শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
১৯৬৭
সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হই। আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল ১৫ নভেম্বর ১৯৬৭ সালে। পরীক্ষার ফল
বের হয় ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে
চাই। আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পরীক্ষা দিয়ে অর্থনীতিতে এম এ প্রথম
পর্বে ভর্তি হই। ঢাকায় থাকা ও বাংলা বিষয় নয়, অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রি নিলে
ভালো চাকুরি পাওয়া যাবে এটাই প্রত্যাশা । তাই আমার শিক্ষক ড. নীলিমা
ইব্রাহিমকে অনুরোধ করে বাংলাবাজারের কে এল জুবলি স্কুলে শিক্ষক পদে
যোগদানের ব্যবস্থা করি। ড. নীলিমা ইব্রাহিম তখন এ বিদ্যালয়ের সভাপতি বা
সম্পাদক ছিলেন। জনাব কামারুজ্জামান ছিলেন প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা এবং
একই সময় আমাদের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ
করেছেন। এদিকে আমার সহপাঠী বন্ধু অবনীমোহন বর্মণ, তিনি ময়মনসিংহে গাড়ো
সম্প্রদায়ের সন্তান, উপজাতি কোঠায় বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতেন, বিবাহিত ও
দু'সন্তানের জনক, জগন্নাথ হলের ছাত্রলীগের সভাপতি, কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের
সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তিনি আমার স্কুলে
চাকুরির কথা শুনে রাজ্জাক সাহেবসহ অবনী আমাকে আমার শিক্ষকতার চাকুরি তার
জন্য ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। আমাকে বুঝানো হলো- অবনী বিবাহিত, আর্থিকভাবে
দুর্বল এবং সংগঠনের স্বার্থে ঢাকায় থাকা জরুরি সুতরাং আমার এব্যাপারে
সহযোগিতা করা উচিত। আমরা তিনজন ড. নীলিমা ইব্রাহিমের বাসায় যাই এবং
বিস্তারিত আলোচনার পর অবনীকে শিক্ষকতার চাকুরিটা পাইয়ে দেই। ড. নীলিমা
ইব্রাহিম সব শুনে শুধু বললেন, ‘শান্তিরঞ্জনের আপত্তি না থাকলে তা ব্যবস্থা
করা যাবে। বলে রাখি অধ্যাপক অজিতকুমার গুহের মাধ্যমে আমি ড. নীলিমা
ইব্রাহিমের নৈকট্য লাভ করি এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাই।
রাজ্জাক সাহেব ও অবনী চলে যাবার পর আমাকে রাতে খেয়ে যেতে বললেন। আমরা তাঁর
বাসায় সন্ধ্যায় গিয়ে ছিলাম। খাবার টেবিলে তিনি বললেন- নারায়ণগঞ্জ তোলারাম
কলেজে আগামী জুলাই (১৯৬৮) বাংলা বিভাগে শিক্ষক নেয়া হবে, তিনি কলেজের
গভার্নিং বডির বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিনিধি, অধ্যক্ষ খগেন্দ্র চক্রবর্তী,
উপাধ্যক্ষ মিঃ জীবন কানাই চক্রবর্তী ও জনাব শামসুল হুদা। তার আগেই আমার
পরীক্ষার ফল বের হয়ে যাবে। তিনি সেখানকার জন্য আমাকে নিয়োগের ব্যবস্থা করে
দিতে চেষ্টা করতে পারেন, যদি আমার আপত্তি না থাকে। আমি তাঁকে বিনীতভাবে
সেখানে আমার চাকুরির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানাই। কে এল জুবলি স্কুলের
চাকুরির কথা অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ জানতেন। যখন এরই মধ্যে ঘটনা অন্য পথে
চলে গেছে, আমি তাঁর কাছে গিয়ে পূর্বাপর সব ঘটনা বিস্তারিত বলি। তিনি বললেন,
‘তাহলে এখন কী করবি। বরং আমি সংবাদ পত্রিকায় আহমেদুল কবীরকে বলি তুই
সাংবাদিকতা শুরু করে দে। অন্তত ঢাকায় থাকার ব্যবস্থাটা হোক।' সাংবাদিকতা
বিষয়টি আমার ধারণার অতীত এবং তাঁর একটি চিঠি নিয়ে এক সন্ধ্যায় সংবাদ অফিসে
