ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসরীয়....
Published : Sunday, 28 November, 2021 at 12:00 AM
রবিবাসরীয়....







ব্যাখ্যা বিজ্ঞান
(সাহিত্য পাঠ এবং সাহিত্য অনুধাবন দুটো আলাদা ব্যাপার।)
রবিবাসরীয়....হাসিব উল ইসলাম ||
সাহিত্যের অতি সাধারণ পাঠকের মুখ থেকে অনায়াসে ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের কথা শোনা যায় না। ইংরেজি ঐবৎসবহবঁঃরপং ( বাংলা হের্মেনেত্য, বাখ্যা বা দ্বিভাষিকতার বিজ্ঞান) বলতে, সাধারণত  লিখিত শব্দ থেকে মর্মার্থ বের করা বোঝায়। ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়ার সাথে ঠিক কিভাবে অর্থ জ্ঞাপন করা হচ্ছে, এবং কিভাবে, ইতিপূর্বে অর্থ আদান প্রদান হত, আমরা আমাদের তরফ থেকে কেমনে বুঝি তা অন্তর্ভুক্ত।
ঐবৎসবহবঁঃরপং শব্দটির একটি আপাতগ্রাহ্য উৎপত্তি প্রাসঙ্গিক এবং মজাদার। হারমেস ছিলেন গ্রীক দেবতাদের বার্তাবাহক। মানুষের বুদ্ধিসুদ্ধি যেহেতু দেবতাদের পর্যায়ের নয়, হারমেসের দায়িত্ব ছিল দেবতাদের স্বর্গীয় ভাষণ মানুষের কাছে বোধ্যগম্য করে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু হারমেসকে মিথ্যেবাদীদের পৌরাণিক পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। পায়ে পাখাওয়ালা লোকটি যা বলে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।  গল্প উপন্যাসও তো এমন — মনগড়া। অতএব, প্রশ্ন ওঠে, গল্প উপন্যাস কি গাদাগুচ্ছের  মিথ্যা নাকি উচ্চতর সত্য?
সাহিত্য কর্ম কি অর্থ প্রকাশ করে, এবং কিভাবে করে?
ব্যাখ্যা বিজ্ঞান অনুসন্ধান করে, কোথায় অর্থ নিহিত? আমাদের মনে যেখানে বোধের তৈরি হয় সেখানে? দর্শনের একটি শাখা ফেনোমেনলজি (মানুষের অনুভূতি, চিন্তা, এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করে) তা-ই বলে। অথবা, অর্থ কি টেক্সটের ভেতরেই নিহিত?  প্রধান প্রধান ধর্মসমূহ এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজমের মতবাদ এরকমই। নাকি (মার্শাল ম্যাকলুহান যেমন মত পোষণ করেন),অর্থ  মাধ্যম বা পাঠকের মধ্যে নিলীন? অথবা অর্থ কি বিভিন্ন সামাজিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে, (যেরকম করে জুরিরা কোন বিষয়ে রায় দেওয়ার জন্য অধিকাংশের সম্মতির ওপর নির্ভর করেন,) গঠিত হয়?
সাহিত্যের কি  একক কোন মর্মার্থ আছে, অথবা মন যত সম্ভব অর্থ তৈরি বা গ্রহণ করে? কিভাবে ইতিহাসের একটা সময়ে (১৯৩০ - ১৯৫৯) ডি এইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার -কে অশ্লীল হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি এই বই সংগ্রহে রাখাও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, আবার একই বই অন্য সময়ে (১৯৮৩) নির্দোষ হিসেবে বিবিসি ‘বুক অ্যাট বেডটাইম’ -এ সম্প্রচার করছে?
সময় কি আমাদের কম, বা বেশি জ্ঞানসম্পন্ন করে?
ধরেন, আপনাকে এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিনে মাত্র একটা রিটার্ন রাইড দেওয়া হল। আপনাকে বলা হল, হ্যামলেট নাটকটি ভালোভাবে বোঝার জন্য রাইডটি ব্যবহার করতে। আপনি কি :
১. টাইম মেশিনে চড়ে হাজার বছর পরের ভবিষ্যতে যাবেন যেখান সর্বশেষ শেকসপিয়র সমালোচক নাটকটি নিয়ে শেষ মন্তব্য করছেন?
