মহাকাব্য হাসিব উল ইসলাম ।।
১.
প্রথাগতভাবে সত্যিকার মহাকাব্যের ( ষরঃবৎধৎু বঢ়রপ) উপাদান চারটি : এটা সুদীর্ঘ, বীরোচিত, জাতীয়তাবাদী, এবং — এর শুদ্ধতম রূপে — ক্যাবিক ¯‘তি এবং শোকগাথা মহাকাব্যের কাঠামোগত উপকরণ। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীন যুগে পাওয়া মহাকাব্য বেউল্ফ এর প্রথমার্ধ হচ্ছে গ্রেন্ডেলদের ( মাতা ও সন্তান) পরাজিত করা বীরের বিক্রমের অতি- উৎযাপন। আর শেষার্ধে রাজ্যে ত্রাস উৎপাদনকারী ড্রাগনকে পরাজিত করার সময়ে গুরুতর আহত বেউল্ফের মৃত্যুর শোকগাথা। মহাকাব্যে সাধারণত সংঘর্ষ থাকে, এই সংঘর্ষ নায়কের সাথে রাজার — শৌর্যের সাথে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতার।
মহাকাব্য মানুষের মনে তাঁর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কারণ সম্পর্কে বিশ্বাস জোগায়। স্কটিশ সাহিত্য সমালোচক ডব্লিউ পি কারের মতে, মহাকাব্য 'তার আলোচ্য বিষয় সম্মন্ধে সহজ '। মহাকাব্য জানে সে কি বিষয়ে বলছে, এবং তার নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে, — বিশেষ করে যেখানে দুর্বৃত্তরা জড়িত (সেখানে), —সে দৃঢ়। এরকম ব্যাপার আধুনিক লেখকদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো: আমেরিকান ঔপন্যাসিক জন গার্ডনার তাঁর ১৯৭১ সালে বেউল্ফ অনুপ্রাণিত উপন্যাস গ্রেন্ডেল এ গ্রেন্ডেলের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছিলেন।
সহজেই বোঝা যায়, মহাকাব্য কেন সাম্প্রতিক সময়ের অনুপযোগী পরিবেশে তার সজীবতা হারিয়ে ফেলবে। আধুনিক যুগ মহাকাব্যিকভাবে দীর্ঘ সাহিত্যকর্ম পছন্দ করে না — বিশেষ করে সুদীর্ঘ কবিতা তো একদমই না। এ্যাডগার অ্যালান পো যেমনটা দেখিয়েছেন, ছোট ছোট গীতিকবিতা এখন পছন্দের — এরকম সাহিত্যকর্ম যেগুলো এক বসায় পড়া যায়। টমাস হার্ডি যখন তাঁর খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন, বেশ বেপরোয়াভাবেই তিনি দ্য ডাইনাস্টস নামে একটা মহাক্যাবিক নাটক লিখতে উদ্যত হয়েছিলেন। হার্ডির ইচ্ছে ছিল, নায়কোচিত নেপোলিয়নকে দ্য ডাইনাস্টস এর কেন্দ্রে রেখে এটাকে "১৭৮৯ থেকে ১৮১৫ সালের ইউরোপের ইলিয়াড " বানানো। এটা বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের অন্যতম একটা বিশাল ব্যর্থতা। হাজার হাজার পাঠক যারা হার্ডির ছোট ছোট গীতিকবিতা পড়েন তারা ভুলেও কখনো দ্য ডাইনাস্টস এর পাতা ওল্টান না।
আধুনিক জীবনে 'বীর /নায়ক' এর অভাব রয়েছে। অন্তত, মহাকাব্যে একজন নায়ককে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেদিক বিবেচনায়। নায়কের এই অভাব আধুনিক কালে মহাকাব্য না হয়ে ওঠার আরেকটা বাধা। বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক মরিস বাউরার মতে (তিনি মূলত হোমারের ইলিয়াডের কথা মাথায় রেখে ভেবেছিলেন), মহাকাব্য উদযাপন করে " সেসব মানুষের জন্য বিশেষ স্থান যারা কর্মোদ্যোগের জন্য বাঁচেন এবং সম্মান থেকে যারা এই জায়গায় আসেন। " জনপ্রিয় গল্প -উপন্যাস এমন চরিত্রে ভর্তি। কিন্তু এসব চরিত্র আধুনিক কালে এপিক শব্দটির (বাংলায় একটা বিশেষণ) এর মতোই গর্হিতভাবে ব্যবহৃত।
২.
