ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
সময়ের সাক্ষী একজন জিয়া ভাই
Published : Saturday, 25 December, 2021 at 12:00 AM
সময়ের সাক্ষী একজন জিয়া ভাইরেজাউল করিম শামিম ||
জিয়া ভাই,কুমিল্লার সাহিত্যিক-গবেষক তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। ওনার কাছে থাকা নানাধরনের বইয়ের বিরাট সংগ্রহশালার কারণেই ওনার এই পরিচিতি। ওনার পুরো নাম ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার একটি প্রখ্যাত গ্রাম বড় দেওয়ানপাড়া। আর সেই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর বাড়ির সন্তান জিয়া ভাই। এখানে বলে রাখা ভালো যে, তাহের উদ্দিন ঠাকুর পরিবারের সাথে জিয়া ভাইদের বংশগত কোন সম্পর্ক নেই। সরাইলে অনেক ঠাকুর পরিবার আছে।
জিয়া ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় বহু বছরের। সেই ‘৭৮-৭৯ সালের দিকে। সেসময়, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, নাট্য আন্দোলনের পাশাপাশি সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম। আমি ইমেজ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী বাছাইকৃত বিদেশি ছবির শো-গুলোতে কেবলমাত্র সদস্যদেরই উপস্থিত থাকার সুযোগ ছিলো। আয়োজিত শোতে নির্দিষ্ট সদস্যের উপস্থিতির নিশ্চিত করতে বিশেষ নিমন্ত্রণপত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌছে দিতে হতো। আর সেই পত্র পৌঁছাতে গিয়েই ওনার সাথে পরিচয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহের জন্য পুলিশ বিভাগের তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জিয়া ভাই হয়ে উঠেন অত্যন্ত নির্ভযোগ্য সেতুবন্ধন। তিনি তখন কুমিল্লা এসপি অফিসে কর্মরত ছিলেন। সেই অফিসেই আবার ডিআইও-ওয়ানের অফিসও ছিলো। আর এই অফিসটিও সংবাদের তথ্য প্রাপ্তিতে সোনার খনি বলা যায়। অবশ্য বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করতে পারা সাংবাদিকদের জন্য। কারণ অফিসটি পুলিশের গোপনীয় শাখা। তা যাই হোক পেশাগত কারণেও জিয়া ভাই হয়ে উঠেন আমরা ক‘জন সাংবাদিকের জন্য ঘনিষ্ঠ একজন।
সময়ের সাক্ষী একজন জিয়া ভাইএখানে একটি কথা বলে রাখা প্রাসঙ্গিকই হবে। সেসময় নানা কারণে প্রয়াত সাংবাদিক ও শিল্পী, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং স্নেহভাজন নওশাদ কবিরের সাথে তৎকালিন পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বিশেষ ঘনিষ্টতা ছিলো। পরে সে নিয়মিত সাংবাদিক হিসাবে কর্মকাণ্ড শুরু করলে জিয়া ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্টতা আরো নীবিড় হয়। নওশাদ ছাড়াও অন্যান্য সক্রিয় সাংবাদিকদের মধ্যে বন্ধু আলী হোসেন চৌধুরী, প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট‘দা, নুরুর রহমান বাবুল, তপন সেন গুপ্তসহ অনেকের সাথেই জিয়া ভাইয়ের নীবিড় সম্পর্ক ছিলো। আমরা একত্রেই সে অফিসে যেতাম। তবে পেশাগতভাবে আমাদের মধ্যে তথ্য সংগ্রহের গুরুত্বের ক্ষেত্রে একটা দারুণ প্রতিযোগিতাও ছিলো। আর তখনই এসে যায় জিয়া ভাইদের মতো তথ্য ভান্ডারের সাথে সম্পর্কের গভীরতার বিষয়টি। জিয়া ভাই সকলের অলক্ষ্যেই অনেক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন, জিয়া ভাইয়ের সহযোগিতার কথা ভুলবার নয়।