২.নাকি  টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে ফিরে যাবেন? ১৬০১ সালে। লন্ডনের সাউদ ব্যাংকে গ্লোব থিয়েটারে হ্যামলেটের প্রথম মঞ্চাভিনয়ে। ভিড় ঠেলে, গন্ধ সহ্য করে, জ্যাকোবিন সময়ের মঞ্চে, আলোকসজ্জায়, পোশাকে জেমস বারবেজের কথা শুনবেন? কিন্তু তখন তো এই নাটকের কোন সমালোচনাই ছিল না।
সাহিত্যের অধিকাংশ পাঠকেরাই ভবিষ্যতে যাওয়ার চাইতে অতীতের  সময়ে ফিরে যেতে চাইবেন। কিন্তু কেন?
ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের অ-সাহিত্যিক উৎপত্তি
সাহিত্য সমালোচনার চেয়ে, ব্যাখ্যা বিজ্ঞান উৎপত্তি অনুসারে বরং দর্শনসমন্ধীয়। ব্যাখ্যা বিজ্ঞান অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাইবেলের জার্মান ভাষ্যকারদের দারুণ আগ্রহের বিষয় ছিল। পবিত্র গ্রন্থ কি আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে, না প্রতীকীভাবে? পবিত্র গ্রন্থের মর্মার্থ কি তর্কসাপেক্ষ? সালমান রুশদি বুঝেছেন যেখানে স্বর্গ রচিত গ্রন্থ জড়িত, এমনি আজকের দিনেও, সেখানে এই জাতীয় প্রশ্ন তোলা মানে জীবন -মৃত্যু নিয়ে টানাটানি করা।
ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের আপার্তবৈপরীতা
ব্যাখ্যা বিজ্ঞান অনেক কূটাভাস সৃষ্টি করে, যার মধ্য একটি হার্মেনিউটিক সার্কেল নামে পরিচিত। ব্যাপারটা একই বৃত্তে অবিরাম পাক খাওয়ার মতোন। সমস্যাটির মূল এরকম : আমি হ্যামলেট নাটকের একটা অংশ বুঝতে পারি না, যদিনা  পুরো নাটকটি সম্পর্কে আমি জানি। আবার,  প্রথমে আলাদা আলাদাভাবে  নাটকের অংশগুলি না বুঝলে  পুরো নাটকটি আমি বুঝতে অক্ষম। অতএব, আমি নাটকটা কখনোই বুঝতে পারবো না। কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকবো।
আরো অনেক আপার্তবৈপরীতা এবং ধাঁধা আছে। ধরা যাক, লেখকের মৃত্যুতে ডিকেন্সের শেষ উপন্যাস ঊফরিহ উৎড়ড়ফ অথবা নভোকবের শেষ উপন্যাস ঞযব ঙৎরমরহধষ ড়ভ খধঁৎধ, অর্ধেক হয়ে গেল, কেউ কি এই খন্ডিত অংশটুকু বুঝতে পারবেন? যদি একটা গাড়ির কার্বুরেটর খুলে নেওয়া হয়, গাড়িটা কি চলে?
এই কূটাভাস অনুযায়ী, রল্যা বার্থ প্রথম পাঠ, এবং দ্বিতীয় পাঠ (পরবর্তীতে আরো অনেক অনেক।পাঠের) একটি সুত্রের কথা বলেন। প্রথম পাঠে, আমরা সাধারনত, বার্থ যেটাকে হারমেনিউটিক কোড বলেন, তাতে সামনোযোগী হই। যেমন, আগে কি ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে কি ঘটবে, এসব। আমরা সংস্কারহীনভাবে তথ্য একত্রিত করি, জানি না কোন তথ্য গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা গুরুত্বহীন। দ্বিতীয় পাঠে আমাদের সাড়া আরো বেশি অবস্থাগত। আমরা আরো বেশি যাতে মনোযোগী হই বার্থ তাকে বলেন সিম্বলিক কোড। বালজাকের গল্প সারাসিন -এর বিশ্লেষণে তিনি সিম্বলিক কোডের চমৎকার প্রয়োগ দেখান। গল্পটা এভাবে শুরু হয়: গল্পকথক জানালায় বসে আছেন। নিবিষ্টভাবে তাঁর পিছনের বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভুবন, এবং একই সাথে তাঁর সামনে প্যারিসের জাঁকালো নাচঘর অবলোকন করছেন। গল্পে সারাসিন নামক এক ভাস্কর লা জামবিনেলা নামক এক অপেরা শিল্পীর প্রেমে পড়েন। সারাসিন যেটা বুঝতে পারেন না (আসলে মর্মান্তিকভাবে দেরীতে বোঝেন) যে, তিনি যার প্রেমে পড়েছেন উনি নারী নন, নারীর মতো এক পুরুষ। তাঁর প্রেয়সী একজন ক্যাসট্রাতো — নারী কন্ঠবিশিষ্ট পুরুষ যে কখনো তার অবস্থার দরুণ পরিপক্কতায় পৌঁছায়না। গল্পটা এতো চাতুরতার সাথে বলা যে, প্রথমবার পড়ে পাঠকেরাও বুঝতে পারেন না।