পরাক্রমশালী নায়ক, এবং 'শ্রদ্ধাবোধ ' এর বিষয় আধুনিক পাঠকদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। বরং তারা প্রতি -নায়ক, বা পুরোদস্তুর অ-নায়কোচিত নায়কদের নিয়েই বেশি খুশি। প্রসঙ্গত: প্রশ্ন তোলা যায়, এমিলি ব্রন্টির উদারিং হাইটস উপন্যাসে হিথক্লিফ কি নায়ক? কিংসলে আমিসের লাকি জিম উপন্যাসের জিম ডিক্সন? অথবা ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, তাঁরা নায়ক, এজন্যেই যে তারা গল্পের কেন্দ্র অবস্থান করেন; আবার, না, তারা নায়ক নন, যদি আমরা তাদেরকে প্রাচীনপন্থী 'সম্মান ' ধারণাটির সাথে খাপ খাওয়াতে যাই।
বৈশিষ্ট্যের দিক বিবেচনা করলে, মহাকাব্য একটা মহৎ যুগের যে যুগটি পার হয়ে গেছে এবং পরবর্তীতে সেই সময়টিকে আমরা স্মৃতিকাতর হয়ে দেখি — এই দুঃখবোধ নিয়ে দেখি যে এমন মহিমা একদম হারিয়ে গেছে। সবচেয়ে পূজনীয় মহাকাব্যগুলো এখনো টিকে রয়েছে। গিলগামেশ এর কথাই ধরা যাক। প্রায় চার হাজার বছর ধরে টিকে রয়েছে। মহাকাব্যটি পশ্চিমা সভ্যতার সূতিকাগার, বর্তমান ইরাক, থেকে পাওয়া।
সর্বকালের সেরা দশটি মহাকাব্য
গিলগামেশ (মেসোপটেমিয়া)
অডিসি (পুরোনো গ্রীস)
মহাভারত (ভারত)
ঈনিড (রোম)
বেউল্ফ (অ্যাংলো -স্যাক্সন ইংল্যান্ড)
দি সঙ অভ রোলা (ফ্রান্স)
এল কান্তার দে মিও সিদ (স্পেন)
নেবেলুনলিয়েড (জার্মানি)
দিভিনা কমেদিয়া (ইতালি)
দি লুইসিয়াদস (পর্তুগাল)
ইংরেজি সাহিত্য যে মহাকাব্যটির ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই বেউল্ফ সম্ভবত ষষ্ঠ শতকে লেখা হয়েছিল এবং দশম শতকে কোন অজানা সন্ন্যাসী তার প্রতিলিপি তৈরি করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে, আধুনিক কালের শুরুর দিক পর্যন্ত মহাকাব্যের প্রথা টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ছিল। জন মিল্টনের খ্রিস্টীয় মহাকাব্য প্যারাডাইস লস্ট, এবং আলেক্সান্ডার পোপের মক এপিকগুলো, যেমন দ্যা ডানসিয়াড উল্লেখযোগ্য। এর পর থেকে ইংরেজি সাহিত্যে আর তেমন কিছুই পাওয়া যায় না।
আধুনিক মহাকাব্যের জন্য আরেকটা সমস্যা হলো, মহাকাব্য রীতির জাতীয়তাবাদী উৎপত্তি। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, একটি নির্বাচিত জাতিগোষ্ঠীর-ই মহাকাব্য থাকার যোগ্যতা রয়েছে । মিল্টন বলেছিলেন, একটি "মহৎ ও পরাক্রমশালী জাতির " সন্তান -সন্ততিরাই মহাকাব্য। ধরা যাক, বাংলাদেশ এখন বিশ্বসেরা লেখকে ভর্তি, এদেশে কি এখন একটা মহাকাব্য রচিত হতে পারে?