যাই। সেদিন সম্পাদক মহোদয় অফিসে আসবেন না। তাই জনাব জহুর হোসেন চৌধুরীর
সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন- 'অজিতদা পাঠিয়েছেন। তোমার এ ব্যাপারে চিন্তা
করার কিছু নেই। ঘুরে ঘুরে দেখ। আরো বললেন, 'তোমার কাজ হবে সন্ধ্যা থেকে রাত
দুটা পর্যন্ত। তারপর ২/৪ দিন গিয়েছিলাম। কিন্তু সাংবাদিকতা করা আমার জন্য
নয় এটা নিশ্চিত ভেবে অধ্যাপক অজিতকুমার গুহকে বলে বাড়ি চলে আসি এবং আগামী
জুলাই মাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। এপ্রিলে পরীক্ষার ফল বের হলো, ঢাকায়
এলাম বিভাগীয় প্রধান শ্রদ্ধাভাজন অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই-এর কাছ থেকে
শংসাপত্র সংগ্রহ করলাম, আমার দুই টিউটরিয়েল শিক্ষক, ড. মোহাম্মদ
মনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক আনোয়ার পাশার কাছ থেকেও শংসাপত্র সংগ্রহ করলাম।
অনার্স ও এম এ পরীক্ষার সাময়িক সনদপত্র সংগ্রহ করলাম। এসব কাজ শেষ করে
এপ্রিলের ২৫/২৬ তারিখ বাড়ি চলে আসি। তখন আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক
ছিলেন জনাব আবদুস সামাদ, আমার পিতা শ্রীযুক্ত ইন্দুভূষণ ভৌমিক সহকারী
প্রধান শিক্ষক। সামাদসাহেব আমার শিক্ষক, আমার পিতা সামাদসাহেবের শিক্ষক।
সুতরাং আমাদের সম্পর্কটা নানাভাবেই ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক। এদিকে সামাদসাহেবের
সহপাঠী ও বন্ধু চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া স্কুল ও রাঙ্গুনীয়া ডিগ্রি কলেজের
অধ্যক্ষ সন্তোষভূষণ দাশ (এস বি দাশ) সামাদসাহেবকে রাঙ্গুনীয়া স্কুলের
প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছিলেন। কারণ
মি: এস বি দাশ বিধি মোতাবেক দুই প্রতিষ্ঠানের প্রধান থাকতে পারবেন না। তাই
বিশ্বস্ত বন্ধুর নিকট দায়িত্বটি দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। সামাদসাহেব আগে কয়েক
বছর রাঙ্গুনীয়া স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে চাকুরি করে গেছেন। তিনি
বন্ধুর আহ্বানে রাঙ্গুনীয়া যাবেন, আমার পিতাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব
বুঝিয়ে দিতে স্কুল কমিটির মিটিং করে সব ঠিক করলেন। আমি মিটিং-এর দিন স্কুলে
উপস্থিত ছিলাম। মিটিং-এর পর সামাদ সাহেব বললেন, 'তুমি তো অবসর আছো, আমার
সঙ্গে রাঙ্গুনীয়া চলো।' এ ব্যাপারে আমার পিতার মতামত চাইলেন। আমি যেতে
আগ্রহী নই। তারপরও আমার পিতা সামাদসাহেবের আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখে, তাঁকে
প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার সহযোগিতার জন্য অনেকটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের
অছিলায় বললেন- “যা না সামাদ যখন এত করে বলছে। সে তো তোরও শিক্ষক ।’
আমি
আমার শিক্ষক সামাদবাহেবের সঙ্গে ৩০ এপ্রিল ১৯৬৮ রাঙ্গুনায়ার উদ্দেশ্যে রওনা
হই । প্রথমে কুমিল্লা এবং রাত্রে রেল গাড়িতে ১ মে চট্টগ্রামে এবং
চট্টগ্রাম থেকে সকালে বাসে কাপ্তাই রোডে রাঙ্গুনীয়ায় গিয়ে পৌঁছি।
সামাদসাহের তাঁর বন্ধু মিঃ এস বি দাশের সঙ্গে দেখা করেন এবং আমাকে সঙ্গে
নিয়ে এসেছেন তাও জানালেন। মিঃ এস বি দাশ আমার পিতাকে চিনতেন।
২ মে ১৯৬৮
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। কলেজে পরীক্ষার কেন্দ্র আছে পরীক্ষার্থী প্রায়
বারো'শ। সকাল ৮ টায় একজন পিয়ন এসে একটি ছেঁড়া কাগজের টুকরা এনে
সামাদসাহেবের সামনে আমাকে দিল। দেখলাম একটা স্লিপ তাতে লেখা আছে- গৎ.
