জুলফিকার নিউটন ||
৩
দেবিদ্বার উপজেলার বারেরা গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজি পরিবারে আমার জন্ম। আমার জন্মদিন ইংরেজি মতে ১৪ই এপ্রিল ১৯৬৪। বাবা কাজি ছগির আহমেদ ও মা কাজি নুরজাহান। আট ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আমি হলাম পঞ্চম। আমার বড়ভাই প্রফেসর কাজী আবু তাহের (১৯৫১-২০২০) কুমিল্লা মহিলা সরকারি বিশ^বিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। দ্বিতীয় ভাই প্রফেসর ড. কাজী আব্দুর রউফ (১৯৫৪-২০২০) কানাডার টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং আমেরিকার হার্ভার্ড, প্রিন্সটন সহ বিশে^র একাধীক বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিটিং প্রফেসর ছিলেন। চতুর্থ ভাই প্রফেসর ড. কাজী মজিবুর রহমান (১৯৬০-২০২১) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের ডীন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি বিশ^ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (শান্তিনিকেতন) থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনের উপর উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করি অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর রবীন্দ্র গবেষক ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচের তত্ত্বাবধানে। পরবর্তীতে দেশ-বিদেশের একাধিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভিসিটিং প্রফেসর হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছি এবং পড়িয়েছি।
ছেলেবেলা থেকে দেখেছি আমাদের বাড়ি বোঝাই বই পুস্তক ছিল। এমন কোন ঘর ছিল না যেখানেই বই পুস্তকে ঠাসা ছিল না। বই পুস্তক সম্পর্কে এক রকম মায়া আর লেখাপড়ার আমেজ যেন বাড়ির আলো বাতাসে মিলিয়ে ছিল। আমার দাদা তার চেয়ে আমার বড় চাচা প্রয়াত কাজি আবদুল গফুরের বিদ্বান বলে খ্যাতি ছিল। বিদ্যার জাহাজ তাঁরা ছিলেন না তবে কিভাবে যেন বিদ্যাবত্তা এবং বিদ্যোৎসাহিত্যে তাঁদের সত্তার মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন। আমার বাড়ি বোঝাই বই পুস্তকের মধ্যে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বাইবেল ত্রিপিটক, গীতাও ছিল। ছেলেবেলায় আমার বাবা আমার মন্দির গির্জায় এবং প্যাগোডায় নিয়ে গেছেন। সেখানে আমি চোখ বুজে উপাসনাও করেছি, মন্ত্রপূত রুটি, পানি ও প্রসাদ খেয়েছি।
আমাদের বাড়িতে হুজুর মাওলানারা যেমন আসতেন তেমনি আসতেন ফকির যোগী ও কত রকম লৌকিক ধর্মের সাধু। তখন বুঝতে পারিনি এখন বুঝতে পারি যে মানুষকে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃষ্টান বলে বোঝানো যায় না। মানুষের ধর্ম কয়েকখানি ধর্ম শাস্ত্রে নিবদ্ধ নয়। ধর্মের অভিজ্ঞতা একটি নিত্র প্রবহমান অভিজ্ঞতা। বহতা নদীর সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলেছে মহাকালের রথের ঘোড়া। কোরআন, বাইবেল, ত্রিপিটক বেদকে ছাড়িয়ে গেছে মানুষের ধর্মোপলব্ধি। ধর্মশাস্ত্র পড়ে বা মসজিদে মন্দিরে গির্জায় প্যাগোডায় গিয়ে কতটুকু ধর্মেপলব্ধি হয়? জীবন্ত মানুষের সঙ্গে মিশে হয় তার চেয়ে বেশি। সব দেশের সব ধর্মের মানুষের কাছে আমি পেয়েছি তিল তিল করে আমার সত্য। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমার নিজের নিভৃত উপলব্ধি। একবার কলেজ জীবনে একবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার মানস নয়নে বিশ্ব সংসার আলোয় আলোকময় হয়েছে।
মানুষকে লেভেল দিয়ে সনাক্ত করা যায় না। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, পাকিস্তানী, ভারতীয়, ইংরেজ, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, প্রাচ্য, পাশ্চাত্ত্য, প্রাচীন আধুনিক, সভ্য অসভ্য, আর্য, অনার্য ইত্যাদি লেবেল দিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তারা পুরোপুরি পৃথক নয়। অমিল যত মিল তার চেয়ে বেশি। তাদের আটিস্টিক লেখা যায় হাত দিয়ে একবার হয়েছে সে কখনো সাধ করে আর কিছু লিখতে চাইবে না। গদ্যের সাধনা আর পদ্যের সাধনা দুটোই আর্টের সাধন। সংগীতের সাধনা। কিন্তু দু’ধরনের সাধনা। চেষ্টা করলে উপন্যাসও কবিতার মতো হতে পারে। কিন্তু সত্যিকার কবিতা গল্পও নয় উপন্যাস নয়-প্রবন্ধ তো নয়ই। আরো নিবিড় ও আরো গভীর উপলব্ধির ব্যঞ্জনা। অন্য দশ রকম বক্তব্য আছে। প্রবন্ধের পক্ষে সেটাই ভালো। কিন্তু কবিতা একবার যার হাত দিয়ে বেরিয়েছে সে জানে কবিতা লিখে যেমন তৃপ্তি সে পাবে, তেমন আর কোন কিছুতে নয়। তবে আমার কোনো রনাই ফরমাসি বা অর্থকরী প্রেরণা থেকে নয়। সেই জন্য গদ্যরনাও আমাকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে। যে স্বাদ পারমার্থিক। এক একটি সাধারণ প্রবন্ধ লিখেও আমি অনেক সময় নিজেকে পেয়েছি। যেটা লেখবার মতো লেখা, যে কথা বলবার মতো কথা তা সাহিত্যের যে কোনো বিভাগে স্থান পেলেও সাহিত্যে স্থান পায় ও পাঠক ইচ্ছে করলে তাকে চিরদিন মনে রাখতেও পারে। তো সমসাময়িক কোন প্রবন্ধ যুগোত্তীর্ণ হবে তা আমি বলতে পারিনা। মহাকাল বলবে।
আসলে একটি শব্দও এত শক্তিমান হতে পারে যে হাজার বছর ধরে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। একটি বাক্যের জন্যে হয়তো একটা যুগ অপেক্ষা করছিল, যেই ওটি উচ্চারিত হলো অমনি মানুষ পেয়ে গেলো তার ভাবনার কন্ঠস্বর। একটি আইডিয়াও ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচনা করতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে যেসব আইডিয়ার বীজ বুনে দেওয়া হয় সেসব সারা উনবিংশ শতাব্দীর ধরে কাজ করে।
