প্রভাষ আমিন ।।
সমুদ্রের ঢেউ তো সবাই দেখেছেন। বড় বড় ঢেউ আসে, তারপর তীরে এসে মিলিয়ে যায়। শান্ত সমুদ্রে ছোট হলেও ঢেউ থাকে। তবে অশান্ত সমুদ্রের ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে জলোচ্ছ্বাস, যা ভাসিয়ে নিতে পারে জনপদ। কখনও সুনামি এসে মুহূর্তেই লন্ডভন্ড করে দিতে পারে সবকিছু। করোনার আচরণ অনেকটা সমুদ্রের মতো। ঢেউয়ের মতো করে আসে, আবার মিলিয়ে যায়; কখনও জলোচ্ছ্বাস আবার কখনও সুনামি হয়ে ভাসিয়ে নেয় সবকিছু। ২০১৯ সালের শেষ দিনে চীনের উহানে ধরা পড়া করোনাভাইরাস গত দুই বছরের বেশি সময়ে গোটা বিশ্বকেই প্লাবিত করেছে। করোনার ঢেউ একেক সময় একেক এলাকাকে ভাসিয়ে নিয়েছে- কখনও জলোচ্ছ্বাসের মতো, কখনও সুনামি হয়ে। এই দুই বছরে করোনা বারবার তার রূপ বদলেছে। এখন গোটা বিশ্ব করোনার ওমিক্রন ধরনে আতঙ্কিত।
করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিপদটা হলো, এটা দ্রুত ছড়ায়, একেবারে সুনামির মতো ভাসিয়ে নেওয়ার মতা তার। ওমিক্রন ধরনটি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আগামী ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপের অর্ধেক মানুষ অমিক্রনে সংক্রমিত হতে পারেন। তবে বলা হচ্ছে, ওমিক্রন দ্রুত ছড়ায় বটে, তবে এটা ততটা প্রাণঘাতী নয়। ভারতের শীর্ষ রোগতত্ত্ববিদ জয় প্রকাশ মৌলিল বলেছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ সাধারণ ঠান্ডা জ্বরের মতো। আগের মতো ভয়ংকর নয়। তবে তিনি এটাও বলেছেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। প্রায় সবাই ওমিক্রনে আক্রান্ত হতে পারেন।
বাংলাদেশ বরাবরই করোনাভাইরাসের ব্যাপারে একটা প্রাকৃতিক সুরা পেয়েছে। ভাইরাসটি একটু দেরিতেই বাংলাদেশে এসেছে। এমনকি ওমিক্রনের ঢেউও বাংলাদেশে এখনও সেভাবে ছড়ায়নি। আবার করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য কিছুটা ব্যতিক্রমী ও রহস্যজনক। করোনার একের পর এক আঘাতে বিশ্বের উন্নত অনেক দেশ যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখনও বাংলাদেশ বেশ স্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি দেশে করোনা অনেক দ্রুত ছড়ানোর শঙ্কা থাকলেও তুলনামূলক বাংলাদেশ সুরতি ছিল। করোনার আগমন কিছুটা বিলম্বিত করতে পারার মধ্যে এ সাফল্যের অনেকটা লুকিয়ে ছিল। সরকারের নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রকৃতির কিছুটা রহস্যজনক আশীর্বাদও পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশের সামনে সেই সাফল্য ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বের অনেক দেশ এরইমধ্যে ওমিক্রন মোকাবিলায় ব্যস্ত। বাংলাদেশেও করোনার সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে, যদিও ওমিক্রন এখনও বাংলাদেশে তার থাবার বিস্তার ঘটাতে পারেনি। তবে সরকার এরইমধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত সোমবার ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে। যা কার্যকর হবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে। বাংলাদেশ এর আগেও বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন দেখেছে। তাই নতুন করে জারি করা বিধিনিষেধ আসলে নতুন কিছু নয়। এগুলো হলো, করোনা থেকে নিজেদের রার মৌলিক বিধি। করোনা থেকে বাঁচতে হলে এই বিধিনিষেধগুলো আসলে আমাদের সবসময়ই মেনে চলা উচিত।
একটা কথা আগেও বলা হয়েছে, করোনার আগের বিশ্ব আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না। আমাদের সবাইকেই নিউ নরমাল লাইফে অভ্যস্ত হতে হবে। সরকার বলুক না বলুক, অন্য পোশাকের মতো মাস্ককেও আবশ্যিক পোশাক বানিয়ে ফেলতে হবে। ১১ দফা বিধিনিষেধ আসলে নতুন কিছু নয়। তবু কিছু অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। যেমন উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে, উন্মুক্ত স্থানে করা না গেলেও বন্ধ স্থানে করা যাবে। কিন্তু সবাই জানেন, খোলা জায়গার জনসমাবেশের চেয়ে বন্ধ স্থানে সমাবেশ বেশি বিপজ্জনক। আসলে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের জনসমাবেশ বন্ধ রাখতে হবে। তবে এখন হলো পর্যটন মৌসুম। এছাড়া বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, নির্বাচনও এ মৌসুমে বেশি হয়। তাই সব ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, টিকাও ওমিক্রন সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। তবু নতুন বিধিনিষেধ টিকার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যাপ্ত টিকা আছেও। এখন পর্যন্ত শিা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্তই বহাল। তবে টিকা ছাড়া শিার্থীরা কাসে যেতে পারবে না। তাই শিার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন বিধিনিষেধে ‘সব ধরনের যানের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে’ বলা হয়েছে। কিন্তু শিার্থীদের মতো চালক ও সহকারীদের টিকার আওতায় আনার কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টিকা ছাড়া চালক ও সহকারী যানবাহনে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া না হলে যানবাহন চালানোর লোক খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হবে। ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে সমতার অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার কথা বলা হলেও এটা কার্যকর করার সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। অফিস শুরু ও ছুটির সময়ে যানবাহনে উপচেপড়া ভিড় থাকে। তাই অফিস, আদালত, শিা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যান চালানো কঠিন নয় শুধু, অসম্ভব প্রায়। তবে অর্ধেক যাত্রী বহন করার বিধিনিষেধ শুনেই বাস মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর দাবি করে বসে আছে। শেষ পর্যন্ত ভাড়া হয়তো বাড়বে, কিন্তু যাত্রী আর অর্ধেক হবে না। আমার আশঙ্কা নতুন বিধিনিষেধ কার্যকর করতে গেলে বাস ভাড়া নিয়ে নতুন অরাজকতা তৈরি হতে পারে।
রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া ও আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য টিকা সনদ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হলেও তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। খেতে গেলে টিকা সনদ নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস করাতে সময় লাগবে। আর এটা কীভাবে মনিটর করা হবে তাও নিশ্চিত নয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এখনও দেশের অর্ধেক মানুষকেও টিকার আওতায় আনা যায়নি। তাই যারা এখনও টিকা পাননি, তারা কি রেস্টুরেন্টে খেতে বা হোটেলে থাকতে পারবেন না?
আগেই বলেছি, সরকারের জারি করা বিধিনিষেধ করোনা মোকাবিলার একদম প্রাথমিক কৌশল। লকডাউনের মতো পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে আমাদের সবার উচিত এই বিধিনিষেধ মেনে চলা। আশা করি সরকার দ্রুত বিধিনিষেধগুলোর অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি দূর করে তা বাস্তবায়নে মাঠে নামবে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বিধিনিষেধ জারি করার চেয়ে কার্যকর বেশি জরুরি এবং বেশি কঠিন। কিছু মানুষ আছেন, যারা সরকারের সবকিছু অমান্য করতে ভালোবাসেন। ৯৫ ভাগ মানুষ যদি সরকারের বিধিনিষেধ মেনে চলে, তাহলে ধরে নিতে হবে সরকার বেশ সফল। কিন্তু সমস্যা হলো, ঢাকায় যদি ৫ ভাগ মানুষও বিধিনিষেধ অমান্য করে, তাতেই পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে। সরকার বলছে, তারা মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বিধিনিষেধের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন। প্রয়োজনে সেটাই করতে হবে। বিধিনিষেধ যেন শুধু প্রজ্ঞাপনে নয়, মাঠেও থাকে। কাজীর গরু কেতাবে থাকলে হবে না, গোয়ালেও থাকতে হবে।
তবে মোবাইল কোর্ট দিয়ে বা পুলিশ দিয়ে বিধিনিষেধ বা স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানানো সম্ভব নয়। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিধিনিষেধ কিন্তু সরকারের জন্য নয়, আমার-আপনার ভালোর জন্য করা, আমাদের সুস্থ রাখার জন্য করা। আমরা যদি এখন সতর্ক না হই, তাহলে আবার আইসিইউর জন্য হাহাকার, অক্সিজেনের জন্য চিৎকার, লাশের মিছিলের ভয়াবহতার সামনে পড়তে হতে পারে।
ওমিক্রন দ্রুত ছড়ায়, টিকায়ও কাজ হয় না; এটা যেমন সত্যি; আবার এটাও তো সত্যি করোনার প্রথম টিকা হলো মাস্ক। আপনি যদি একটি মাস্কে আপনার নাক-মুখ ঢেকে রাখতে পারেন, নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন এবং জনসমাগম থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন; তাহলে করোনা বা ওমিক্রন যত ভয়ংকরই হোক আপনার শরীরে ঢুকতে পারবে না। তাই নিজেকে সুরতি রাখার চাবি কিন্তু আপনার হাতেই।
হাসপাতালের বিচ্ছিন্ন আইসিইউ থেকে বাসার বেডরুম অনেক নিরাপদ ও আরামদায়ক। করোনা থেকে দূরে থাকুন, আইসিইউ থেকেও দূরে থাকতে পারবেন।