ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দৃঢ় পদক্ষেপ  
Published : Saturday, 13 November, 2021 at 12:00 AM
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দৃঢ় পদক্ষেপ  ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।।
গত এক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যারা একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বিবেচনা করতো, তারাই আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে এই উন্নয়ন খুব সহজেই অর্জিত হয়নি। এর পেছনে ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টা, সুস্পষ্ট নীতিমালা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন। আমরা ইতোমধ্যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই অর্জন করিনি, দেশ সামাজিক সূচকে অনেক এগিয়ে গেছে, দরিদ্রতা কমেছে এবং টেকসই  উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ এগিয়ে রয়েছে। তবে সরকারের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বরাবর চেষ্টা করেছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশ এবং সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় এই গোষ্ঠী নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পূজা মন্দিরে কোরআন অবমাননার ঘটনা ঘটিয়ে আবার তারাই মন্দিরে ভাঙচুর, হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, এবং এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান ধারণার পরিপন্থী।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি চেষ্টা করেছিলেন সেই অবস্থান রক্ষা করার। কিন্তু অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু নেতাকর্মীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ এবং এ ধরনের ঘটনা ঘটার সময় প্রতিরোধ গড়ে না তোলা সচেতন নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলছে। শুধু সচেতন নাগরিক সমাজ বললে ভুল হবে, এটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও ভাবাচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। কয়েকদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলতে দেখেছি, "আপনারা ভোটের সময় হিন্দুদের কাছে যান, কিন্তু তাদের বিপদে আপনারা কখনোই তাদের পাশে থাকেন না"। এই বক্তব্যের মাধ্যমে যে বার্তাটি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দেবার চেষ্টা করেছেন সেটি হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের প্রাধান্যের কারণে তারা এই নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যেটা জানতে পারছি তা হলো, সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের প্রতিরোধ থাকলেও দেশব্যাপী তা ছিল না।
এমনকি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এক ধরনের সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে কয়েক মাস ধরে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে। বিশেষ করে ভোজ্য তেলের দাম এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আমরা জানি বাংলাদেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর অসততার কারণে রোজার আগে বা কোনও অনুষ্ঠানের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু সেটি আবার সেই অনুষ্ঠান পরবর্তী সময়ে পুনরায় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আমরা যে বিষয়টি লক্ষ করছি সেটি হলো, কোনও পণ্যের মূল্য একবার বাড়লে তা আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসছে না। এরমধ্যে পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এই তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস মালিকরা অঘোষিত ধর্মঘট করেছে, যার ফলে  জনগণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। একদিকে গণপরিবহন বন্ধ হওয়ার ফলে মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না করে বাস মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধি করায় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সমাজের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন স্তরের মানুষদের জীবনযাপনের ওপরে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গত এক দশকে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজারে যথেষ্ট অর্থের সরবরাহ ছিল।  ফলে একজন রিকশাচালক বা দিনমজুর ৫০০ টাকার ওপরে আয় করেন এবং সেই আয় দিয়ে সংসার খুব ভালোভাবে অতিবাহিত করছেন।  কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল ও চিনিসহ যেসব পণ্য প্রতিদিন মানুষের প্রয়োজন হয়, সেই পণ্যের দাম বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের বিপদ বাড়ে। এ কথা ঠিক যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে। ফলে, তেলের দাম বাড়ার কারণ থাকলেও অন্যান্য পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ আসলে অজানা। এই অবস্থা সৃষ্টির মূল কারণ হলো বাজার ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের অভাব। আমি আগেও উল্লেখ করেছি যে বাংলাদেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা সব সময় নিজেদের ব্যবসাকে প্রাধান্য দেয়। তাদের কাছে জনগণের আবেগের চেয়ে ব্যবসা বেশি জরুরি। এই শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যদি নিয়ন্ত্রণ না  করা যায়, তবে সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম নেবে। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ব্যবস্থা করার এবং একইসাথে দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার, ঠিক সেই সময় এই অসাধু ব্যবসায়ী এবং সরকারের মধ্যে থাকা কিছু প্রেতাত্মা তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন না করার ফলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি শুধু সাধারণ জনগণকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে না, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদেরও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পে স্কেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রত্যেক স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দ্বিগুণ বাড়িয়েছিল। সরকার মূলত এটি করেছিল দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেকেই  দুর্নীতি করে অর্থাভাবে। ফলে তাদের যদি পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া যায় তাহলে তারা হয়তো দুর্নীতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনও একইভাবে দুর্নীতি করছে। বাজার ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের সঙ্গে যুক্ত এই অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে আজ দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি, যা জনগণের সহ্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।
দ্রুততম সময়ে যদি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে জনগণ সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। গত এক দশকে বিএনপির সবচেয়ে বড় পরাজয় ছিল জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া। তারা জনগণের সামনে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি, যাতে আকৃষ্ট হয়ে জনগণ তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে নামবে। অন্যদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা বিএনপি থেকে জনগণের মুখ ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। কিন্তু মাসের পর মাস যদি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জনগণ জীবনযাপনে কষ্ট করবে, তখন তারা যেকোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি সবজির দামও খুব বেশি। বাজারে সবজির দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনও কারণ নেই।  দেশে সবজি উৎপাদনে কোনও ঘাটতি নেই। সেক্ষেত্রে সবজির দাম এত বাড়ছে কেন তা ভেবে দেখা দরকার। এমনকি কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের পর্যাপ্ত  দামও পাচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগীরা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত রয়েছে, যার মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে খুব দৃঢ় সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করছে জনগণ। কারণ, তিনিই সব জনগণের আস্থার স্থল। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে যাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন তারা নিজেদের দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রেই সুচারুভাবে পালন করতে পারেন না। আর এই কারণেই প্রত্যেকটি বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, যা একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভবও নয় এবং কাম্যও নয়। তারপরও আমাদের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়গুলো উপলব্ধি করবেন এবং এখান থেকে বের হয়ে আসতে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের একটি অগ্রাধিকার কার্যক্রম হওয়া উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে সরকারকে আর্থিক সংস্থান বাড়ানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু নজরদারি শক্তিশালী করা। এটা করতে পারলেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হবে।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।