শিল্পীকে যেমন করতে হয় গর্ভরক্ষা তেমনি মানবিকবাদীকে বা ধ্যানীকে করতে হয় বীজরক্ষা। চাষীরা যেমন বীজধান রক্ষা করে তেমনি আদর্শবাদীদেরও রক্ষা করতে হয় সেইসব আদর্শ যেসব পরে একদিন অঙ্কুরিত হবে। বিকশিত হবে, ফুটবে ও ফলবে। বীজধান একবার যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে কে জানে ক’শতাব্দী লাগবে তাকে ফিরে পেতে। ইউরোপের ইতিহাসে যেটাকে বলে অন্ধকার যুগ সেটা ছিল নষ্ট হয়ে যাওয়ার যুগ। যেটাকে বলে রেনেসাঁসের যুগ সেটা ফিরে পাওয়ার যুগ। আমাদের ইতিহাসেও কি তার অনুরূপ দেখা যায় না? পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের সংস্পর্শে এসে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী গত শতাব্দীতে রেনেসাঁস ঘটায়। সেটা মৌলিক নয় বলে বা জনগণের নয় বলে কম মূল্যবান নয়। তার রেশ এখনো মিলিয়ে যায়নি। তার সঙ্গেও আমরা অন্বয় রক্ষা করছি আরা একালের শিল্প ও ভাবুকরাও।
আমার প্রজন্মের লেখকদের প্রতিভায় আমি আস্থা রাখতে চাই, সৃষ্টি তারা সমানেই করে যাচ্ছেন। কিন্তু অভাব অনটন দাঙ্গা-হাঙ্গামা দুর্নীতি বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি মিলে যে নরক গুলজার করেছে তার থেকে পলায়ন করলে তাঁরা হবেন পলাতক, আর তার মধ্যে ডুব দিলে তাঁরা হবেন কালের করোট। এহেন পরিবেশে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। তবু আশা রাখতেই হবে। কারণ মানুষ হচ্ছে অমৃতের পুত্র। সে অবস্থার কাছে হার মানবে না। অবক্ষয়ের অভিযোগ ইউরোপেও উঠেছে। ওটা যুগলক্ষণ। দেশলক্ষণ নয়। সব দেশেই পুরনো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, অন্তর্জীবন হয়তো একই রকম। এসব লেবেলের মূল্য নেই তা নয়। কিন্তু অন্তর্জীবনে এসব লেবেল নিতান্তই বাহ্য। মানুষকে ভালোবাসলে তার স্বরূপ জানতে পারা যায়। মানুষ নিজেই একটা লেবেল মানুষ বলতে যা বোঝায় তার চেয়েও মানুষ বড়ো। সূর্য তারার সঙ্গে তার তুলনা। তার ভিতরেও জ্বলছে একই আগুন। তার বাইরেও সেই আলোর আভা। সেই জন্যে তাকে বলা হয়েছে অমৃতের সন্তান। সে এসেছে অমৃতলোক থেকে, যাবেও অমৃতলোকে। তার পরমায়ু যত হ্রস্ব হোক না কেন সে অমৃত।
পরবর্তী বয়সের নিবিড় অন্ধকারের মধ্যেও আমাকে বাঁচিয়েছে আমার নিজের সেই জ্যোতিময় ভিশন। সব মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু প্রত্যক্ষ উপলব্ধি কখনো মিথ্যা হতে পারে না। ইনটেলেক যেখানে পরাস্ত হয়েছে ইনটুহশন সেখানে শেষ রক্ষা করেছে। ইনটুলেকচুয়াল ডিসিপ্লিনের ভিতর দিয়ে গিয়ে ইনটুইশনকে আমি অবহেলা করেছি কিন্তু সংকটকালে সেই আমাকে ত্রাণ দিয়েছে। এর দ্বারা কি ইনটেলেকটকে খাটো করা হয় না। জাগতিক ব্যাপারের খাঁটিনাটি বুঝতে হলে ইনটেলেকটের উপর নির্ভর করতেই হয়। এটা আমি বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েই উপলব্ধি করি। যে সত্য চিরন্তন তার জন্যে ইনটুইশনই যথেষ্ট।
