যানবাহন
চালকদের শৃঙ্খলাভঙ্গের যে চিত্র ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে, তা এক কথায়
নৈরাজ্য। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে প্রতীয়মান হয়,
দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব যেন শুধু কাগজে-কলমে কিংবা
প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ। বিদ্যমান নৈরাজ্য বন্ধ ও শৃঙ্খলা
প্রতিষ্ঠায় তাদের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব ও দায়হীনতার কারণেই
যে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, এরই ফের মর্মন্তুদ সাক্ষ্য মিলেছে
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে। শুক্রবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যে চিত্র উঠে এসেছে
তাতে আমরা শুধু মর্মাহতই নই, চরম ক্ষুব্ধও। ইরফান আহমেদ গ্রিন বাংলা
পরিবহনের একটি বাসে রাজধানীর ডেমরা থেকে গুলিস্তানে যাচ্ছিলেন। পথে
বাসচালকের সহযোগীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তার বাগ্বিতণ্ডা হয়। গন্তব্যের কাছাকাছি
এসে ওই যাত্রী বাসের দরজায় দাঁড়ালে বাসের সহকারী তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায়
ফেলে দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারান। একই দিন রাজধানীর মগবাজারে আজমেরী
গ্লোরী পরিবহনের দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে চাপা পড়ে কিশোর রকিবুল।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা হকার রকিবুলকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা
মৃত ঘোষণা করেন।
বাস থেকে পরিবহনকর্মীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যার
বর্বরোচিত ঘটনা এর আগে ঢাকায়ই আরও ঘটেছে। তাছাড়া বাসের পাল্লাপাল্লি কিংবা
রেষারেষিতে চাপা পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও কম ঘটেনি। আমাদের স্মরণে আছে, কয়েক
মাস আগে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থীর কলেজে যাওয়ার পথে গুলিস্তানে
গাড়িচাপায় মৃত্যুর ঘটনা। গুলিস্তানেই কর্তব্যরত পুলিশ সার্জেন্ট এমদাদ একটি
বাসের কাগজপত্র পরীক্ষার নামে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে নিজেই বাসটি চালিয়ে
নিকটস্থ পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু'জন পথচারীকে
বাসচাপায় হত্যা করেন ওই ঘটনার কাছাকাছি সময়েই। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড
কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম ও আব্দুল করিমের বাসের পাল্লাপাল্লিতে প্রাণ
হারানোর ঘটনাটি দেশব্যাপী শিক্ষার্থীসহ সচেতনদের প্রতিবাদে যূথবদ্ধ করেছিল।
বাসচালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কলেজছাত্র রাজীব হোসেন, হৃদয়সহ আরও
কয়েকজনের অঙ্গহানির মর্মস্পর্শী ঘটনাও আমরা বিস্মৃত হইনি। সড়কে নৈরাজ্য কী
ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এসব এরই মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত।
আমরা জানি, শিক্ষার্থী
দিয়া খানম ও আব্দুল করিমের প্রাণহানির পর দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে
আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার শাস্তি বাড়িয়ে সড়ক আইন
জাতীয় সংসদে পাস করে। কিন্তু এরপরও সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না!
উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনাই সাক্ষ্য দেয়, এ নিছক সড়ক দুর্ঘটনা নয়, রীতিমতো
হত্যাকাণ্ড। সম্পাদকীয় স্তম্ভেই কিছুদিন আগেও আমরা জিজ্ঞাসা রেখেছি- এই
মৃত্যুফাঁদ থেকে কি মুক্তি নেই? এমন বর্বরতা কি চলতেই থাকবে? প্রশ্ন হচ্ছে,
এসব দেখভালের দায়দায়িত্ব যাদের, তারা কি নিরুত্তরই থাকবেন? আমরা মনে করি,
সড়ক ও পরিবহন খাত-সংশ্নিষ্ট সরকারের বিভাগগুলো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর বিদ্যমান নৈরাজ্যের দায় এড়ানোর পথ নেই। সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক
সদিচ্ছায় ঘাটতি, 'প্রভাবশালী' পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দায়হীনতায় এভাবে একের
পর এক প্রাণ ঝরে যাবে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
আমাদের
অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ঘটনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও
'প্রভাবশালী' মহলের চাপে এক পর্যায়ে সব থেমে যায়। হন্তারক ও
স্বেচ্ছাচারীদের বাড়বাড়ন্তের উৎসে হাত দিতে হবে। সড়কে এমন
বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্য-মৃত্যুফাঁদ জিইয়ে রেখে কোনো উন্নয়নই যে টেকসই করা যাবে
না, তা স্মরণে রাখা উচিত। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি কিংবা বিলম্বিত বিচারের
ক্ষত উপশম করার পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকল্পে দায়িত্বশীল সব পক্ষের
জবাবদিহি-দায়বদ্ধতাসহ প্রাতিষ্ঠানিক সব ব্যবস্থা আমরা অনতিবিলম্বে দেখতে
চাই। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। আমরা জানি, করণীয় বিষয়গুলো নির্ধারণ করা
আছে, কিন্তু সেসবের বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে উদাসীনতা কিংবা গাফিলতি। এমন
মর্মন্তুদ ঘটনার পর সরকারের দায়িত্বশীল মহলের তরফে শুধু তীব্র বিরূপ
প্রতিক্রিয়া প্রকাশের মধ্য দিয়েই দায় শেষ হয়ে যায় না, তাও মনে রাখা উচিত।
আমরা চাই, নির্মোহ ও কঠোর অবস্থান নিয়ে আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সরকারের
দৃঢ়তা।