রণবীর ঘোষ কিংকর / শাহীন আলম ||
‘যারা
নৌকা করে তারা রাজাকারের বাচ্চা, কি করবেন রাজনীতি কইরা? যে দেশে টাকা
দিলে নমিনেশন হয়, যে দেশে টাকায় মন্ত্রীত্ব পাওয়া যায়, যে দেশে টাকা দিলে
সব আকাম কু-কুকাম শেষ হয়’। এভাবেই আওয়ামী লীগ রাজনীতি ও নেতা-কর্মীর উপর
ক্ষোভ ঝেড়ে এক বিএনপি নেতার সাথে ফোন আলাপ করছিলেন কুমিল্লা উত্তর জেলা
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
ওই কথোপকথনের মাত্র ৪/৫ দিনের মধ্যে সোমবার
(২৭ ডিসেম্বর) রাত অনুমান ৮টার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে
তাদের ওই ফোন রেকর্ডটি ছড়িয়ে পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যে ভাইরাল হয়।
এতে শোনা
যায়, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার ও
দেবীদ্বার উপজেলা বিএনপি নেতা সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমিন
বর্তমান সময়ের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। ফাঁও হওয়া প্রায় এক মিনিট ৪০
সেকেন্ডের ফোন রেকর্ডের প্রায় সবটুকু জুড়েই ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতি,
টাকার বিনিময়ে নমিনেশন বাণিজ্য প্রসঙ্গ। এছাড়া কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায়
বিএনপি নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হয়ে মাঠে নামতে পরামর্শ ও সহযোগিতা করার
প্রতিশ্রুতি।
৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ
সাধারণ সম্পাদকের মুখে আওয়ামী লীগ ও দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি এমন মন্তব্যে
হতবাক হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
টানা
১ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে তিনি বলেন, ‘আগে একজনকে দিয়ে সরাইতে
হবে। দেবীদ্বারে কই? কোন বিএনপি নেতা বাহির হইতে পারতাছে এখনও। আপনারা
মিছিল মিটিং করেন, আমি সুযোগ করে দেই। অসুবিধা কি? আপনারা মিছিল-মিটিং
করেন, তাইলেই তো বুঝবো আপনারা রাজনীতি করেন। আপনারা সময় আইলে একটু ইয়া
করেন। এটা তো হবে না। রাজনীতি করতে গেলে নেতৃত্ব দিতে হবে, আর নেতৃত্ব দিতে
গেলে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে। আপনারা বিরোধীদল শক্ত না দেইখাই তো
মামলা-হামলার ভয়ে মাঠে নামেন না। আমাদের এক চেটিয়া কি একটা দেশ চলে? বিরোধী
দল সব সময় স্ট্রং থাকতে হয়’।
এসময় বিএনপি নেতা রুহুল আমিন হাসি দিয়ে
বলেন, ‘দেশ তো চলতাছে এক চেটিয়াই।’ উত্তরে তিনি বলেন, আপনি যদি সুযোগ দেন,
কথাটা বুইঝেন, আপনি যদি গ্রামের শক্তিশালী হন, তাহলে নিরীহরা তো কথা না
বললে গ্রামে যা ইচ্ছা তাই হবে। দেশে অপকর্ম হবে। ভাল কাজ কি ভাবে হবে বলেন।
দেশের আজকের এই অধপতনের জন্য দায়ী হলো আপনাদের বিরোধী দল। যারা নৌকা করে
তারা রাজাকারের বাচ্চা।’
উত্তরে অট্টহাসি দিয়ে বিএনপি নেতা রুহুল আমি বলেন, ‘আমি শেষ হয়ে হয়ে গেছি, এই টুকুই বললাম’।
এসময়
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার বলেন, ‘আমারে বলতে
হইবো না। এখনও ...... (বাজে শব্দ উচ্চারণ করে বলেন) রাজনীতি ছাড়েন। কি
করবেন রাজনীতি কইরা? যে দেশে টাকা দিলে নমিনেশন হয়, যে দেশে টাকা
মন্ত্রীত্ব পাওয়া যায়, যে দেশে টাকা দিলে সব আকাম কু-কুকাম শেষ হয়’।
এ
ব্যাপারে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার জানান, গত
৪/৫দিন আগে বিএনপি নেতা রুহুল আমিন একটি কাজে আমাকে ফোন করেছিল। এসময়