কিন্তু এ জগৎ যে পরিবর্তনশীল। যদি যে একালের মানুষ। কিন্তু আমি কি কেবল মানুষ? আমি কি প্রাণীজগতের একজন নই? তাই যদি হয়ে থাকি তবে আমার মধ্যেও ইনষ্টিংকট আছে। তার জন্যেও আমার জীবনে স্থান থাকবে। যেমন ইনটুইশন যেমন ইনটেলেকট তেমনি ইনষ্টিংকট ও আমার পত পদর্শক। হয়তো মাঝে মাঝে ভুল পথে নিয়ে যাবে, বিভ্রান্ত করবে। পতনের ও সম্ভাবনা থাকবে। তা বলে জীবনের থেকে বাদ দেওয়া যায় না। দিলে হয়তো আরো বড়ো ভুল হবে। আরো বড়ো বিভ্রম ঘটবে। আরো বড়ো পতন সম্ভবপর। শান্তি নিকেতন রবীন্দ্রদর্শনে উচ্চতর গবেষনার সময় উপলব্ধি করি বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।
সাধারণত পিতার ধর্ম পুত্রে বর্তায়, পুত্রের ধর্ম তার পুত্রে। এইভাবে এক পারিবারিক ধারাবাহিকতা যেমন থাকে, আবার এমনও দেখা যায় যে গুরুর ধর্ম শিষ্যে বর্তায়, শিষ্যের ধর্ম তাঁর শিষ্যে এইভাবে একটা পরিবার বর্হিভূত পরস্পরাও গড়ে ওঠে। আমার বাবা ছিলেন পারিবারিক সূত্রে ধার্মিক, কিন্তু গুরু শিষ্য পরস্পরা সূত্রে মিষ্টিক। পারিবারিক ধারাবাহিকতা মানতে গেলে আমাকে ধার্মিক, কিন্তু গুরু শিষ্য পরস্পরা সূত্রে মিষ্টিক। পারিবারিক ধারাবাহিকতা মানতে গেলে আমাকে ধার্মিক হতে হয় আর পরিবার বহির্ভূত পরস্পরা মানতে গেলে আমাকে হতে হয় মিষ্টিক। কিন্তু আত্মার মুক্তি বা মোক্ষ বা নির্বাণ বা শ্যালভেশন বা পরমাত্মার সঙ্গে যুগল মিলন একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
পিতার ধর্ম অবলম্বন করে আমার আত্মার পরিণাম কী হবে তা আমি কেমন করে নিশ্চিতভাবে জানব, অথবা গুরুর পন্থা অবলম্বন করে আমার আত্মা শেষ পর্যন্ত কোতায় উপনীত হবে তাই বা নিশ্চিত করে বলতে পারে কে? এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাসে মিলায় খোদা, তর্কে বহুদূর। প্রত্যেকটি ধর্মই মানুষকে বিশ্বাস করতে বলেছে, তর্ক করতে বলছে না। একমাত্র ব্যতিক্রম বোধ হয় বৌদ্ধধর্ম, কিন্তু সেই ধর্মও কালক্রমে বুদ্ধনং শরফ’ গচ্ছামিতে পরিণত হয়েছে। যদিও গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং বলে গেছে, আত্মদীপোভব”।
আমি মনে করি অন্য একজনের কাছ থেকে বিশ্বাস ধার করার চেয়ে প্রকৃত সত্য কী তা জানার জন্য অনবরত প্রশ্ন করাই শ্রেয়। সত্যের অন্বেষণই ধর্মের অন্তঃসার, তার সঙ্গে যোগ করতে পারি প্রেমের ও সৌন্দর্যের অন্বেষণ, অধিকন্তু যোগ করতে পারি ন্যায়ের অন্বেষণ। এই সাধনার দায় নিতে হয় প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে। একজনের সঙ্গে অপরজনের মতের মিল হতেও পারে। নাও হতে পারে। যেমন ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, পিতার সঙ্গে পুত্রের, গুরুর সঙ্গে শিষ্যের মতভেদ। বা মতবিরোধ সম্ভবপর সেটা অন্যায় কিছু নয়।
তারপর আমি কি কেবল একালের? কেবল এদেশের? পরমাত্মার মতো অন্তরাত্মাও ও নিরুপাধিক। তাকে দেশচিহ্নিত বা কালচিহ্নিত করা যায় না। আমার যে সত্যিকার আমি তার না আছে জন্ম না আছে মরণ যে নিত্য বর্তমান ও বহমান। স্পেস টাইমের ভিতর দিয়ে চলেছে, তা বলে স্পেস টাইমের এর ভিতরে সে নিবদ্ধ নয়, স্পেস টাইমের উর্ধ্বেও সে আছে, বাইরেও সে আছে।
চলবে...