প্রথম পাঠে, জানালা একটি নিরপেক্ষ দৃশ্য। দ্বিতীয় পাঠে, জানালা নতুন তাৎপর্য বহন করে। জানালার স্বচ্ছ পর্দা দিয়ে বাইরের আর ভেতরের দুনিয়া দেখা যায়। আমরা গল্পের নায়ক/নায়িকার লিঙ্গগত দ্ব্যর্থতা বুঝি — সে আসলে নারী বা পুরুষের মাঝামাঝি একটা জানালার মতো অবস্থান করে।
বার্থেসিয় এই পদ্ধতি চমৎকারভাবে স্পষ্ট করে বিধিসম্মত সাহিত্য আসলে কোথায় সংশ্লিষ্ট। আমরা মহান সাহিত্যকর্মসমূহ বারবার পড়ি; অথবা এগুলো সম্পর্কে আগে থেকে কোন কিছু না জেনেই প্রথম বার পাঠ করি। ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের মোদ্দা কথা হচ্ছে, সাহিত্য পাঠ এবং সাহিত্য অনুধাবন প্রকৃতপক্ষে দুটো আলাদা ব্যাপার।
[ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের লর্ড নর্থক্লিফ ইমেরিটাস প্রফেসর, লেখক, এবং কলামিস্ট জন এন্ড্রু সাদার্ল্যাণ্ডের ৫০ খরঃবৎধঃঁৎব ওফবধং ণড়ঁ জবধষষু ঘববফ ঃড় কহড়ি অবলম্বনে লিখিত।]
পরিচিতি: হাসিব উল ইসলাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। পড়ান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনিবাসে। ]

রতনের দেখা
রবিবাসরীয়....মানিকরতন শর্মা ||

কবিরাজ দাদা আছেনি বাড়ি, অ কবিরাজ দাদা।
বাড়ির ঘাট থেকেই ডাক দেয় করম আলী। উঠানের পাশে একটা জামরুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় সে। একটু দম নিয়েÑ কবিরাজ দাদা আছেননি, অ কবিরাজ দাদা। বাড়িতে কোনো লোকজন নাই নি। এই বলে করম আলী আবার একটু দম নেয়।
এমন সময় ঘর থেকে বয়স্ক এক বিধবা মহিলা বের হয়। এসে বলেÑ বাবা ওতো একটু দক্ষিণের ক্ষেতে গেছে। এ কথা বলে ঘর থেকে একটা জলচকি এনে দিয়ে বলে, তুমি বাবা বও। আমি রতনরে দিয়া খবর দিতাছি।
কথাটা শেষ করতে না করতে, অ রতন, রতনরে আরে তুই কই গেলি। এবার স্বরটা নামিয়ে একটু ক্ষোভের সাথে আবার ডাকে, কই যে যায় হে, কাজের সময় পাওয়া যায় না।
এমন সময় দক্ষিণের ঘর থেকে হাতে লাকড়ি নিয়ে বের হয় রতন।
কি গ, তুমি দেখতে ছ না আমি লাকড়ি আনতাছি। কিয়ের লাইগ্যা ডাকতাছ।
আরে তোর দাদু কই, হের একটা জলদি খবর দে, রোগী আইছে বাড়ি।
দাদা তো ক্ষেতে গেছে। যাইতাছি। এই বলে রতন পরনের  ছেড়া ডিল হয়ে যাওয়া হাফপ্যান্টটা টেনে উপরে ওঠিয়ে একটা ভো দৌঁড় দেয়।
রতন। জন্মের পর থেকেই মামার বাড়িতে। এখানেই বেড়ে ওঠা। লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘর গেরস্থালির সব রকমের কাজ করে সে। বেশির ভাগ সময় দাদু প্রফুল্লের সাথেই সময় কাটায় সে। দাদু প্রফুল্ল খুব নরম স্বভাবের। কাজের ফাঁকে গুনগুনিয়ে গান করে। সে-গান তিনি একটি খাতায় লিখে রাখেন। প্রতি বৃহস্পতিবার হরিআসরে সেই গানগুলি গান তিনি। দাদুকে তার খুব ভালো লাগে। তাকে কখনোই রাগতে দেখেনি সে। বংশের  বড় নাতি রতন। তাকে নিয়ে প্রায়ই দূরগ্রামে পাচনের জিনিসপত্র আনতে যায় দাদু প্রফুল্ল। হরতকি, বয়রা, আমলকিসহ কতকি জিনিস জোগার করতে গেলে রতনকে সাথে নিয়ে যায় কবিরাজ দাদু।
