প্রভাষ আমিন ||
আন্তর্জাতিক
বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়াতে হবে। নইলে সরকারের
লোকসান হবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খুব সহজ যুক্তি। এর বিপরীতে আমাদের
কিছু বলার নেই। তবু দুটি কথা বলতে চাই। প্রথম কথা হলো, সরকার তো সিটি
গ্রুপের মতো ব্যবসায়ী নয় যে লোকসানের চিন্তায় তাদের ঘুম আসবে না। তবু আমি
ধরে নিচ্ছি, লাভ-লোকসানটাই শেষ কথা। সরকারের কী ‘ঠ্যাকা’ পড়েছে বেশি দামে
তেল কিনে কম দামে বেচার। তাই দাম বাড়ানো একদম ঠিক আছে। লাভ-লোকসানের কথাই
যখন এলো, তখন আরেকটা কথা বলে নিই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত
কয়েক মাসে সরকারের কয়েকশ’ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বটে। কিন্তু আগের ৭ বছরে
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকার সুবাদে সরকার যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা লাভ
করলো, সেটা গেলো কই?
সেই লাভ দিয়ে তো সরকার চাইলে আরও কয়েক বছর লোকসান
দিতে পারতো। তবে আমরা ‘আদার ব্যাপারী,, সরকারের কাছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা
লাভের হিসাব চাওয়া আমাদের কাজ নয়। আর এই যে চারদিকে এত দুর্নীতি, লুটপাট,
ঋণের নামে ব্যাংক লুট, সেই টাকায় কানাডায় বাড়ি, সিস্টেম লসের নামে
জোচ্চুরি- সরকার লাভ না করলে এই টাকাগুলো কোত্থেকে আসবে। শেষ পর্যন্ত কাটার
জন্য তো জনগণের পকেটই আছে। অর্থমন্ত্রী কিন্তু স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, সরকার
তো টাকা ছাপিয়ে দেশ চালাবে না। তাকে আয় করেই ব্যয় করতে হবে। অর্থমন্ত্রীকে
অনেক ধন্যবাদ। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির পরীক্ষায় গোটা পাকিস্তানে
রেকর্ড মার্কস পাওয়া ‘লোটাস’ উপাধি জুটেছিল তার। আয়-ব্যয়ের হিসাবটা তিনি
ভালোই বুঝবেন। তাকে অনুরোধ জানাচ্ছি, সরকারি আর কোন কোন প্রতিষ্ঠান লোকসানে
আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া হোক।
আন্তর্জাতিক বাজারে
জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে বলে দেশেও বাড়াতে হয়েছে। যৌক্তিক কথা। আচ্ছা
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে কি দেশে দাম কমানো হবে? অবশ্যই হবে। সরকারি
গবেষকরা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে হাজির। গত এক যুগে সরকার পাঁচবার তেলের দাম
বাড়িয়েছে, তেমনি পাঁচবার কমিয়েছেও। বাহ বাহ, দারুণ জনদরদী সরকার বটে। তবে
ছোট মুখে একটা শুভঙ্করের ফাঁকির কথা বলি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ৫ টাকা
বাড়লে সরকার বাড়ায় ৭ টাকা। আর আন্তর্জাতিক বাজারে ৫০ টাকা কমলে সরকার কমায় ৫
টাকা। এবার পরিষ্কার হলো তো বিষয়টা? দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের আরেকটা
অকাট্য যুক্তি আছে, পাশের দেশ ভারতে তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এবার
বাংলাদেশ যেদিন দাম বাড়িয়েছে, ভারত সেদিন কমিয়েছে। তারপরও ভারতে দাম বেশি।
আর তাতে বাংলাদেশ থেকে তেল পাচার হয়ে যায়। সরকারের মন্ত্রীরা যখন বলেন,
ভারতে তেল পাচার হয়ে যায়, তখন তাদের একটুও লজ্জা লাগে না? পাচার হয়ে যায়
মানে হলো, আপনারা আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে পারছেন না। আর তেল তো কোনও
কঠিন পদার্থ নয় যে কোমরে গুজে পাচার করে ফেললাম। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে
না পারার দণ্ডও জনগণকেই দিতে হবে?
