Published : Friday, 4 February, 2022 at 12:00 AM, Update: 04.02.2022 12:36:54 AM
বায়ান্নোয়
আমি ছিলাম হাফপ্যান্ট পরা এক বালক/তখন স্লোগান কিংবা মিছিলের কোনো/কিছুই
আমি বুঝতে শিখিনি/মফঃস্বল শহরের আনাচে কানাচে মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল/ক্ষোভ আর
ঘৃণার আগুন ...। কবিতার এই পঙ্ক্তিমালার সূত্র ধরে ১৯৫২ সালের একুশে
ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন যে অগ্নিগর্ভ রূপ পেয়েছিল তার সূচনাটা হয়েছিল আরও
কয়েক বছর আগেই। ১৯৪৭ সাল থেকেই মুসলিম লীগের নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। উল্টোপিঠে চলতে থাকে মায়ের ভাষার
অধিকার রক্ষায় বাঙালীর প্রতিবাদ। সেই সুবাদে ১৯৪৮ সালেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার
দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। ডেকেছিল ধর্মঘট। তৎকালীন বাঙালী
কর্মজীবীরাও শামিল হয়েছিলেন সেই আন্দোলনে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৮ সালের ১৫
মার্চ। বৃষ্টিঝরা বৈরী আবহাওয়াময় দিনটিও হয়ে উঠেছিল উত্তাল। কারণ,
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এদিন ধর্মঘট ডেকেছিল সংগ্রাম পরিষদ। তাই সকাল
থেকেই শুরু হয়েছিল পুলিশের বিরুদ্ধে পিকেটিং। আর সেই সংগ্রামে চাকরির
তোয়াক্কা না করে অংশ নিয়েছিলেন সচিবালয়ের বাঙালী কর্মচারীরাও। সময় যত
গড়িয়েছে সেদিনের আন্দোলনের তীব্রতাও তত বেড়েছে। তাই সকাল পেরুনো দুপুরে রেল
কর্মচারীরাও সম্পৃক্ত হন সেই আন্দোলনে। একপর্যায়ে ছাত্র এবং জনতার
সম্মিলিত পিকেটিংয়ে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। তবে তাতে কোন কাজ হয়নি।
উল্টো আরও বেশি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে
অব্যাহত থাকে বিক্ষোভ। আর এদিনের আন্দোলনে ছাত্রদের সংগঠিত করেছিলেন
মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দীন আহমদ।
তবে ১৫ মার্চের আগেই ১১ মার্চের ডাকা
ধর্মঘটে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সেদিনের ধর্মঘটে
লাঠিচার্জ এবং গণগ্রেফতারের কারণে আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্ররা।
এমনকি ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। সেই সুবাদে পূর্ব বাংলার সবগুলো
জেলাতেই ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের উত্তাপ। ১১ মার্চের আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন ২০০
জন। তাদের মধ্যে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন ১৮ জন। পুলিশ গ্রেফতার করেছিল
৯০০ জনকে। অনেককে ছেড়ে দেয়া হলেও কারাবন্দী করা হয়েছিল ৬৯ জনকে।
১৫
মার্চ ছিল পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের প্রথম অধিবেশন। আগের দিন ১৪ মার্চ রাতে
খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য ডাক্তার মালিক,
তোফাজ্জল আলী ও এম এ সবুরকে এক চিঠি দিয়ে পাঠান কমরুদ্দিন আহমদের কাছে।
চিঠিতে তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে চান। উত্তরে
কমরুদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু আবুল কাসেম ও তিনি ছাড়া আর সবাই জেলে সেহেতু কোন
আলাপ চলতে পারে না।’ পরদিন খাজা নাজিমুদ্দিন জানান, তিনি আলোচনা করতে রাজি
আছেন এবং তাদের নির্দেশ মানতে রাজি আছেন।
এরপর ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে
বোঝাপড়া শেষে সেদিন খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে বর্ধমান হাউসে (বর্তমানে
বাংলা একাডেমি) আলোচনা শুরু করে। নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের
আলোচনায় তুমুল বিতর্ক ও উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পরিষদ সদস্যদের অনমনীয়তার
মুখে সবকটি শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হন নাজিমুদ্দিন। কিন্তু চুক্তি তখনই
স্বাক্ষরিত হয় না। জেলে গিয়ে আবুল কাসেম ও কমরুদ্দিন আহমদ পরিষদ বন্দী
সদস্যদের চুক্তিগুলো দেখান। আর সেই উত্তাল সময়ে কারাগারে আটক থাকা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব,
শামসুল হকরা সেই চুক্তির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। তখন সংগ্রাম পরিষদের
সদস্যরা বর্ধমান হাউসে ফিরে এলে সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা
নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দিন আহমদ চুক্তিপত্রে
স্বাক্ষর করেন। চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিলÑ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি,
সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সেদিনের অদিবেশনেই বাংলাকে
পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হবে বলে প্রস্তাব
গ্রহণ এবং সেদিনই ব্যবস্থা পরিষদ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য
কেন্দ্রের নিকট অনুমোদনসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করবে। ১৭ মার্চ ‘আজাদ’ পত্রিকার
প্রথম শিরোনাম ছিল ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকৃত : চারদিনব্যাপী
আন্দোলনের ফলে ভাষা সঙ্কটের সমাধান’।
তবে সেদিনের সেই চুক্তির মাঝে ছিল
ভাঁওতাবাজিÑসেটাও বুঝতে বিলম্ব হয়নি ছাত্রদের। ফলশ্রুতিতে ছাত্ররা
অধিবেশনের শেষে তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় পুলিশের লাঠিচার্জে
অসংখ্য ছাত্র আহত হন। পরদিনও প্রচ- বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১৬ মার্চ সংগ্রাম
পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদ স্বরূপ ১৭ মার্চ সারাদেশের
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ও ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। খাজা নাজিমুদ্দিন
ভেবেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এলে পরিস্থিতি শান্ত হবে। কিন্তু
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন ও বক্তৃতা পূর্ব বাংলার মানুষদের মনে
পরিষ্কার ধারণা দিয়ে যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সরকার কোন রকম
ইতিবাচক চিন্তাই করছে না।