নোবেল বিজয়ী কানাডীয় -আমেরিকান উপন্যাসিক সল বেলো যখন তার "জুলুদের তলস্তয় কোথায়, কোথায় পাপুয়ানদের প্রাউস্ত? "এই অবজ্ঞাপূর্ণ প্রশ্নটি করেছিলেন, তখন তিনি মূলত বোঝাতে চেয়েছিলেন, শুধুমাত্র মহৎ সভ্যতারই মহৎ সাহিত্যকর্ম থাকে।
নানান বিচিত্র কারণে মহাকাব্যকে সাহিত্যের ডাইনোসর বলা যায়। নিছক বিশালতার জন্য একসময় তাদের আধিপত্য ছিল। কিন্তু এখন তারা সাহিত্যের জাদুঘরে, লেখার টেবিলে নয়। ঠিক কখন মহাকাব্য ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে? ঠিক কখন "পুস্তক ও পত্রিকার যুগ" এসে মহাকাব্য রচনাকে অসম্ভব করে ফেলেছে? উত্তর হচ্ছে, অষ্টাদশ শতকে, উপন্যাসের উদ্ভবের সাথে সাথে। উপন্যাসকে মাঝে মাঝে "বুর্জোয়াদের মহাকাব্য"ও বলা হয়। উপন্যাস কি তার বুর্জোয়া চরিত্র অতিক্রম করে সত্যিই মহাকাব্য হতে পারে? প্রশ্নটি পাঠকের জন্য তোলা রইলো।
পরিচিতি: হাসিব উল ইসলাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। পড়ান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনানিবাস
বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ অদ্বৈতবাদী কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর বিদ্রোহী সত্তাআনোয়ারুল হক ।।
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কবিতায় ‘ভাষা ও ছন্দের উপর অশিক্ষিত পটুত্ব’-গুণের জন্য নজরুলের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা জন্মায়’- বলে লেখক অন্যত্র উল্লেখ করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ চেতনার সম্পর্কে তাঁর হাস্যকর মন্তব্য,
বাংলাদেশের বালক-বালিকারা যাহাকে ঝঞ্ঝার ঝিঞ্জির’ ’ঝড়-কপোতী’ অথবা এরকমই একটা দুর্বোধ্য নামে বিদ্রোহের অবতার বলিয়া জ্ঞান করে, তাঁহাকে এবং তাঁহার যে কবিতাটিকে বিদ্রোহ বাণীর পাঞ্চজন্য শঙ্খ বলিয়া ধরিয়া লয় তাহাকেই দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরি না কেন ? আমি এটা, আমি সেটা, আমি জীবনের যত জীর্ণ,
পরিত্যক্ত, জোড়াতালি দেওয়া জিনিষ তাহারই ভগ্নাবশেষ। আমি ফাটা টর্পেডোর টুকরা, আমি সাইক্লোন, আমি
কৃষ্ণের বাঁশি, আমি অর্ফিয়ুসের বীণা, আমি চেঙ্গিজ, আমি ভীম ভাসমান মাইন, আমি বিধবার দীর্ঘশ্বাস, আমি
বন্ধনহারা কুমারীর বেনী-,ভগবান, বিদ্রোহীর মন কেমন জানি না, কিন্তু এমনই স্বেচ্ছাচারী বাদশাহ, এমন
ভীরু পদানত কেরানীই বা কে আছে যে য়োড়শী তরুণীর গালের গুলবাগে শুভ্র গ্রীবার উপর, সুকোমল বক্ষঃস্থলে
দিনরাত লুটোপুটি খাইবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারে? এ তো বিদ্রোহ নয়, এ যে আত্মসমর্পণ।
-(হক : ২০০০ : ৪১-৪২)
বলা আবশ্যক, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে দুই টুকরো হওয়ার পরে ‘পাকিস্তান’ আমলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ অংশে এই বৈরীতার অবসান হয়নি। বরং নতুন সংস্করণ পর্ব শুরু হয় নজরুলের কাব্য চেতনার ‘পাকিস্তানি রূপ’ দেবার উদ্যোগে। আর এতে নেতৃত্ব দেন পূর্বাক্ত কবি গোলাম মোস্তফা। যদিও তিনি জানতেন, নজরুল ছিলেন ঘোর পাকিস্তান চেতনার বিরোধী। তথাপি তাঁর সম্পাদিত ‘নওবাহার’ পত্রিকার ১৩৫৭ আশ্বিন সংখ্যায় তিনি ‘নজরুলকে পাকিস্তানে আনতে হলে ‘পাকিস্তানি’ করে আনতে হবে, কবির অখণ্ড ভারতীয় রূপকে বদলে তাঁকে মুসলমান নজরুল করতে হবে এবং এই দায়িত্ব নিতে হবে তৎকালীন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের- বলে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন,
বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠতম আলেমগণ অযাচিতভাবে পত্রে যে সব লিখিয়াছেন, এই সব পত্র পড়িলে দেখা যায়, তাঁহারা নজরুল-প্রতিভা সম্বন্ধে পূর্ণ সজাগ এবং তাঁহার প্রতি মমত্বশীল: তবে তাঁহারা চান নজরুল কাব্যের শুদ্ধিকরণ।নজরুলকে বাঁচাইতে হইলে অন্য পথ আমাদিগকে খুঁজিতে হইবে। নজরুলকে পাকিস্তানে আনা বিশেষ দরকার এবং নজরুলের যাবতীয় পুস্তকের পাকিস্তান সংস্করণ বাহির করারও একান্ত প্রয়োজন। বলাবাহুল্য, আমাদের এই
প্রস্তাব দেশবাসী সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করিয়াছেন। - ( ইসলাম : ১৯৯৯ : ২১৭)
বাঙালি জাতির সৌভাগ্য, পুর্ব পাকিস্তানের মুসলমান ‘হাজম’রা নজরুলকে মুসলমানী করে আনতে সক্ষম হয়নি। তাতে মনে করি, উপকার বৈ অপকার হয়নি। ‘সময়ই শ্রেষ্ঠ বিচারক’ (পত্র নং-আঠারো, ন র, নবম খণ্ড, বা এ : ১৯৩) বলে যে কবি নিজেকে সময়ের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন সেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁরই যাচিত, ঘোষিত (এই পবিত্র বাংলাদেশ, বাঙালির আমাদের) স্বাধীন ‘বাংলাদেশে’ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ উদ্যেগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদায় বাংলার মাটিতে স্থায়ীভাবে পা রাখেন। কাব্যে তাঁর অন্তিম ইচ্ছে (‘মসজিদেরেই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।’-১২৯ নং গান, ন র : তৃতীয় খণ্ড : ৪৬১) অনুযায়ী প্রাচ্যের আদর্শ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের মিনারের পাদদেশে ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি চিরশয্যায় শায়িত
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একুশ শতকের স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বৈরীতার অবসান হয়েছে বলা যাবে না। বিরোধতার আচরণ বিগত পঞ্চাশ বছর জুড়ে সম্পন্ন হচ্ছে পরোক্ষভাবে। আমাদের জানামতে, এদেশে তথাকথিত আধুনিক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ নজরুলের কাব্যকে মনে করেন ‘পদ্য’। তাঁর অভেদ কাব্য চেতনাকে পাশ কাটিয়ে অভিহিত করেন ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে। কেননা, তিনি ইসলামী ঐতিহ্য চেতনার কবিতা, সংগীত (হামদ্, নাতে রসুল) রচনা করেছেন। কিন্তু ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ চরিত্রের এই আধুনিক শিক্ষিতরা তখন ভুলেও একথা মনে করেন না যে, নজরুল চেতনা অসাম্প্রদায়িক। তিনি ইসলামী গান, কবিতা রচনার পাশাপাশি প্রতিবেশী অন্য ধর্মের সম্প্রদায়ের জন্যও ভক্তিগীতি শ্যামা সংগীত, শাক্ত, শৈব, ভজন, কীর্তন, বৃন্দাবন সংগীত সমান তালে রচনা করেছেন এবং ওই সমস্ত সংগীতের বাণীতে চিরকালের সমন্বয় চেতনা বজায় রেখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, মুসলমান