মামুন রশীদ ||
বাড়ছে
সহিংসতা, বাড়ছে অপরাধ এবং পরিবর্তন হচ্ছে অপরাধের ধরন। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ
আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করছে শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খরবে। প্রায়
প্রতিদিনই সংবাদপত্রে শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশ পাচ্ছে।
চুরি, ছিনতাই তো বটেই, এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হত্যা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের
সঙ্গেও শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়েছে। কোমল হাতে, কোমল মনের শিশু-কিশোদের ভয়াবহ
অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার খবর বেদনার। এই কিশোররা কখনো একা আবার কখনো বা
সংঘবদ্ধভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে। নানা স্থানে, নানা নামে তারা দল গড়ে
তুলছে, নিজেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। আর সেই সংঘবদ্ধ শক্তিকে পুঁজি করে তারা
অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। নাম লেখাচ্ছে অপরাধীর খাতায়।
কিশোর গ্যাং, তাদের
দৌরাত্ম্য, তাদের কর্মকাণ্ড আজকাল প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতা দখল
করে নিচ্ছে। তা রীতিমতো আতঙ্কের। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে গ্যাং কালচার
গঠন ও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিশ্বের পরিচয়। তখনই দেশে দেশে এর ব্যাপকতা
এবং তাদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধের খবর প্রকাশ পেতে থাকে। এর পর সময়ের
প্রবাহে সে ধারায় ভাটা পড়ে। কিন্তু হালে আমাদের দেশে বেশ শক্তভাবেই মাথা
চাড়া দিয়ে উঠেছে গ্যাং কালচার। তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কয়েক বছর আগে রাজধানীর
উত্তরায় কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ডের খবরের মধ্য দিয়ে। নবম শ্রেণির ছাত্র
কিশোর আদনান কবীর খুন হওয়ার পর জানা যায় কিশোর গ্যাংয়ের কথা। তখনই আমরা
জানলাম বিগ বস, ডিসকো গ্রুপ, নাইনস্টার গ্রুপের কথা। পরবর্তীকালে ০০৭
গ্রুপ, লেবেল হাইয়ের মতো কিশোর গ্যাংয়ের নাম। সর্বশেষ জানা গেল
মোহাম্মদপুরের ‘ভাইব্বা ল কিং’ গ্রুপের নাম।
এই ‘ভাইব্বা ল কিং’ গ্রুপের
সদস্যরা পেশায় কেউ লেগুনা-অটোরিকশা চালক, কেউ দোকান কর্মচারী, কেউ বা
নির্মাণশ্রমিক আবার কেউ অফিসের পিয়ন হলেও রাতের বেলা তাদের কর্মকাণ্ড
পাল্টে যায়। দিনের পেশা পাল্টে রাতে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর নানা অপরাধে
জড়িয়ে পড়ার কথা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি তাদের ছিনতাই করার অপরাধে মালপত্রসহ
র্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে র্যাব সদস্যরা নানা
রকম অস্ত্র ও মাদকও উদ্ধার করেছে।
শুধু কি তারাই? না, একে একে বেরিয়ে
আসছে অসংখ্য নাম ও গ্রুপের খবর। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পুলিশ ও
র্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী রাজধানীতে এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি
কিশোর গ্যাং। তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে
রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বৃহত্তর মিরপুর, পুরান ঢাকার লালবাগ ও
হাজারীবাগ এলাকায়। কিশোর গ্যাংগুলোর সদস্য হিসেবে যারা নাম লিখিয়েছে, তাদের
অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্র। সবাই শিশু-কিশোর। তারা নিজেদের মধ্যে আড্ডা
দিতে দিতে গড়ে তুলেছে এসব গ্রুপ। তারা শুধু আড্ডা দেওয়াই নয়Ñ নিজেদের ভেতরে
গড়ে ওঠা হিরোইজমের প্রতিষ্ঠার জন্য, এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের চেয়ে শ্রেষ্ঠ
প্রমাণের জন্য বেছে নিয়েছে সহিংসতার পথ। আবার কোনো কোনো গ্রুপ নিজেদের