রতনকে গাছে ওঠিয়ে দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকে দাদু। বারো বছরের রতন লঙ্গিটা গুছ দিয়ে গাছে ওঠে। ওঠতে গিয়ে প্রায়ই গাছের এব্রো থেব্রো  বাকলের ঘষা লেগে বুকের কচি চামরা ছিড়ে যায়। যেন গাছের বাকল ছিড়ে গেছে। কোনো রকম হরতকি ফল পেড়ে গাছ থেকে নামে সে। নেমে দেখে বুকের চামড়ায় হালকা রক্ত জমে আছে। এমনি কাছের কোনো ঝোপঝাড় থেকে চারপাশটা জংলি লতার পাতা ছিড়ে হাতের তালুতে ঘষে। ঘষার পর সেই পাতার রস লুকিয়ে বুকের চামড়ায় লাগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বুকে জলা ধরে। মুখ ক্ষিছে থাকে রতন। পাছে দাদু টের না পায়।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় দিনই একগাট্টি বকা-ঝকা ঝরে পড়ে রতনের কপালে। তাই যতটুকু পারে এই সব বকা আর ধমক থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় সে।
দাদু, অ দাদু। এক নিশ্বাসে ডেকে যায় রতন। লিচু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দেখে দাদু জমিনের একদম শেষ মাথায় নিচু হয়ে ধান খেতের আগাছা তুলছে। এবার আরো জুরে ডাক দেয় সে।
অ দাদু, রোগী আইছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আই অ।
এবার এই ডাকে দাদু মাথা তুলে রতনের দিকে তাকায়। দাদুর মাথা তোলা দেখে হাত নেড়ে আবার ডাকে। বাড়ি আইঅ রোগী আইছে।
ধুতিটা কোচা দিয়ে বর্ষার জমিনের জলে হাতটা ধুয়ে বাড়ি মুখি হয় দাদু।
কবিরাজ দাদুর বেশ নাম ডাক। কতরকম রোগী আছে। সব রকম রোগীরে অসুধ দেন। ঘরে একটা বড় বই আছে। আয়ুর্বেদী বই। এই বইটা প্রায়ই পড়েন দাদু। কখনো কখনো এইটা দেখে কোন জিনিসের কী পরিমাণ দিতে হবে তার হিসাব বলে দেন রতনকে। এই কাজ করতে করতে এক সময় পাকা হয়ে ওঠে রতন।
কবিরাজ দাদুর বরুড়া বাজারে একটা অসুধের দোকান আছে। বিকেল বেলা প্রায়ই দোকানে বসে রতন। রোগী আসলে লম্বা একটা টুলে বসায় তাদের। পাছে বলে, কবিরাজ দাদু একটু পড়েই আইব। আপনারা বইয়েন।
হাতাভাঙা কবিরাজ দাদুর চেয়ারে বসে রতন। চেয়ারে বসে নিজেকে কিছুক্ষণ কবিরাজ দাদু দাদু মনে করে সে।
টানাপোড়েন সংসার। কবিরাজী আর কৃষিকাজ করে বিশাল সংসার চালায় দাদু প্রফুল্ল। চারটা গরু আছে। দুটো দিয়ে হালচাষ করে। ওদের জন্য দৈনিক ঘাস জোগার করে আনে রতন। পাখিডাকা সকালে ঘুম থেকে ওঠে সে। তারপর একটা কাচি নিয়ে জমিনের আইলে আইলে ঘুরে। আইলের আশপাশ থেকে কচি ঘাস সংগ্রহ করে। এক ঝুকুন ঘাস হলে পুকুরে ধোয় সে। ধোয়া ঘাস গরুর গামলায় দিয়ে তারপর স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় রতন।
