এস এম নাজের হোসাইন ||
ভোজ্যতেল, চাল, চিনি, সবজির দামের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, তখনই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। কয়েক দিন আগে টিসিবির পণ্যের দামও বাড়ানো হলো। আবার এলপিজির দামও দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাসের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, যা খুবই ভয়াবহ হতে পারে। অন্যদিকে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি। এ অবস্থায় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানি ব্যতিরেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা যথাযথ সমর্থনযোগ্য নয়।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং ভর্তুকি কমানোর যে কারণ দেখানো হয়েছে, তা একেবারেই অযৌক্তিক। গত প্রায় আট বছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী ছিল। অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি মাত্র ৪০ ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু তখন দেশে তেলের দাম সমন্বয় করা হয়নি। প্রতিবেশী অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হয়েছিল। কিন্তু দেশের বাজারে না কমিয়ে সরকার বিপুল মুনাফা করেছে। ফলে দেশীয় তেলের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করা অযৌক্তিক।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদেরকে আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি করবে অত্যধিক। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, তা সাময়িক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তেলের দাম আবার কমে আসতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে হুট করে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সমীচীন নয়। সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যদি নিয়মিত সমন্বয় করত তাহলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এখন হঠাৎ দামবৃদ্ধির সুযোগ নেবে ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম সংস্থা (বিপিসি) বিভিন্ন সময়ে ভর্তুকির অজুহাত তুলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেও এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো বিইআরসির গণশুনানির মাধ্যমে জনগণকে জানানো উচিত। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি ও সেবা সার্ভিসের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। সেখানে নতুন করে তেলের মূল্য ও গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়ে জনভোগান্তি আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে অনভিপ্রেত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার উদ্ভব এড়াতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
মনে রাখা দরকার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, সেবা সার্ভিসের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। এমনিতেই করোনা মহামারি সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অনেকের আয়-রোজগারও বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো অত্যন্ত অমানবিক সিদ্ধান্ত। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও কৃষি ব্যয় বাড়বে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়তে পারে বিদ্যুতের দামেও। এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিটি পণ্যের মূল্য আরেক দফা বাড়িয়ে দেবে। সব মিলিয়ে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
পিপিআরসি ও ব্র্যাক-বিআইজিডি জরিপের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির এই সময়ের মধ্যে তিন কোটি ২৪ লাখ লোক দরিদ্র হয়েছে। নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ানো ভোক্তাসাধারণের ওপর অমানবিক চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ জ্বালানি তেলের সঙ্গে সবকিছুর একটা সংযোগ আছে। সে কারণে এখন মূল্যবৃদ্ধি না করে যথাসম্ভব কমিয়ে এনে পরিবহন ভাড়া, পণ্য ও সেবামূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা জরুরি ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে শুধু ওই পণ্যটির মূল্য ওঠানামা করে না; এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়া; বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার মূল্যও বেড়ে যায়। ফলে সরকার একটি পণ্যের মূল্য বাড়ালেও ভোক্তাকে বহু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ভার সইতে হয়। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় পণ্য রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুদদার নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি করছে। এমতাবস্থায় পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে সাধারণ জনগণের ওপর বাড়তি মূল্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্যাব