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পাশাপাশি সন্ত্রাসী কার্যক্রম, মাদকসেবন ও ব্যবসার
সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাং যে কত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, র্যাব সদর
দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে পুলিশের আইজির বক্তব্যেও তা স্পষ্ট। সেই অনুষ্ঠানে
তিনি পুলিশের জন্য কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই বর্তমানে সবচেয়ে বড়
চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি হিসাব
জানায়, দেশে গড়ে প্রতিবছর বিভিন্ন অপরাধে প্রায় দুই হাজার শিশু আটক হয়।
তাদের বিচারের জন্যও সোপর্দ করা হয়। এ তথ্যটি উৎকণ্ঠার। একই সঙ্গে তা
আমাদের জন্য বেদনারও। কারণ প্রায় ১৬-১৭ কোটি জনসংখ্যার আমাদের এই দেশে
বর্তমানে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা
প্রায় চার কোটি। শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সবাই শিশু। এই
শিশুদের একটি বড় অংশ যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তাদের দ্বারা সমাজের
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও জঘন্য অপরাধ বারবার সংঘটিত হতে থাকেÑ তা হলে তা যে আমাদের
ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেয়। সমাজে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে
অপরাধপ্রবণতার মাত্রা যে দিন দিন বাড়ছে, তাও স্পষ্ট হয় অন্য একটি তথ্যে। এ
ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য কিশোর অপরাধের সংখ্যা যে বাড়ছে, তার
পক্ষে বিভিন্ন সময়ে কিশোর অপরাধের সংখ্যা এবং এ সংক্রান্ত মামলার কথা
উল্লেখ করছে। অথচ এ কিশোর-কিশোরীরাই আমাদের সম্পদ, আমাদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ তাদের নিয়েই আমাদের শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা বেশি।
কেন
আমাদের কিশোর-কিশোরীরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে? যখন তাদের থাকার কথা পড়ার
টেবিলে, খেলার মাঠে, নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে- তখন কেন তারা জড়িয়ে পড়ছে
অপরাধে? কেন বারবার নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়ে আসছে তারা? কোনো
অভিভাবকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে? এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ই বা কী?
আমরা কি তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছি? যদি
সেটি হয়, তা হলেই বা কেন তা হচ্ছে? এই যে মনের মধ্যে হুড়মুড় করে ধেয়ে আসা
অসংখ্য প্রশ্ন, তার জবাব খোঁজার দায়িত্ব আজ প্রত্যেকের। আমরা যদি শুধু
কিশোর-কিশোরীদের অপরাধের কথা চিন্তা করে তাদের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দিই, তা হলে এতে যেমন সমাধান মিলবে না- তেমনি তাদের
যদি আইনের আওতায় না আনি, শাস্তির পাশাপাশি সংশোধন করতে না পারি; তা হলেও এ
বিপদ থেকে আমাদের নিস্তার নেই বলেই মনে হয়। কিশোর অপরাধের খবর
সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে বলেই আমরা তা জানতে পারছি। আবার
এমন অনেক খবরই আমাদের অজানা থেকে যাচ্ছে। তাই অপরাধের সংখ্যা দিয়ে এর
ভয়াবহতার পরিমাপ করা যাবে না, বরং আমাদের খুঁজে বের করতে হবে সমস্যার কারণ ও
তার প্রতিকার। আমাদের দেশে আগেও কিশোর অপরাধ ছিল। কিন্তু তা কখনই এতটা
ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয়নি, কখনো এমন হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এই ভয়ঙ্করতা
ও হিংস্রতার লাগাম টানতে আমাদের সবাইকে উদ্যোগী এবং সচেতন হতে হবে। একই
সঙ্গে খুঁজে বের করতে হবে কেন এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই কিশোররা গঠন করছে
গ্যাং? কোন স্বপ্ন নিয়ে তাদের এই দলের পেছনে ছুটে চলা, নৃশংস হয়ে ওঠা।
তাদের
উদ্দেশ্য কি শুধুই প্রভাব বিস্তার করা? শুধ্ইু দৃষ্টি আকর্ষণ করা?
