ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিশ্বশান্তি এবং ঈশ্বরের মহিমা
Published : Saturday, 25 December, 2021 at 12:00 AM
রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী ||
পুরাকালের ভাববাদীদের ভাববাণী সিদ্ধ হয়েছে যিশুখ্রিস্টের জন্মে। মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য ঈশ্বরীয় সত্য ও অনুগ্রহে পূর্ণ যিশুখ্রিস্ট পবিত্র আত্মার প্রভাবে কুমারী মরিয়মের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। পাপ স্বভাবহীন ঈশ-মানব বলেই তিনি পাপের অধীন মানুষের প্রায়শ্চিত্তের জন্য মুক্তিপণরূপে তাঁর জীবন দিয়েছেন। তাতেই পূর্ণ হয়েছে ঈশ্বরের প্রেম ও ধার্মিকতার মান। বড়দিনের বাণী তাই প্রেমময় ও পবিত্র ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সন্ধি বা মিলনের বাণী। বাস্তব জীবনে বিশ্বাসীর কাছে তা অন্য মানুষের সঙ্গে প্রেমে ও সম্প্রীতিতে থাকার আহ্বান জানায়। তাই বাইবেলে বলা হয়েছে যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সুখবর দরিদ্র রাখালদের কাছে স্বর্গদূতরা এই গানের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ঊর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁহার প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি’ (নূতন নিয়ম, লুক ২:১৪) । সেদিনের সেই স্বর্গীয় গানে ছিল মানুষের প্রতি স্রষ্টার প্রেম ও মহা অনুগ্রহের বাণী; তা ছিল আবার মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্মান ও সম্প্রীতির একটি আহ্বানও। যিশুখ্রিস্টের সময়ে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল পঁচিশ কোটির মতো। রোমান সাম্রাজ্যের সমস্ত লোকের প্রায় অর্ধেকই ছিল দাসপ্রথার শিকার। সেসব মানুষের অনেকেরই মানবাধিকার বলে কিছু ছিল না; আজও যেমন, তেমনি  দুর্নীতি, শোষণ, বিদ্বেষ ও ঘৃণায় মানুষের ব্যক্তি, সামাজিক ও জাতিগত জীবন ছিল নিষ্পেষিত। পৃথিবীতে শান্তি ও সম্প্রীতির ওপরে বড় বড় বিবৃতি ও বক্তৃতার শেষ নেই; কিন্তু প্রকৃত শান্তি ও স্বার্থহীন প্রেমের কাজ তেমন দেখা যায় না। কারণ প্রকৃত শান্তির জন্য যে ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন তার জন্য আমরা সবাই প্রস্তুত থাকি না।
পৃথিবীতে আজ প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা অন্য নানা রকমের সহিংসতার বলি হচ্ছে মানুষ, ধর্মের নামে হচ্ছে অধর্ম। পৃথিবীর নানা স্থান আজ নতুন নতুন ধর্মীয়, জাতিগত হিংসার আগুনে জ্বলছে; মিয়ানমারের আরাকানে ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত শুদ্ধিতার যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে চলেছে মানবতা; লক্ষ লক্ষ নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষের জীবন সীমাহীন অত্যাচারের শিকার হয়ে মানবেতর অবস্থানে নিপতিত। তাদের হেন অবস্থার শেষ কবে হবে, কবে সম্ভব হবে বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে স্বাভাবিক প্রত্যাবর্তন, তা আমরা জানি না।
মানুষ আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু সময় হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদের কতটুকু মানবীয় মূল্যবোধের উৎকর্ষ ও চর্চায় মানুষকে এগিয়ে দিচ্ছে আর কতটুকুই বা সেই মূল্যবোধকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা ভেবে দেখার। ক্ষমতাপন্ন ও সবলের অহংকার, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মানবতা লাঞ্ছিত; মূল্যবোধ আজ লঙ্ঘিত, ব্যক্তি পরিণত বস্তুতে।
মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও একমাত্র সার্বভৌম প্রভু একজনই, আমরা যে নামেই তাঁকে ডাকি না কেন, যেভাবেই তাঁকে বর্ণনা করি না কেন, তাঁর সব সৃষ্টি ও কাজ, সবই উত্তম ও পবিত্র। আমাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতা, অহংকার ও স্বার্থচেষ্টার কারণে আমরা ভেদাভেদের দেয়াল তৈরি করি, সৃষ্টির মধ্যে তৈরি করি অনাসৃষ্টি ও ধ্বংস। খ্রিস্ট আমাদের আহ্বান দেন, যেন আমরা তাঁর স্বর্গীয় পবিত্রতা ও আলোয় নিজেদের জীবনকে দেখি, আমরা যেন আমাদের ভেতরের অন্ধকার ও সংকীর্ণতা ত্যাগ করে নতুন মানুষ হতে উৎসাহিত হই। অন্যের জন্য, দুর্বল ও দুঃখীর স্বার্থে ত্যাগ স্বীকারে যথাসাধ্য করতে কুণ্ঠিত না হই। খ্রিস্ট ত্যাগ ও সেবা গুরু। তাঁর শিক্ষা, প্রথমে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে ও ভালোবাসতে হবে।  এ বছর বড়দিন পালিত হচ্ছে ‘করোনা’ নামক এক মহামারি-বিধ্বস্ত অবস্থায়। এ মারির আঘাতে লাখ লাখ মানুষ অকালে মারা গেছে, অংসখ্য পরিবার হয়েছে নিঃস্ব, গোটা মানবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জীবনের সমস্ত দিকেই। সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমরা কিছু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি যে ওই ঘাতক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা আবিষ্কার করার কাজে গবেষকরা অনেক এগিয়ে এসেছেন। করোনার কারণে আবার অনেক মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যও খুলেছে। অনেক ধনী আরো ধনী হয়েছে, দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত ও সমাজগতভাবে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। করোনা আমাদের আরো শিক্ষা দেয়, ঈশ্বরের সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার তার জন্য স্থায়ী কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না।  
ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সঙ্গে ও অন্য মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের পথে চলার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা। বড়দিনে স্বর্গের ঈশ্বর মানুষের কাছে এলেন যেন মানুষ ঈশ্বরের কাছে যেতে পারে, এবং মানুষ যেন যেতে পারে একে অন্যের কাছেও। আমাদের কাছে বড়দিনের চিরায়ত আহ্বান, যেন ঈশ্বরদত্ত আমাদের নৈতিক গুণাবলি, অর্থাৎ প্রেম, পবিত্রতা, ন্যায্যতা, আত্মিকতার বলে একে অন্যের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করার চেষ্টা করি। এতেই মানুষের জীবনে প্রকৃত শান্তি ও স্রষ্টার মহিমা। এখানেই তো বড়দিন! ত্রাণকর্তা খ্রিস্টের জন্মোৎসবের এ পুণ্যময় দিনে তিনি আমাদের সেই জীবনের দিকে চলার সদিচ্ছা ও শক্তি দান করুন! সব পাঠককে জানাই ‘শুভ বড়দিন!’
লেখক: খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক পুরোহিত ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