এবং হিন্দু ধর্মের অন্তর্বিভেদের ক্ষেত্রে নজরুল ‘প্রেমধর্ম’কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মানবিক চেতনাকেই সেখানে প্রাধান্য দিয়েছেন। নবীপ্রেমে তিনি ইসলামের মহামানবকে ‘ত্রিভুবনের’ (স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল) অধিপতি মোহাম্মদ (দঃ) বলে উল্লেখ করেছেন। যার অর্থ তিনি সর্বকালের, সারা জাহানের মানুষের ত্রাতা হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। - যেকথা মহাগ্রন্থ ‘কোরানে’ও বলা হয়েছে। পৃথিবীতে তিনি কেবল মুসলমানদের জন্য প্রেরিত হননি। যদিও আমাদের বাঙালি ইসলাম ধর্ম প্রচারকগণ নবীকে ইহকাল ও পরকাল-এর মধ্যে ব্যাখ্যা করেন।
অন্যদিকে, নজরুল তাঁর গানের বাণীতে একই তালে হিন্দু ধর্মের শ্যাম-শ্যামা ভক্তদের মধ্যে যে বিরোধ তাকে ঘুচিয়ে দিয়ে একই মায়ের কোলে বসিয়ে আরাধনা করে ছেড়েছেন। ঈশ্বর, ভগবান- যে যে নামেই ডাকুক, নজরুল তাতে কোন ফারাক উপলব্ধি করেন না। এই যে সার্বজনীন মিলন চেতনা নজরুলের-তার স্বরূপ অনুধাবনে ব্যর্থদের হাতেই কিন্তু বর্তমানে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চতর পর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সিলেবাস তৈরি হয়, যেখানে নজরুল পাঠ্যসূচি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে অন্তর্ভুক্ত নয়।
বর্তমান বিভেদের পৃথিবীতে কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-সংগীতে, যাঁরা বিশ্বজনীন মানবিক, ধর্মীয় ঐক্য চেতনা খুঁজে পেতে ব্যর্থ, তাঁদের অন্তর্দৃষ্টির ঘাটতি রয়েছে বলে আমরা মনে করি। অনুভব করি, বিশ্বমানবের প্রতি দায়বোধের অন্তর্জাত প্রেরণা থেকে ‘বিদ্রোহী’র জন্ম হয়েছে। স্বর্গ মর্ত্য পাতালব্যাপী একক শক্তিকে সেখানে আহ্বান করেছেন কবি মানুষের ‘ভগবান’ হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে থাকা ‘অসুর’ বিনাশের জন্য। সুফী চেতনার ভাব-দর্শন রসে সিক্ত হয়ে প্রেমভাবে যেমন লিখেছেন ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক আধুনিক সংগীত, পাশাপাশি একই সময়ে লিখেছেন হিন্দু ধর্মীয় ভক্তিগীতি। স্বধর্মের না হয়েও বিস্ময়করভাবে তাঁর হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রীয় জ্ঞান এত বিপুল ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত যে, উভয়ক্ষেত্রে নজরুল পথিকৃত। হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা শ্যামের গান লিখলেন, তাঁরা লিখেন নি শ্যামার গান। যাঁরা শ্যামার গান লিখলেন তাঁরা লেখেন নি শ্যামের গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেতে রইলেন ব্রাহ্ম সংগীত নিয়ে। এই ভুবনে নজরুল ইসলাম স্বতন্ত্র, এককভাবে সফল এবং স্বার্থক।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার একশত বছর পরে এককভাবে একটি কবিতার জন্যে এখানেও নজরুল হয়ে রইলেন স্বতন্ত্র। বিষয় চেতনায় কবিতাটি অভূতপূর্ব- বিদ্যমান সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ে যত অসংগতি ও শোষণ পুঁজিবাদী যন্ত্রের, সেসবের বিরুদ্ধে এমন সোজা-সাপটা প্রতিবাদ, একই সাথে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান পুরাণের মিশেলে সাধারণ অর্থের আড়ালে পারমার্থিক অদ্বৈতবাদী চেতনার উদ্ভাস আছে ব্যতিক্রম এই কবিতায়। যা এককথায় অসাধারণ, শ্রেষ্ঠ।
