শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
ইত্তেফাক, রবিবার, ২৪ পৌষ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ
‘আমার সোনার বাংলা আজ মুক্ত ও স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী।’
বঙ্গবন্ধু এখন লণ্ডনে।
বলেন-
১. ‘বাংলাদেশের নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা দায়ী। হিটলার যদি আজ বাঁচিয়া থাকিত, বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডে সেও লজ্জা পাইত।’
২. ‘আমি আমার দেশবাসীর কাছে ফিরিয়া যাইতে আর এক মুহূর্ত দেরি করিতে পারি না।’
৩. ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করিতেছি। এই মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমি যখন লৌহকারার অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি অবস্থায় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিবার প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, তখন আমার দেশবাসী আমাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেণ্ট বলিয়া ঘোষণা করেন।’
৪. ‘সাবেক প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করিয়া আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইবার ফন্দি আঁটিয়াছিল। কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করিতে অস্বীকার করেন।’
৫. ‘দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে যে কঠিন মূল্য দিতে হইয়াছে, পৃথিবীর আর কোথাও মানুষকে এত বেশি মূল্য দিতে হয় নাই।’
৬. ‘প্রেসিডেণ্ট ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন। আমি তাহাকে বলিয়াছি যে, আমি আমার দেশবাসীর নিকট ফিরিয়া না যাওয়া পর্যন্ত আমি কোন কিছুই বলিতে পারিব না।’
৭. ‘আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমি বেঁচে আছি এবং ভালোই আছি।’
৮. ‘হ্যালো, তাজউদ্দীন, আমার দেশবাসীরা কেমন আছে? আমি এখন সাংবাদিকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত, আমি তাঁদের কাছে কী বলব, আমার প্রিয় দেশবাসীরা কেমন আছে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কি আমার দেশবাসীকে হত্যা করেছে?’
৯. বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ‘তোমরা কি সবাই বেঁচে আছো?’
১০. শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে- ‘আমি ভালোই আছি, আমি আপনার নিকট একান্ত কৃতজ্ঞ।’
দৈনিক বাংলা
১১. ‘মরার জন্য মনের দিক থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম। যেদিন জেলে নেয়া হলো তখন আমি বাঁচবো কি-না ধারণা ছিল না। তবে, এটা জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই।’
১২. ‘মুক্তি সংগ্রামের বিজয়কে আমি পরম আনন্দে অনুভব করছি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই যে সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল।’
আজাদ
শেখ মুজিব ও বেগম মুজিবের কথোপকথন।
বেগম মুজিব : কেমন আছ?
বঙ্গবন্ধু : তুমি কেমন আছ?
বেগম মুজিব : তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে এসো।
উপর্যুক্ত কথাগুলো বঙ্গবন্ধু ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, শনিবার লণ্ডন পোঁছে বিভিন্ন অবস্থায় বলেছেন।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২, রবিবার বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসছেন, বাংলাদেশের জনগণ, তাঁর পরিবার এবং ভারতে অবতরণ করার পর কী কী আনুষ্ঠানিকতা হবে- এ বিষয় বিস্তারিত আবেগপূর্ণ সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল পত্রিকাগুলোতে। বঙ্গবন্ধু রবিবার গ্রিনিচ সময় সকাল ৮.৫০ মিনিটে বাংলাদেশ সময় দুপুর ২.৫০ মিনিট ব্রিটিশ বিমানবাহিনির একটি কমেট বিমানযোগে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে লণ্ডন ত্যাগ করেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সকাল ৮.৩২ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