একদিন একটা গরু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাজারের ফার্মেসি থেকে গরুর জন্য অসুধ আনে দাদু। কিছুতেই অসুখ ছাড়ে না। দিন দিন খারাপের দিকে যায়। গরুটা কিছুই খাচ্ছে না। প্রায়ই গরুটার কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে রতন। গরুটাকে হাত বুলিয়ে আদর করে সে। কাঁঠালের বোথা, গরম মাড়ের জল খাবাতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু গরুটা কিছুতেই তাতে মুখ দেয় না। কেবল শোয়ে থাকে গরুটা। পাশে থাকা অন্য গরুগুলো ফেল ফেল করে অসুস্থ গরুটার দিকে চেয়ে থাকে। গরুটার প্রতি অত্যন্ত মায়া হয় রতনের।
এই গরুটার লেজ ধরে ধান ক্ষেতে কত না মই দিয়েছে। দুধও দিত বেশ। তার একটা মাত্র বাছুর। উঁচু বিছনা জমিনে সকাল-বিকাল বাছুরের সাথে কত না খেলা করেছে সে।
রতনের মা-বাবা অনেক দূরে থাকে। সেই চান্দুরার জগৎপুরে। মামার বাড়ি থেকে নব্বই মাইল দূর হবে। দু’ এক বছর পরপর মা আসে। বাপের বাড়িতে এসে ছেলে রতনকে দেখে যায়। মা যতদিন থাকে ততদিন রতনের কাছে মাকে পৃথিবী মনে হয়।
একদিন ছোটমামা তার মাকে নিয়ে আসে। এসেছে শুনে তার মনে অপার আনন্দের উচ্ছ্বাস উথলে ওঠে। কাউকে সে বলতে পারে না। এই আনন্দটা ভাগ করার মত নয়। দু’হাটুতে মাটি মেখে দৌঁড়ে আসে সে। দৌঁড়ে এসে ঘরের কোণে চুপটি করে দাঁড়ায় সে। মার প্রতি  মনে মনে একটু অভিমান হয় তার। ভাবে, এতো দিন পর আমার কথা মনে পড়ল মা। আমি যে সারাটা বছর তোমাকে ছাড়া এতিমের মত থাকি। উত্তরপাড়ার সুরুজ মামার ছেলে প্রায়ই আমাকে দেখে ভেঙচি দিয়ে বলে, অই রতইন্যা তোর মা নাই বাবা নাই। রতইন্যা এতিম, রতইন্যা এতিম। প্রথম প্রথম এই কথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে একদিন মারামারি করে রতন। বাড়িতে বিচার আসলে এই নিয়ে বড়মামা জিংলা দিয়ে চারপাঁচটা বারি দেয়। সেই থেকে মামার শাসনের ভয়ে এখন এইসব কথার প্রতিবাদ করে না সে।
খুশির সীমা থাকে না। মা এসেছে। এখন খেলাধুলা করতে ভয়-সংকোচ করে না সে। পাছে মায়ের মুখটি যে দেখতে পায় সে। ভিতরে ভিতরে একটা অদম্যশক্তি সঞ্চয় করে সে। কেউ কোনো কিছু বললে সাহসের সাথে উত্তর দেয়। কারণ মা যে আছে তার।
মা কাছে থাকাতে মামারাও শাসনের পরিমাণটা কমিয়ে দেয়। সেটা বুঝতে পারে রতন। কিছু একটা খেলে মায়ের আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে নেয়। মনে মনে একটা অপার প্রশান্তির সুখ অনুভব করে সে। এই মায়ের কথা চিন্তা করে রাতে শুয়ে কত না কান্না করেছে সে। কখনো কখনো কান্নার শব্দ হলে ছোটমামার ধমক দিতেন। পরে এই ধমকের ভয়ে চুপিচুপি কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না সে। ঘুম থেকে ওঠলে গালের দুধারে কান্নার শুকানো অশ্রু লেগে থাকত।
আজ কদিন হল মা এসেছে। ঘরে দাদু-দিদা কথা বলেছে মাকে এবার চান্দুরায় দিয়ে আসার জন্য। পড়ার ঘর থেকে কথাগুলো শুনে রতন। মা চলে যাবে শুনেই বুকটা যেন ভেঙে যায় তার। বুকের ভিতর হুহু করে ওঠে কষ্টগুলো। কিছুই বলতে পারে না। বোবা হয়ে যায় সে। ছোটমামা পড়া দিয়ে দিয়েছে তাকে। বই খোলা অবস্থায় ধীরে ধীরে রতনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মামা বলে, কিরে পড়চনি, পড়। হঠাৎ দু’ফোটা চোখের জল বইয়ের উপর গালবেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে জলটা মুচে নেয় রতন। পাছে মামা দেখলে আবার ধমক দিবে যে!