অদ্বৈতবাদী চেতনার সংক্ষিপ্ত ব্যখ্যা এখানে প্রয়োজন মনে করি-এই ভারতবর্ষে আওলিয়া পীর দরবেশ সুফিদের মাধ্যমে যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল, সে ইসলাম স্থানীয় ধর্মীয় আচার বিশ্বাসের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এক ধাঁচের সহজিয়া রূপ পেয়েছিল। সুফিবাদী ইসলাম আর আরব দেশের ইসলাম- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। মূল ইসলাম হলো দ্বৈতবাদী। আল্লাহ সেখানে প্রভু, মানুষ হলো বান্দা বা দাস। স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সম্পর্ক প্রভু এবং দাসের। কিন্তু সুফিরা বিশ্বাস করেন অদ্বৈতবাদে। অদ্বৈতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই। অভিন্ন। সৃষ্টি স্রষ্টার অস্তিত্বে লীন হয়ে যেতে পারে। যাকে বলা হয়েছে, ‘ফানা ফিল্লাহ’। সুফিরা মনে করেন, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক প্রেমের, প্রভু-ভৃত্যের নয়। এও বলা হয়ে থাকে, সুফিরা যে ‘আনাল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই সে’ – এই সাধন তত্ত্ব- এর তালাশ তাঁরা পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের সাধকদের কাছ থেকে।
আর এই ভারতবর্ষেরই আসানসোল জেলার চুরুলিয়া গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক মুসলিম পরিবারে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। আমি দেখে এসেছি, একটি মাটির ঘরে, যার সন্নিকটে পীরপুকুর, মসজিদ, তার পাশে হাজী পালোয়ান নামক এক ওলির উন্মুক্ত মাজার, যে মাজারের খাদেম ছিলেন বালক নজরুল। নরম কাদামটির বয়স তখন তাঁর। যে বয়সে মানুষের মনে কৌতুহল এবং জিজ্ঞাসা জন্ম নিতে থাকে। সংবেদনশীল বালক নজরুলকে সংগত কারণেই ধারণা করি, বাড়ির পাশে শায়িত সুফি সাধক স্বাভাবিক ভাবেই অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের জন্য আকৃষ্ট করে থাকবে। এও মনে করি, পরিণত বয়সে নজরুল এই সমস্ত সুফি সাধক ‘অদ্বৈতবাদী’ প্রেমিকদের প্রেম চেতনায় ঋদ্ধ হয়েছেন, পাঠে অভিভূত হযেছেন ইরানি ফারসি কবি হাফিজ, ওমর খৈয়াম, উর্দু কবি মীর (মৃত্যু : ১৮১০), গালিবে (মৃত্যু : ১৮৭৯), যাঁরা তাঁর প্রিয় কবি ছিল। বলেছেন নজরুল,
আমি বেশি পড়েছি গালিবকে, তাকেই বেশি জানি এবং তার কাব্য ভালবাসি। কিন্তু মীরের কবিতা আমাকে পাগল করে দেয়। পাগল তো আল্লাহর ফজলে আমি আছিই। মীর আমার পাগলামিকে আরো প্রগাঢ় করে তোলে। আমার এক পুরনো পীর (কবি হাফিজ) আছেন, যাঁর শরাবখানার দরজা আমার জন্য খোলা সবসময় থাকে। (বতুল : ১৯৯৯ : ২৩৩)
এ জন্যিই আমাদের চেতনায় নজরুলের সৃষ্টি সুখের উল্লাস ‘বিদ্রোহী’ কবিতা হলো সমন্বিত মহাশক্তির ‘আমি’ সত্তার নান্দনিক মহাকাব্য। অদ্বৈতবাদী চেতনার স্বতন্ত্র উদ্ভাস। এবং এই অদ্বৈতবাদী চেতনার সঙ্গে মূল ইসলামের ফারাক থাকলেও প্রেমিক চেতনার সঙ্গে কোন পার্থক্য নেই। স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল ইসলামে কোন মধ্যস্থতাকারি নেই। পীর-মুরশিদ বর্জনীয়। কিন্তু অদ্বৈতবাদী সুফিরা পীর-মুরশিদের মাধ্যমেই স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করেন। বিশ্বাস করেন, নজরুলের গানে আছে, যেমন,-
