে পারো, জমা করে রাখতে পারো এবং সদকা করতে পারো।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৯৯৭)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর যুগে (অতি বৃষ্টির কারণে) মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হলে একদিন জুমার দিন রাসুল (সা.) মিম্বরে উপবিষ্ট হয়ে লোকদের সামনে জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন। এক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, ধন-সম্পদ বরবাদ হয়ে গেল, সন্তান-সন্ততি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ছে।...রাসুল (সা.) বলেছেন, হে আল্লাহ, আমাদের চারপাশে, আমাদের ওপর নয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসুল (সা.) হাত দিয়ে যেদিকেই ইশারা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেদিকেই ফর্সা হয়ে গেছে। এমনকি আমি মাদিনাকে আয়নার মতো পরিষ্কার দেখতে পেলাম। এদিকে ‘কানাত’ নামক প্রান্তরে এক মাস ধরে পানির ধারা বয়ে গেল। যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ-ই এসেছে সে-ই অতি বৃষ্টির সংবাদ দিয়েছেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৪)
প্রিয় নবী (সা.)-এর এই শিক্ষাগুলো সাহাবায়ে কেরামও তাদের শাসনামলে প্রয়োগ করেছেন। ফলে দুর্ভিক্ষের কারণে তাদেরও খুব বেশি বিপদে পড়তে হয়নি। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) দুর্ভিক্ষের বছর বলেন, আর সেই বছর ছিল ভীষণ দুর্বিপাক ও কষ্টের। উমর (রা.) পল্লী অঞ্চলের বেদুইনদের উট, খাদ্যশস্য ও তেল প্রভৃতি সাহায্য সামগ্রী পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি গ্রামাঞ্চলের একখণ্ড জমিও অনাবাদি পড়ে থাকতে দেননি এবং তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হলো। ওমর (রা.) দোয়া করতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি তাদের রিজিক পর্বত চূড়ায় পৌঁছে দিন।’ আল্লাহ তার এবং মুসলমানদের দোয়া কবুল করলেন। তখন বৃষ্টি বর্ষিত হলে তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ (সব প্রশংসা আল্লাহর)। আল্লাহর শপথ! যদি আল্লাহ এই বিপর্যয় দূর না করতেন, তবে আমি কোনো সচ্ছল মুসলমান পরিবারকেই তাদের সঙ্গে সমসংখ্যক অভাবি লোককে যোগ না করে ছাড়তাম না। যতটুকু খাদ্যে একজন জীবন ধারণ করতে পারে, তার সাহায্যে দুজন লোক ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫৬৪)
সুবহানাল্লাহ, বর্তমান যুগেও যদি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সংকটের দিনে জনগণকে ঘরে ঘরে খাদ্য সহায়তা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বনায়ন, চাষবাস ও বিভিন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জণসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারে এবং প্রয়োজনে মানুষকে ভাগাভাগি করে খাওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে ও মহান আল্লাহর কাছে জনগণকে নিয়ে সাহায্য প্রার্থনায় আত্মনিয়োগ করতে পারে, তবে এ যুগেও মহান আল্লাহর সাহায্য আসবে ইনশাআল্লাহ। কাউকে অভাব-অনটনে কষ্ট করতে হবে না, সবুজায়ন ও বনায়নের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ সবাইকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অবলম্বনের তাওফিক দান করুন। আমিন।