১১ জানুয়ারি ১৯৭২, মঙ্গলবার
ইত্তেফাক
বঙ্গবন্ধু বলেন-
১. ‘ভারতের জনসাধারণ আমার জনসাধারণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু।’
২. ‘আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় আমি ফিরিয়া যাইতেছি।’
৩. ‘আমার দেশবাসীকে যখন আমি ছাড়িয়া যাই, তখন তাহারা কাঁদিতেছিলেন এবং আমি যখন কারাগারে ছিলাম, তখন তাহারা যুদ্ধ করিতেছিলেন। কিন্তু এখন আমি আমার দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের বিজয়ী হাসির মাঝ্যে ফিরিয়া যাইতেছি- ফিরিয়া যাইতেছি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে।’
৪. ‘বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি ভারতের জনগণ যে সহানুভূতি প্রদর্শন করিয়াছে, তাহা অবিস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।’
সংবাদ
৫. ‘বাঙালিরা ভালোভাবে বাঁচিয়া থাকিতে চাহিয়াছিল। ইহার প্রত্যুত্তরে তাঁহারা বুকে পাইয়াছেন বুলেট। বাংলাদেশ এশিয়ার বুকে এখন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারত এবং বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর সম্পর্ক হইবে চিরস্থায়ী।’
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টা ১০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লি ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৬০ মিনিট নয়াদিল্লিতে অবস্থান করেছিলেন। দুপুর ১ টা ৪০ মিনিটে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। সময় ১টা ৪১ মিনিট। বাংলার ইতিহাসের চিরপ্রতীক্ষিত স্বপ্নের রাজপুত্র বিমানের ভিতর থেকে বাইরে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালেন। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুর ট্রাকটি ২টা ৩৫ মিনিটে রওয়ানা হয়ে ৪টা ২৫ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে প্রবেশ করে। ১০ জানুয়ারি সংবাদ সমূহ ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ পত্রিকায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল।
ইত্তেফাক
১. ‘আমি জানতাম না বাংলার মাটি আর মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, আমার স্বপ্ন সফল হইয়াছে। কিন্তু আমার বহু ভাইকে আমি আর এ জীবনে দেখিতে পাইব না। ... তাদের এই রক্তদান বিফলে যাইবে না- যাইতে দেব না।’
২. ‘বাঙালি আজ স্বাধীন। তবে এই স্বাধীনতা সার্থক হইবে না যদি আমার কোন ভাই ভাত খাইতে না পায়, যদি আমার যুবক ভাইয়েরা বেকার থাকে।’
৩. ‘সোনার বাংলার মানুষ আবার হাসিবে খেলিবে, সোনার বাংলার মানুষ পেট ভরিয়া ভাত খাইবে-ইহাই আমার কাম্য।’
৪. ‘এই বর্বর নরপিশাচ বাহিনী বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করিয়াছে।’
৫. ‘আমি জানিতাম না যে, আমি বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর জিন্দানখানা হইতে ফিরিয়া আসিতে পারিব। আমার কবরও তাহারা তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছিল। আমি তাহাদের শুধু একটি অনুরোধই করিয়াছিলাম-আমার লাশ বাংলাদেশে ফিরাইয়া দিও।’
৬. তুমুল করতালির মধ্যে বলেন- ‘আমার সোনার বাংলার আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ‘সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করো নি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘বাঙালি আজ স্বাধীন হইয়াছে-তাহারা মানুষ হইয়াছে।’
৭. ‘যাহারা বাংলা জানে না, তোমাদের বলিতেছি, তোমরা আজ হইতে বাঙালি হইয়া যাও।’
৮. ‘বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হইলেও ইহা হইবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’
পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে বলেন-
৯. ‘তোমরা স্বাধীন, আমরাও স্বাধীন। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবেই তোমাদের সহিত আমাদের সম্পর্ক থাকিবে।’
১০. শেখ কামালকে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে বলেন- ‘কামাল, তুমি শহীদ হইলেই খুশি হইতাম।’