‘আল্লাহকে যে পাইতে চাহে, হযরতকে ভালোবেসে’ (৯৪ নং ইসলামী সংগীত), ‘তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহম্মদের নাম’ (৫৪ নং), ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’- (৭২ নং), ‘খোদার রহম চাহ যদি নবীজীরে ধর, নবীজীরে মুর্শিদ কর নবীর কলমা পড়।’-(১৬১ নং), ‘তোমার নামে একি নেশা হে প্রিয় হজরত’-২৫ নং) ইত্যাদি ছাড়াও নজরুলের অসংখ্য অনুরাগের গান রয়েছে, যার মাধ্যমে নব আঙ্গিকে তাঁর প্রেমিক সত্তাকে তুলে আনা যায়। (ইসলাম : নজরুল সমগ্র : অষ্টম খণ্ড) এ কারণে নজরুলের আগ্নেয় উৎসের জ্বালামুখ থেকে দ্রোহীর প্রথম উদগীরণ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অর্থ কেবল জাগতিক নয়, পারমার্থিকও বটে। যার অর্থ অনুধাবন জরুরী। যে জন্য মধ্যযুগে বঙ্গদেশে আগত উপর্যুক্ত ‘অদ্বৈতবাদী’ চেতনার ইতিহাস জানা আবশ্যক।
প্রকৃতই তা না হলে সহজ নয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সমগ্র অন্তর স্পর্শ করা, যেখানে রয়েছে ত্রিভুবনের আদি থেকে অন্তে সকল শক্তির সমাহার। মুসলিম হিন্দু ও গ্রীক পুরাণের সমন্বিত সহবস্থানের অসামান্য উদাহরণ হয়ে আছে কবিতাটি, যে পুরাণ নজরুল রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র সমূহ ব্যবহার করে কবি একক ‘আমি’র বহুবিধ তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। লক্ষ করার বিষয়, পৌরাণিক যে চরিত্রটি নজরুল বেশি ব্যবহার করেছেন, সেটি দেবতা ‘শিব’। অনার্য বঙ্গের প্রাচীন ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, শিব হচ্ছে প্রাকৃত জনতার, অনার্য দেবতা। আর্যরা যখন এই অনার্য উপমহাদেশে আসে এবং সারা ভারতবর্ষকে তাদের উন্নত সাংস্কৃতিক প্রভাব বলয়ে গ্রাস করে ফেলে, তখন তারা আর্য দেবতাদের পাশাপাশি প্রাকৃত জনগণের দেবতা ‘শিব’কে গ্রহণ না করে পারেনি। ‘শিব’ হচ্ছেন সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা, নজরুলের প্রিয় চরিত্র। চরিত্র বৈশিষ্ট্য অনুসারে ‘শিব’কে নজরুল ভিন্ন ভিন্ন নামে কবিতায় স্থান দিয়েছেন, যেমন, ব্যোমকেশ (গঙ্গা ধারণকালে শিবের জটা সারা আকাশে পরিব্যপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে তাঁর নাম ব্যোমকেশ, ঈশান (শিব, বিষাণবাদক, পশুর শিং দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র যা ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়), পিনাক-পাণি ( ত্রিশূলধারী, পণি অর্থ হাত, যার হাতে ত্রিশূল শোভা পায়। আবার এই ত্রিশূলের মাথায় তিনটি ফলার অর্থ আছে, অর্থাৎ, ত্রিজগত, ত্রিনয়ন, ত্রিভূবন। শিব (ত্রিনয়নধারী, বিশ্বাধিপতি), ধূর্জটি (ছাইরংয়ের জটাধারী), নটরাজ (নৃত্যরত শিব) ইত্যাদি। এছাড়া হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অনুষঙ্গ কবিতায় আছে, (চলমান)
জাতকরোখসানা ইয়াসমিন মণি ।।
আলাভোলা আকাশেতে
নীলাভের চাঁই
এই দেইখা আমি মণি
উজানে উতরাই
, উজানে টানলে এমন কে
থাকে স্বাভাবিক !