তারপর দীর্ঘ সময় জিয়া ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই। ইতিমধ্যে তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আর সেই সুযোগে তিনি নিজেকে বলতে গেলে বইয়ের পোকাও বানিয়ে ফেলেছেন। বলা যায় অবসর সময়টিকে তিনি বই সংগ্রহ আর পড়ার কাজে যথার্থভাবে ব্যবহার করছেন। অবশ্য এটা তিনি পেয়েছেন তার পারিবারিক ঐতিহ্যের পরিমন্ডল থেকেই। তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘ঠাকুর‘ পরিবারের সদস্য সংখ্যায় প্রচুর। তাদের অনেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ কৃতিত্বে অধিকারী। তাঁরা দেশের জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই রয়েছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
জিয়া ভাইয়ের দাদা ছিলেন, মঈন উদ্দিন ঠাকুর, তিনি মোগল ঠাকুর হিসাবেই সবার কাছে পরিচিত। সে অনুযায়িই জিয়া ভাইদের মূল বাড়িটির নাম ‘মোগলালয়’। তাদের সেই ঐতিহ্যবাহি পরিবারের অনেকেই দেশ-বিদেশে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সেসময় সেখানকার জমিদাররা হাতি পালতেন এবং হাতিই ছিলো তাদের বাহন। জিয়া ভাইয়ের পরিবারের একজন তার চাচা মফিজ উদ্দিন ঠাকুরের বৃটিশ আমলে বিয়ের সময় সে এলাকার জমিদার দেওয়ান বাড়ি থেকে হাতি দেয়া হয়েছিলো। আর হাতি চড়েই বরকে নিয়ে হবিগঞ্জের কনের বাড়িতে যাওয়া হয়েছিলো। এই হাতি নিয়ে একটি কাহিনীও রয়েছে। বলা হয়,ত্রিপুরার কোন এক রাজকুমার তিতাস নদীর পাড়ে শাহবাজপুরে এসেছিলেন শিকারে। তবে সরাইলের তৎকালিন জমিদার নূর মোহাম্মদের ছেলের তীরের আঘাতে যুবরাজ নিহত হয়।এ নিয়ে অনেক ঘটনার পর জমিদার নূর মোহাম্মদ তার ঘাতক ছেলেকে নিয়ে বিচারের জন্যে ত্রিপুরা রাজ দরবারে গিয়ে হাজির হন। এতে রাজা-রানী, পুত্রহত্যাকারী পিতার উদারতায় মুগ্ধ হন। ফলে, বিচারের পরিবর্তে উপহার প্রদান করে ছেলেসহ জমিদারকে সম্মানের সাথে সরাইল পাঠিয়ে দেন। সেই উপহার সামগ্রীর মধ্যে হাতিও ছিলো। আর ঐ এলাকাটি, যেখানে ত্রিপুরার যুবরাজ নিহত হন-তার নাম হয়ে যায় রাজামারাকান্দি। ঐ এলাকার ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধি নিয়ে এমনি আরো অনেক কাহিনী রয়েছে। তো জিয়া ভাইদের ঠাকুর পরিবারের অনেকেরই শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেশ আগ্রহ রয়েছে। তারই স্বাক্ষরবহ হলো ‘বন্ধন‘ নামের একটি ম্যগাজিন। পরিবারের সদস্যদের লেখার সম্ভার নিয়েই ম্যগাজিনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
আর ,আমাদের জিয়া ভাইয়ের আকর্ষণ বই পড়ার দিকে। যে কারণে তিনি অনেক বিষয়েই হয়ে উঠেছেন ‘জীবন্ত জ্ঞানকোষ‘। ওনার বইয়ের সংগ্রহ খুবই সমৃদ্ধ। বিশেষ করে বৃহত্তর কুমিল্লার ঐতিহ্য-ইতিহাস আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত বইপুস্তকের সম্ভার ঈর্ষা করার মতোই। যে কারণে তিনি এসব বিষয়ে গবেষণা বা লেখালেখির সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের তিনি নিয়মিতই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন। এটি খুবই দূর্লভ ঘটনা বর্তমান সময়ে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে জিয়া ভাইয়ের মতো বোদ্ধা পাঠক ও বই সংগ্রাহক আজকের দিনে বিরল। নতুন প্রজন্ম বেশির ভাগই বোধকরি ভার্চ্যুয়াল জগৎ নিয়েই থাকতে ভালোবাসে,তৎক্ষনিকতায়তেই সন্তুষ্ট বেশি। কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করা,আবেগ-বিবেক নিয়ে কোন কিছু বিবেচনায় প্রয়োজনীয়তা বোধ করে খুব কমজনই। অথচ সমাজে মতামত তৈরিতে, নৈতিক সমাজ গঠনে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তথা সচেতন মানুষের ভূমিকা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর এক্ষেত্রে পাঠের বিকল্প নেই। এ পটভূমিতে জিয়া ভাইদের মত লোকজনের প্রাসঙ্গীকতা খুবই জরুরী। দীর্ঘদিন থেকে জিয়া ভাই কিন্তু নীরবে তার ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