প্রায় ১০ মিনিট তার সাথে আমার কথা হয়। ওই সময় দেবীদ্বারের রাজনীতি নিয়ে কথা
বলেছিলাম। গত উপজেলা পরিষদ উপ-নির্বাচনে বর্তমান এমপি রাজী মুন্সির
কেন্দ্রে নৌকা ফেইল করে। ওই ক্ষোভে কিছু কথা বলেছিলাম। কিন্তু সেগুলোকে
এডিট করে দেড় মিনিটের অডিও আজ (সোমবার) সন্ধ্যার পর ফাঁস করে। উপজেলা
পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ওমানী কাশেম ফেইসবুক আইডি থেকে প্রথম
অডিওটি ফাঁস হয় বলে তিনি দাবী করেন।
কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ
সভাপতি মু. রুহুল আমিন জানান, আওয়ামী লীগের এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে
তার এমন বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখ জনক। আর ফোন রেকর্ডটি ছিল তার একান্ত মতামত।
তার ওই মতামতের সাথে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ দ্বিমত।
আমরা ওই ফোন রেকর্ডের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে অবহিত
করেছি। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ করবো।
দেবিদ্বার উপজেলা
পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো.আবুল কাশেম ওমানী বলেন, দলের এতো বড় একটি পদে
থেকে তিনি আওয়ামীলীগ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন
হয়েছে। আমরা তৃণমূল নেতা কর্মীরা তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাই।
কুমিল্লা
উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহসভাপতি সাবেক এমপি ও মন্ত্রী এবিএম গোলাম
মোস্তফা বলেন, বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তা হলে
খুবই দুঃখজনক। আমি খোঁজ নিচ্ছি।
এ বিষয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান
রুহুল আমিন বলেন, রোশন ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইলে খোলামেলা কথা হয়েছে, সব কিছুই
যদি ফাঁস হয়ে পড়ে, তাহলে কীভাবে কথা বলব? তিনি বলেন, আমার মাধ্যমে এ অডিও
ফাঁস হয়নি। কীভাবে হয়েছে তাও জানি না। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের কথা
হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ
সম্পাদক একেএম মনিরুজ্জামান মাস্টার বলেন, ওনি দায়িত্বশীল পদে থেকে এভাবে
কথা বলতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাচাই বাছাই করে মনোনয়ন দেন।
তার বক্তবে শুনে মনে হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টাকা দিয়ে মনোনয়ন দেন। তার
এমন বক্তব্যে আমরা মর্মাহত ক্ষুব্ধ। অবিলম্বে তার বহিস্কার চাই।
ফোনালাপ
প্রসঙ্গে রোশন আলী মাস্টার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, সম্প্রতি আমার
সঙ্গে দেবিদ্বারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা রুহুল আমিন
সাহেবের ফোনালাপ হয়। ফোনে তিনি অভিযোগ করেন, তাদের আওয়ামী লীগ কোনো স্পেসই
দেয় না। আমি এর উত্তরে বলেছি, আপনারা আন্দোলন করেন না, এলাকায় না এসে শুধু
অভিযোগ করেন। এটি শুধু আমার বক্তব্য না, আমার দলের জেনারেল সেক্রেটারি
ওবায়দুল কাদের সাহেবও অসংখ্য বার বিরোধী দলের এরূপ ভিত্তিহীন অভিযোগের
জবাবে এ কথা বলেছেন, যা নির্ভেজাল সত্য। এছাড়া সম্প্রতি দেবিদ্বারে সুযোগ
সন্ধানি কিছু লোক আওয়ামী লীগে যোগদান করে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি করে
বেড়াচ্ছেন, তাদের আমি রাজাকার বলেছি, এখনও বলব।