কুল ভাইঙা পাড় ভাইঙা
ছুটি দিগ্বিদিক।
কে আমারে নিতাছো তার
চোক্ষের ভিতর
আগুন পানিরে করিয়া
এক বহিয়া তরতর !
বিবাগি হইয়া খুঁজি কারে
খোয়াবের রাইত
মনোপুরে দিলা সিঁধ
বনোহুর ডাকাইত,
কসম!এই শইল্যে
কামড়ায় চিতল হরিণ,
মোহন ব্যাধিতে মজায়া
নেয় জাতক মীন।
শুরুতেই থেমে আছি
জাফরিন সুলতানা
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম
আজ আবার সেখানেই এসে থেমেছি
পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি এক বিন্দু নড়িনি
মনে হলো মাসের পর মাস অনেক খেটেছি
তাও এক পা নড়িনি।
নিজের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না
কেন, কোথায়, কার জন্য আছি?
নিজেকে ভালোবাসি
যখন একটি সন্ধ্যা
আরিফুল হাসান
একটা বেহুঁস সন্ধ্যা পড়ে আছে ভাঙাঘরে একা
চেরাগের আলো নেই, সেবক-সেবিকা নেই
রূপকথা যাদু নেই, নেই কোনো সখা
একটা মাতাল সন্ধ্যা নাচঘরে পড়ে আছে একা।
এখানে রোশনাই ছিলো চাঁদের মতন
এখানে দোলতো দেহ ষোড়শীর রূপার শরীর
রাজা-বাদশা-মহারাজ-উজির-নাজির-সেনাপতি
দু হাতে বিলাতে থাকতো জনতার সঞ্চিত ধন।
এখানে এখন শুধু পড়ে আছে মরা ইতিহাস
একটা পাগল সন্ধ্যা বলে যায় রাত্রির ক্রমপরিহাস।
তুমি সরে দাঁড়ালে কী হবে
খলিলুর রাহমান শুভ্র
পারলে পতন ঠেকাও
কোথায় পড়ছি
কীভাবে পড়ছি
কতটুকু ওজন নিয়ে পড়ছি
কতটুকু ভাবনা জুড়ে পড়ছি
সব তোমার জানা
তুমি সরে দাঁড়ালে কী হবে
তোমার রুদ্ধশ্বাস রূপান্তর জুড়ে
আমার অনিবার্য পতন।
তোমার নির্বাচিত সুখ সম্প্রদায় নিষ্পেষিত
হবার হাত থেকে বাঁচানোর এই শেষ শর্ত-
হাত বাড়াও
আমি শিমুলের ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে
তোমার বুকের কবিতাপাড়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রবো।
না ভোলার স্মৃতি
মোঃ নুরুল আলম সেলিম মিয়াজী
‘এক মধ্য বয়সী নারী...
এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে !’
নিস্ফলক দৃষ্টি তার, কাকে যেন খোঁজে
এক উদরের ভাই নতুবা বুকের যাদুধন
ফিরবে সে একদিন রোদনের রস্মি ধওে ।
হৃদয়ের রক্ত বিন্দু অনুরণে তার প্রিয় মুখ
মাটির সুবাস রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে
থমকে দেয় কবি পথিক ও পথকে ।
তুমিও দাঁড়াও কানপেতে শোনো, দেখো
হে পথচারী! উদাসি আত্মার মাতম
ঘোমটার পাড়ে অশ্রু মোছা মুখ আঁচলে
চোখ বুঝে না সে, জলের নোনা গুণে নির্গুণে ।
জলে জ¦লে অন্ধ হবে তবু ফিরাবে না হাত
এখানে নারীরা দৃঢ় দণ্ডবত কতো শতো দিন রাত ।
সে জানে- বোন জানে- মা জানে
পথহারা পাখি যদি ফিরে কৃষ্ণ যামে
ধন তার ফিরে আসবেই একদিন
না ভোলার স্মৃতি - লাল শ্যাম ধামে ।
#