পরিশেষে বললেন-
১১. ‘আমি আগে যেমনটা ছিলাম সেই শেখ মুজিবুর রহমান নেই। আজ আমি ক্লান্ত। আজ আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। আরেকদিন আপনাদের সামনে বক্তৃতা করব।’
উপর্যুক্ত বক্তব্যসমূহ ১১ জানুয়ারি ১৯৭২, মঙ্গলবার পত্রিকায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল।
স্বভাবতই কৌতুহল আগে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, সোমবার বঙ্গবন্ধু আগমনে জনগণের মনের অবস্থা বা অভিব্যক্তি কিরূপ ছিল?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ক্যান্টেনমেন্টের প্যারেড গ্রাউণ্ডে আয়োজিত এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে সংর্বধনা জানিয়ে বলেন- শেখ মুজিবের দেহ কারাপ্রাচীরের অন্তরালে থাকলেও তাঁর আত্মা সদাজাগ্রত হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য তাঁর দেশবাসীকে অনুপ্রেরণা দান করেছে।
আরও বলেন- ‘তাঁহার জনগণ ও পরিবারের কাছে ফিরিয়া যাইতেছেন।’
রেসকোর্স থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এই দু’মাইল দীর্ঘ পথে হাজার হাজার লোক সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তার দু’পার্শ্বে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জনগণের হাতে থাকে নেতার জন্য মালা আর পুষ্প। নেতা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্সের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে রাস্তার দু’পার্শ্বের বিভিন্ন বিল্ডিং থেকে নেতার গাড়ির উপর পুষ্পগুচ্ছ বর্ষণ ও গোলাপজল ছিটিয়ে দেয়। হিন্দু মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে উলুধ্বনি করে স্বাগত জানায়। জনতার কণ্ঠে স্লোগান-
১. জয় বাংলা
২. বিশ্বের এলো নতুনবাদ-মুজিববাদ মুজিববাদ।
৩. বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
৪. সমাজতান্ত্রিক নয়া দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
৫. কাস্তে-কোদাল নিতে হবে-বাংলাদেশ গড়তে হবে।
৬. সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ-নিপাত যাক।
অসংখ্য মিছিল রেসকোর্স ও বিমানবন্দরের দিকে হাঁটতে থাকে। অনেকে বিভিন্ন ধরনের রঙিন ও বিচিত্র পোশাক পরিহিত হয়ে ব্যাণ্ড বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে রেসকোর্সে যায়।
একজন সাংবাদিক লিখেছেন-
‘আনন্দ-পাগল জনতার দিকে একবার তাকাইলাম। সকলেই গগন-বিদারী স্লোগান দিয়া চলিয়াছেন। অনেকে হাততালি দিতেছেন। কেহ-বা আনন্দে নৃত্য শুরু করিয়া দিয়াছেন।’
করিমন-বিবি, যাঁর দু’ছেলে হানাদার বাহিনির হাতে নিহত হয়েছে। তিনিও এসেছেন। তিনি বলছেন- ‘আমি আইছি যার লাইগা ছেলেগ পাডাইলাম যুদ্ধ করতে তারে এক নজর দেইকা যাইতে। কোন সুময় আইব। তারে দেকলে আমার সব দুক শেষ অইব।’
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ধানমণ্ডির ১৮ নং রোর্ডের বাড়িটির পরিবেশ কেমন ছিল?
প্রথম ছবি-
ভোরবেলা। ছোট-বড়ো বহু আকারের মিছিল এ পথ দিয়ে বয়ে গেল। সবাই আনন্দে বাক্যহীন।
দ্বিতীয় ছবি-
দুপুর একটা। লোকের তেমন ভিড় নেই। তখন সবাই বিমানবন্দরে রাস্তার দু’পাশে। বাড়ির ভেতরে লোকজন আছে, এমন মনে হলো না। থাকলেও খুব সম্ভব এখন আয়োজনে ব্যস্ত।
তৃতীয় ছবি-
শেষ বিকেল। বঙ্গবন্ধু এলেন এই অপরিচিত বাড়িতে (১৮ নং রোডের বাড়িতে, ৩২ নং-এ নয়)। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসুস্থ বৃদ্ধ লাঞ্ছিত বাবা-মার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। শিশুর মতো কাঁদতে থাকলেন জাতির পিতা। বেগম মুজিব, তাঁর ছেলেমেয়ে সবাই কাঁদছে কোরাসে।
চতুর্থ অদেখা ছবি-
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকলকে নিয়ে একটি কক্ষে প্রবেশ করলেন। দরজাটি বন্ধ হয়ে গেলো। আর শোনা গেল বাক্যহীন সমবেত কান্নার মিহি সুর। তাতে আনন্দ ও বেদনা মিশ্রিত অপ্রত্যাশিত পরিপূর্ণ নির্ভার ধ্বনি।
এক অনন্য স্মৃতিময় ঐতিহাসিক ঘটনা। যা বাস্তব, স্বপ্ন নয়।
[পুন: প্রকাশ]