দুঃখজনক হলো, জিয়া ভাই তিল তিল করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে, বহু বছর ধরে বইয়ের যে সমৃদ্ধ ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন। তা বুঝি আর ধরে রাখা গেলোনা। তিনি নিজেই বলেছেন, তাঁর সংগ্রেহে থাকা বইগুলো সঠিক ভাবে সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সেগুলো তিনি বিলিয়ে দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই তিনি কুমিল্লার সরকারি গ্রন্থাগার, চুন্টা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি গ্রন্থাগার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি ইত্যাদি স্থানে বহু বই হস্তান্তর করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে জানালেন, কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণ পাঠাগারের দুরাবস্থার কথা। জানালেন সেখানে এখন হাতেগনা দু‘চারজন পাঠক দেখতে পাওয়া যায়। মূল্যবান বইয়ের সংগ্রহগুলো যথাযথ ভাবে সংরক্ষণে অভাবে বেহাল অবস্থা। তারপরও জিয়া ভাইয়ের ইচ্ছে সেখানেও কিছু বই দেয়ার। কিছুদিন আগে তিনি আমাকে একটি মূল্যবান বই উপহার দিয়েছেন। প্রায় এগারোশ পৃষ্ঠার মোটাসোটা বইটির হলো সুকুমার বিশ্বাসের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা দলিলপত্র‘।
কুমিল্লা গেলে দেখা হয় জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে। কথা হয় অনেক বিষয় নিয়ে। তিনি বরাবরই প্রগতীশিল এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার ধারক। কথায় কথায় তিনি জানান, কলেজে ছাত্র থাকাকালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। আর স্কুল জীবন থেকেই আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল ভাই,বাকের ভাই( সৈয়দ আহমাদ বাকের), হুমায়ুন ভাই (হুমায়ুন কবীর মজুমদার) ছিলেন ওনার ঘনিষ্ট বন্ধু। সেই সুবাদে তিনি সবসময়ই বিভিন্ন সভা সমাবেশে যাওয়া, বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সাথে  কথা বলতে, ঘনিষ্ট সম্পর্ক রাখতে পছন্দ করেন।
জিয়া ভাই পেশাদার লেখক নন। তারপরও তিনি প্রতিদিনই সমাজিক মাধ্যমে কিছু না কিছু লিখেন। তার বাইরে সময় সময় পত্রিকাতেও লিখেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। সেগুলোর সাহিত্য মূল্য বিবেচনার চাইতে তথ্য বিবেচনায় খুবই সমৃদ্ধ, তাতে কোন সন্ধেহ নেই। সমৃদ্ধ তথ্য ভান্ডার আর লেখালেখির জন্যে সম্ভবত তিনি ‘দৈনিক কুমিল্লার কাগজ’ সম্পাদক, বিশিষ্ট গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পুস্তক রচয়িতা আবুল কাসেম হৃদয়ের মনযোগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এ কারণেই পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগের সাথে তিনি যুক্ত রয়েছেন।
অত্যন্ত সহজ-সরল,সদা হাস্যজ্জ্বোল জিয়া ভাই খুব সহজেই যে কাউকে আপন করে নিতে পারেন। এমনি বিরল মনের অধিকারি জিয়া ভাইয়ের জন্মমাস হলো ডিসেম্বর মাস। এমাসের ২৫ তারিখে তিনি ‘৭০ বছরে পা রাখবেন। এই তৎপর্যময় সময়টিতে জিয়া ভাইয়ের দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবন কামনা করছি। আরো দীর্ঘদিন তিনি যেন তার অফুরান ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় তরতাজা তথ্যের নির্যাস বিলিয়ে যান, বইয়ের সুবাস ছড়িয়ে যান নতুন প্রজন্মের কাছে। যা বহমান থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। আর একারণে জিয়া ভাইদের সমাজে খুবই প্রয়োজন। তারা সময়ের সাক্ষী হিসাবেই বিলিয়ে যাবেন জ্ঞানের অমূল্য সম্পদ।