কথা বেশি হয়ে যাচ্ছে, তবু আরেকটা কথা
বলি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বর্তমান সরকার ১২
বছরে পাঁচবার তেলের দাম বাড়িয়েছে, পাঁচবার কমিয়েছে। কিন্তু বিএনপি সরকার ৫
বছরে ৮ বার তেলের দাম বাড়িয়েছে। এটা তথ্য, তাই মানতে আপত্তি নেই। কিন্তু
নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ১৫ বছর আগে বিএনপি কী খারাপ কাজ করেছে, তা মাটি খুঁড়ে
বের করে এনে ঢাল বানানোটা খুব অশ্লীল লাগে। আর বিএনপি খারাপ করেছে বলেই তো
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। বিএনপির ১৫ বছরের পুরনো অপকর্মের পচে
যাওয়া শাক দিয়ে সরকার আর কত নিজেদের টাটকা অপকর্মের মাছ ঢাকবে? সরকার খুব
চালাকও বটে, একেবারে তারা ডিজেল আর কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে
বাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে বারবার বাড়াতে না হয়। তাতে পরিসংখ্যানে সমস্যা হবে।
এখন সরকার বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, আমরা ১২ বছরে মাত্র পাঁচবার তেলের দাম
বাড়িয়েছি, আর বিএনপি ৫ বছরে বাড়িয়েছে ৮ বার। আর তথ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, এ
বছরের মধ্যেই দেশে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। এ বছরের তো আর
মাত্র দুটি মাস বাকি। কোনোরকমে এই দুইটা মাস কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। তারপর
তো কেরোসিনের কোনও দরকার নেই। তখন কেরোসিনের লিটার ৮০ টাকা না ৮০০ টাকা
তাতে গরিব মানুষের কিছু যাবে আসবে না। টিমটিমে কুপি নয়, তাদের ঘরে তখন
জ্বলবে ঝলমলে ‘ফিলিপস বাত্তি’।
ইদানীং দেশে ক্রিকেট খুব
আলোচিত-সমালোচিত। বাংলাদেশে মোট ১৮ কোটি প্রধান নির্বাচক ও প্রধান কোচ
আছেন। নাজমুল হাসান পাপনের মতো তারাও সবাই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। তো ক্রিকেটে
‘টাইমিং’ বলে একটা শব্দ আছে, সবাই জানেন। টাইমিং ভালো না হলে যে শটে ছক্কা
হতে পারতো, তা একটু গড়বড় হয়ে যায়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর টাইমিংটা
একদম ভালো হয়নি। মিস টাইমিংয়ে সরকার ক্যাচ তুলে দিয়েছে। কিন্তু মজার
ব্যাপার হলো, সেই ক্যাচ ধরার মতো কোনও ফিল্ডার নেই মাঠে। সরকার একাই
খেলোয়াড়, তাই যতই ক্যাচ উঠুক আউট হওয়ার আশঙ্কা নেই। বলছিলাম টাইমিংয়ের কথা।
মাঠে প্রতিপক্ষ থাকুক না থাকুক, খেলার তো কিছু নিয়ম-কানুন আছে, সেটা
সবাইকে মানতে হয়। করোনাকালের ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধার
প্রক্রিয়ায় আছে। করোনা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীনদের জীবনে বড় ধাক্কা
দিয়েছে। অনেকে বেকার হয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকের আয় কমে
গেছে। তারপরও বছর বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে অভ্যস্ত
মানুষগুলো আবার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই করছিল। তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
মানুষের পিঠ আবার দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছিল হু হু
করে। এই সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলোর
দেয়াল ভেঙে ওপারে চলে যাওয়ার দশা। দাম বাড়ানোর টাইমিংটা বড্ড খারাপ হলো। ৪৩
হাজার কোটি লাভ থেকে বছর দুয়েক সরকার লোকসানটা টেনে নিতে পারতো। কোভিডের
ধাক্কাটা সয়ে যাওয়ার পর জ্বালানি তেলের ধাক্কাটা এলে এরমধ্যে মানুষের সয়ে
যাওয়ার সক্ষমতা বাড়তো। অনেকে বলছেন, ডিজেল আর কেরোসিনের দাম এটুকু বাড়ানো
নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে? বিশ্বাস করুন, যদি সাধারণ মানুষের আয় বাড়তো,
দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকতো; তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে আমি টুঁ-শব্দও
করতাম না। তেলের দাম তো একটি সূচনা মাত্র। পাহাড় চূড়া থেকে একটা ছোট্ট স্নো
বল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; এখন সেটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামবে আর বাস ভাড়া বাড়বে,
পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়বে, সেচের খরচ বাড়বে, বিদ্যুতের দাম বাড়বে,
জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে। ব্যয় বাড়বে, আয় বাড়বে না। অসুবিধা নেই,
বাংলাদেশের মানুষ মুখ বুজে সয়ে যেতে অভ্যস্ত। মানুষ ঠিক মানিয়ে নেবে। না হয়
এবার কষ্টটা একটু বেশিই হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, তাই
বাংলাদেশেও দাম বাড়াতে হবে। দেশ চালাতে তো সরকারের টাকা লাগবে। টাকা ছাপিয়ে
তো আর দেশ চালানো যায় না। আর দাম না বাড়ালে তেল সব ভারতে পাচার হয়ে যাবে।
তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো একদম ঠিক আছে। এ নিয়ে কোনও কথা হবে না।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