ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ।।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় আমাদের এই এগিয়ে যাওয়া বিশাল অর্জন। গত ৫০ বছরে আমরা একটু একটু করে এগিয়ে গেলেও মূলত গত তিন দশকেই বেশির ভাগ উন্নতি লাভ করেছি। আমরা এখনো ওঠার পর্যায়েই আছি।
এ কারণে আমাদের উন্নয়নটা টেকসই করা অন্য অনেক দেশের চেয়েই বেশি জরুরি। সমস্যা হচ্ছে, আমরা উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকেই অতিমাত্রায় মনোযোগ দিচ্ছি। কিন্তু রাজনীতি, সুশাসন, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো যে বিষয়গুলো জনগণের জীবনযাত্রা ও মানের ওপর বড় রকমের প্রভাব ফেলে, সেটা জানা সত্ত্বেও সেভাবে মনোযোগ দিচ্ছি না। তাই গত এক দশকে অর্থনীতিতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে কভিড এসে বড় ধাক্কা দিয়েছে। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত কতগুলো বিষয় আমাদের উন্নয়নকে পেছন থেকে টেনে ধরছে। এসব বিষয়েই কিছুটা আলোকপাত করব।
প্রথমত, আয় ও সম্পদের বিদ্যমান বৈষম্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাকালে এই বৈষম্য আরো তীব্র হয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা বেশ স্বস্তি বোধ করি। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিদের ঘরেই বেশির ভাগ প্রবৃদ্ধির ফসল উঠেছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে না। আয়বৈষম্য মধ্যবিত্তের, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ প্রাথমিক অবস্থায় প্রবৃদ্ধির সুফল কিছুটা পেয়েছিল। কিন্তু দিন দিন সেই সুফলটা হারিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক উন্নয়নে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলোতে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা, মানসম্মত চিকিৎসা, সাশ্রয়ী সেবার মতো প্রশ্নগুলো আগের মতোই রয়ে গেছে। শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলো আগের চেয়ে অবারিত হয়েছে বটে; কিন্তু সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে প্রান্তিক শ্রেণির সামাজিক অবস্থান এখনো ভঙ্গুর। আমরা ভুলে যাই, প্রবৃদ্ধি একটা সূচক মাত্র। এটা মানুষের সার্বিক উন্নতির চিত্র নির্দেশ করে না। এখন সময় আসছে আমাদের জনগণের সার্বিক উন্নতিটা দেখার।
তৃতীয়ত, উন্নয়নকাজে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ও চাহিদা গুরুত্ব পাচ্ছে না। আমাদের যেসব উন্নয়ন হচ্ছে সেগুলোর বেশির ভাগ মূলত সরকারি উদ্যোগে। দেশে প্রচুর পরিমাণে ভৌত কাঠামো নির্মাণসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু তাতে জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় চাহিদার প্রতিফলন সন্তোষজনক নয়। সরকার, সরকারি আমলা এবং বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলনই বেশি দেখা যায়।
চতুর্থত, সুশাসন ও জবাবদিহির অভাব ও দুর্নীতি। কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে; কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না। অর্থনীতির জন্য সুশাসনের বড় দরকার। ব্যাংকঋণ, বিনিয়োগ, শেয়ারবাজার, ব্যবসায় উদ্যোগ, সুস্থ ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতা, ব্যবসা সহজীকরণ, আর্থিক অনিয়ম বন্ধসহ অর্থনীতির প্রতিটা ক্ষেত্রে সুশাসন এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ সুশাসন চালু হওয়া মানেই অনিয়ম বন্ধ হওয়া এবং ব্যবসা সহজ হওয়া। দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়নের বড় শত্রু। অথচ দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না।
পঞ্চমত, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথেষ্ট দুর্বলতা লক্ষ করছি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যেকোনো উন্নয়ন, নীতি-কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই কাজ করেন। এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কর্মক্ষম না হয়, কর্মতৎপর না হয়, তাহলে উন্নয়ন কার্যক্রম ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয় না। বাস্তবায়িত হলেও এর সুফলটা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি বড় দুর্বলতা।
ষষ্ঠত, আইনের শাসনের অভাব। আইন মানে শুধু জনশৃঙ্খলাকেই বোঝায় না এবং জনপ্রশাসনের জন্যই নয়। উন্নয়নের জন্য আইনের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। সে জন্য অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে উন্নয়ন, সুশাসন ও আইনের শাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর ফলে দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের একটি বিরাট কালোছায়া আমাদের উন্নয়নের ওপর পড়েছে। ফলে আমাদের প্রকল্পগুলো পুরোপুরি সাধারণ জনগণের কল্যাণে হচ্ছে—এটা জোর গলায় বলা যায় না।
এখন এই জিনিসগুলো আমরা যদি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে আমাদের উন্নয়নের প্রয়াসটা ব্যাহত হবে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দরকার হলো উল্লিখিত সমস্যাগুলো দূর করা এবং সম্ভাবনাময় খাতগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া।
আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার বা শক্তির জায়গা হলো কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি। কৃষি বলতে শুধু শস্য উৎপাদন নয়, পশু পালন, পোল্ট্রি ও মৎস্য চাষও রয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি আমাদের উন্নয়নে বড় অবদান রাখছে বটে; কিন্তু এটাকে আরো বিকশিত করতে হবে। কারণ আমাদের প্রায় ৫৫ শতাংশ লোকই কৃষি এবং গ্রামের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পের যে সম্ভাবনা রয়েছে তা এখনো সেভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এখানে বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। দেশের ৮০ শতাংশ জনশক্তিই অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অতএব যদি আমরা এ খাতকে ঠিকঠাকমতো বিকশিত করতে না পারি, তাহলে কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না।
তৃতীয়ত, রপ্তানি খাত আমাদের বড় স্বস্তির জায়গা। একই সঙ্গে একক পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা একটি অস্বস্তিরও জায়গা। আমাদের সার্বিক অর্থনীতি বলছে, রপ্তানি শিল্পে আমাদের আরো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এ খাতকে শুধু বহুমুখীকরণ করতে হবে। শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের এখানে পাট আছে, পাটজাতদ্রব্য আছে, চামড়া আছে, সিরামিক আছে, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য আছে, লাইট ইলেকট্রনিক পণ্য আছে এবং দিন দিন এর ক্ষেত্র বাড়ছে। এগুলোকে রপ্তানিমুখী করা জরুরি। না হলে রপ্তানিতে একক খাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়া চলা দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
চতুর্থত, বড় শিল্পের দিকে দৃষ্টি আরো প্রসারিত করতে হবে, প্রচেষ্টায় আরো জোর দিতে হবে। আমাদের কিছু বেসিক ইন্ডাস্ট্রি, যেমন—সিমেন্ট, ইস্পাত, টেক্সটাইল ভালো করছে এবং আরো বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তাই বড় বড় শিল্পের আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের বৃহৎ বা ভারী শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। এই খাতে উৎপাদিত পণ্য দেশে যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এসব খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
ষষ্ঠত, সেবা খাতের কথা বলব। সেবা খাত নিঃসন্দেহে আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। আমাদের সেবা খাত দিন দিন বড় হচ্ছে, কিন্তু এর সুষ্ঠু বিকাশ ঘটছে না। সেবা খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পরিবহন, পর্যটন, হোটেল-রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও চিকিৎসায় আমাদের বহু লোক জড়িত। এই খাতের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে দেশে। কিন্তু সেবা খাতের চারটি নেতিবাচক দিক চোখে পড়ে। যেমন—এ খাতে পেশাদারি মনোভাব গড়ে ওঠে না. সুস্থ প্রতিযোগিতা নেই, এ খাত সাশ্রয়ী নয় এবং মানসম্মত সেবার অভাব। মূলত প্রতিযোগিতা ও নজরদারির অভাবে পেশাদারি মনোভাব গড়ে উঠছে না এবং মানসম্মত সেবা মানুষ পাচ্ছে না। তাই সেবার মান বাড়ানোর সব বাধাই দূর করতে হবে।
সপ্তমত, পৃথিবীর অনেক দেশকেই দেখা গেছে, মধ্যম আয়ের দেশেও পৌঁছেও এর ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। অনেক দেশ বহু বছর ধরে এই ধাপে আছে। উদাহরণস্বরূপ ব্রাজিল, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশের কথা বলা যেতে পারে। বহু আগেই এরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। এমনকি ভারতও মধ্যম আয়ের দেশ। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে আমরা যেন সে রকম কোনো ফাঁদে না পড়ি। আমাদের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছতে হবে। সেটা করতে হলে উপরোক্ত বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিতে হবে।
অষ্টমত, কিছু বিষয়ে আমাদের শুধু বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। অর্থনীতিতে ভারসাম্য থাকা দরকার। বিশেষ করে যেটাকে আমরা সর্বজনীন পণ্য অর্থাৎ পাবলিক গুডস বলি, যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানি—এই জিনিসগুলো পুরোপুরি বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় না রাখলে মানুষ বেসরকারি খাতের ওপর জিম্মি হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে আমাদের লক্ষ করতে হবে।
সব শেষে বলব অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা। আমরা যদি ব্যাংকঋণ, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি বা উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দিকে তাকাই, তাহলে কমই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচেষ্টা দেখতে পাই। আমরা অনেক সময় বলি সাধারণ মানুষ তো অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিতে চলে এসেছে। তখন আমরা যুক্তি হিসেবে ছোট-মাঝারি শিল্পে ব্যাংকঋণ, মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কথা বলি। কিন্তু এগুলো সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি নিশ্চিত করছে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি নিশ্চিত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন, সরকারি নীতি ও উন্নয়ন কৌশলকে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নে জোর দিতে হবে। তবেই আমরা সুষম সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়