নায়কোচিত স্বরূপে নিজেকে প্রকাশ করা? নাকি তার সঙ্গে ধনী হওয়ার প্রবণতাও
কাজ করছে জোরেশোরে। নানা রকম প্রযুক্তির প্রায়োগিক সুবিধা ভোগের মধ্য দিয়ে
আজ আমাদের সামনে হঠাৎ ধনী হওয়ার প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আমরা প্রায়
সবাই যে কোনো উপায়ে যেনতেনভাবে ধনী হয়ে উঠতে চাইছি। এ ক্ষেত্রে নিজের পেশা
নিয়ে যেন আমাদের কোনো লক্ষ্য নেই। নিজের কাজ ও উন্নতি নিয়ে কোনো স্বপ্ন
নেই। স্বপ্ন রয়েছে শুধু রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে। আর এ স্বপ্নও আমরাই
গড়ে দিচ্ছি সন্তানের ভেতরে। সন্তানকে যান্ত্রিক করে তুলছি। তাকে শেখাচ্ছি
কী করে অর্থ উপার্জন করা যায়? কারণ ধনী হওয়াই আজকের সমাজের স্ট্যাটাস। যে
কোনো উপায়ে, যে কোনো চাকরি বা যে কোনো ধরনের কাজই করি না কেন- সমস্যা নেই,
শুধু ধনী হতে হবে। সৎ থাকতে হবে- তার কোনো কথা নেই, বরং ধনী হওয়াই আজকের
একমাত্র লক্ষ্য। তাতে সাধনা, অধ্যবসায়, জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নেই। অন্যের
সম্পদ লুণ্ঠনের মধ্যেও যেন অপরাধ নেই। চাঁদা তোলায় অপরাধ নেই, নেই
হীনম্মন্যতাও। জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যেও নেই যেন অপরাধবোধ, বরং এটাই
নায্য পাওয়া। তাই ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করার মধ্যেও বিবেকের যন্ত্রণা ও
অপরাধ নেই। দর্শন একটাই, ধনী হতে হবে। এই প্রবণতা প্রতিটি ক্ষেত্রে। কিন্তু
আমরা যদি এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি, তা হলে হয়তো কিশোর
গ্যাংয়ের মতো একটি অপরাধপ্রবণ প্রজন্মকে সুস্থতার সন্ধান দিতে পারব না-
থামাতে পারব না এ ধরনের কালচার।
কিশোর গ্যাং, গ্যাং কালচারকে রুখতে হলে
আমাদের সন্তানদের জ্ঞানার্জনের পথ খোলা রাখতে হবে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে
হবে। তাদের সামনে আদর্শ রাখতে হবে- যে আদর্শ ও স্বপ্নকে লালন করার মধ্য
দিয়ে তারা আগামীর পথ নির্মাণ করবে। আজকের সমাজে আমাদের সন্তানের সামনে,
আমাদের কিশোর-তরুণদের সামনে আদর্শ কোথায়? তারা আজ তাদের সামনে কাকে দেখে
নিজেদের গড়ে তুলবে? তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নেবে এমন স্বপ্নবান আদর্শ
কোথায়? আজকের তরুণদের সামনে আদর্শ বলতে আমরা কাদের দাঁড় করাব? যারা এই
শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন দেখাবেন, তাদের আদর্শ হবেন। একজন বিজ্ঞানী,
শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, স্থপতি, কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা যদি তাদের
সামনে শ্রদ্ধার আসনে না-ই থাকেন, আদর্শ হিসেবে না থাকেন, সেই শূন্যতা আমরা
পূরণ করতে না পারি- তা হলে আমাদের সন্তানদের আমরা স্বপ্ন দেখাব কী করে?
শুধু অর্থের পেছনে না ছুটেও যে জীবনকে স্মরণীয় করে তোলা যায়, সেই বাণী আমরা
কী করে তাদের শেখাব? এ জন্য আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শ্রদ্ধা,
স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কগুলো পুননির্মাণ করতে হবে।
লেখক:কবি ও সাংবাদিক