যে কদিন মা ছিল তার প্রতি রাতে মায়ের সাথে ঘুমিয়েছে সে। মায়ের গন্ধটা তার নাকে এখনো লেগে আছে। ছোটমামা একটা ট্রাংক নিয়ে রওনা হয়। রতনকে বুকে জড়িয়ে অঝোরধারায় মায়ের সেকি কান্না। রতনও ধুকড়ে ধুকড়ে কেঁদেছে। এক সময় মা-ছেলের কান্নার রেস থামতে না থামতে বাড়ি থেকে বের হয়। চেয়ারম্যানের পুলে একটা তেতুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় দিদার সঙ্গে রতন। মাকে গাড়িতে তুলে দিবে।  বাস আসবে। অপেক্ষার সময় মা বলে, বাবা দুষ্টুমি করিস না। মামাদের কথা শুনিছ। আমি আবার ক’দিন পর আইমুনে। রতন জানে মা এত তাড়াতাড়ি আসবে না। দিদা হাত দিয়ে ধরে রাখে রতনকে। ভে-পোঁ শব্দ করে একসময় বাস এসে থামে। মামা মাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। মা ভিড়ের ভিতর শেষবারের মত জানালা দিয়ে রতনকে একনজর দেখে নেয়। রতনও ঘার উঁচিয়ে মাকে দেখতে চায়। একসময় বাস চলে যায়। দিদা বাড়ি নিয়ে আসে রতনকে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে পুকুরে গিয়ে হাতমুখ ধোয় রতন। মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে গরু ঘরের দরজা খোলে সে। দেখে বাছুরের মাটা শুয়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নাই। হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় রতন। শ্বাস নেয় না গরুটা। তাড়াতাড়ি রতন দাদা দিদাকে জানায়। তারা এসে দেখে গরুটা মারা গেছে। এক সময় অনেকে মিলে মৃত গরুটাকে পুকুরের উত্তরপাড় বিছনা জমিনে নিয়ে ফেলে রাখে।
দাদু বাজারের এক মুচিকে গরুমরার খবর দেওয়ার জন্য পাশের বাড়ি জগদীশকে বলে। মুচি খবর পাওয়া মাত্র কালো কুচকুচে উদোম গায়ে এক মুচি লঙ্করঝঙ্কর একটা সাইকেল চালিয়ে আসছে। মৃত গরুটা জমিনে ফেলতেই কিছুক্ষণ পর আকাশে অনেকগুলো শকুন চক্কর দিতে থাকে। শকুনগুলো মাটিতে নামতে নামতেই মুচি এসে যায়।
তড়িঘড়ি সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটাকে দূরে ছুড়ে মারে সে। আর কোমর থেকে একটা ছুরী বের করে মৃত গরুটার উপর ছুড়ে মারে। ছুরীটা গরুর গায়ে পড়লে সে-ই হবে এই মৃত গরুর মালিক। এই ছিল মুচিদের গরুর চামড়া সংগ্রহের নিয়ম। সঙ্গে সঙ্গে মুচি দাঁতমুখ খিচে দ্রুততার সাথে মৃত গরুটার চামড়া তুলতে থাকে। কারণ পাছে যাতে অন্য কোনো মুচি ভাগ না বসায়।
মৃত গরুটার একটু দূরে বাছুরটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রতন। বছুরটা ফেল ফেল করে মৃত মা গরুটাকে দেখছে। বাছুরটার গলায় হাতবুলিয়ে, আজ থেকে তুইও আমার মত এতিম বলে রতন। এমন সময় দুটো শকুন ফত ফত করে ওড়ে যায় শূন্য আকাশে।


সৌম্য সালেক এর কবিতা
মাটির শিথানে
মানুষ এত কই যায়
পতনে দহনে স্খলনে
সমরে সংগ্রামেÑ
অনিবার;
অশে^-বিমানে-জলযানে...

মানুষ এত কই যায়
শোকে অসুখে অবসাদে
বিষ ও বিষাদেÑ
অবিকার;
অবিরোধ আত্মহননে...

মানুষ এত কই যায় প্রাণছুটে
কি আছে সেখানে
আছে কি ফাল্গুন, সূর্যমুখীÑ
বর্ণিল রঙের বেসাতি
আছে কি মেঠোপথ আনত নারীর মুখ
আছে কি পারাপার, ভাটিয়ালী
রাতের উজানে ভাসা চারণের বাঁশি
আছে কি নীলখামÑ প্রথম প্রেমের দ্বিধা
আছে কি মায়ের ছোঁয়া, কোমল রসনা