ইযড়সিরশ, ও ংযধষষ নব যরমযষু মষধফ রভ ুড়ঁ রহারমরষধঃব ঃযব ঐঝঈ ঊীধস ভৎড়স
ঃড়ফধু ধঃ ১০ অ. গ. ঝ. ই. উধং । আমি আমার শিক্ষক সামাদসাহেবকে স্লিপটি
দেখালাম। তিনি বললেন, 'এসেই যখন পড়েছ, দেও না। আমাকেও বলেছে।’ আমি বিনা
দ্বিধায় ১৮ মে পর্যন্ত পরীক্ষায় পরিদর্শকের কাজ করলাম। এ কয়দিনে আমি
হাঁফিয়ে উঠেছি। ভাষা বুঝি না, খাওয়া-দাওয়া গ্রহণ করার মতো নয়। আতপ চাউলের
ভাত, তরকারি ঝালে ভর্তি, সব তরকারিতে শুকনা চিংড়ি মাছ, ভালো টিফিন করার
দোকান নেই, রাস্তায় বের হতে পারি না- ছাত্র-ছাত্রী সামনে পড়লে পা ছুঁয়ে
নমস্কার করে। অথচ আমি সদ্য এম এ পাশ, ২২ বছরের যুবক। এক বিব্রতকর অবস্থা।
তাই পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর কুমিল্লায় চলে আসব। সামাদসাহেবকে বললাম। তিনি
বললেন ‘চল, প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে আসি। সন্ধ্যা সময়ে তাঁর কাছে
গেলাম। অনেক লোকজন। বসতে বললেন। অন্যেরা বিদায় হওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন-
রাঙ্গুনীয়া কেমন লাগে। আমি নির্মোহভাবে বললাম- মোটেই ভালো লাগে না-
কথাবার্তা বা ভাষা বুঝিনা। খাওয়া-দাওয়া পছন্দ নয় ইত্যাদি। আমি পরের দিন চলে
যেতে চাই, তাই জানালাম। তিনি হাসলেন। তিনি বললেন-'তোমার কোনো অসুবিধা হবে
না। খাওয়া আমার বাসা থেকে ব্যবস্থা হবে, বিছানাপত্র পাঠিয়ে দেব। তুমি যাবে
কীভাবে ২৯ মে থেকে ডিগ্রি পরীক্ষা, তোমার চাকুরি তো ১ মে থেকে শুরু হয়ে
গেছে।’ আমি গাছ নয় আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি, আমি জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জ
তোলারাম কলেজে যোগদান করার সব ঠিকঠাক। এপ্রিলে ঢাকা গিয়ে তোলারাম কলেজের
অধ্যক্ষ মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। তিনি ড. নীলিমা ইব্রাহিমের সুপারিশ
পেয়েছেন। শুধু বিধি অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও সাক্ষাৎকার নিয়ে যোগদানের
ব্যবস্থা করবেন ইত্যাদি। এখন কী কথা শুনি। আমি মিঃ দাশকে বললাম- 'আমি
এখানে এতদূরে পাড়াগাঁয়ে চাকুরি করব না। এছাড়া আমি তো দরখাস্ত করিনি।’ তিনি
দৃঢ়তার সাথে বললেন- 'এস বি দাশের কলেজে দরখাস্ত দিয়ে চাকুরি পাওয়া যায় না।
আমি যা বলি তা করি তুমি এখন থেকে আমার কলেজের স্টাফ। ঠিক আছে বাড়ি যেতে চাও
যাও, স্যারকে (আমার পিতাকে) আমার প্রণাম দিও। এই নাও, বলে পকেট থেকে ১৫০
টাকা বের করে দিয়ে বললেন- '২৬-২৭ তারিখ চলে এসো।' আমি হতভম্ব। মাথা নিচু
করে বের হয়ে এলাম। অনেকক্ষণ পর সামাদসাহেব এলেন।
আমি বললাম, 'স্যার, একি
হলো?’ স্যার একটু চুপ থেকে বললেন- 'যা হবার তা তো হয়েছে, আমিও তো আছি।
দুজনে কিছুদিন থাকি না, পরে দেখা যাবে।' আমার আর তোলারাম কলেজে চাকুরি করা
হলো না। এই রাঙ্গুনীয়া কলেজে ১ মে ১৯৬৮ থেকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত
বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেছি। এত সব কথা বললাম এই জন্য যে,
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি রাঙ্গুনীয়া কলেজের
শিক্ষক ছিলাম।
১৯৭০ সালের ৭ মে আমি বিয়ে করি। আমার স্ত্রী কুমিল্লা শহরে
অজিতকুমার গুহের বাড়ি ও গ্রামের বাড়িতে থাকায় আমি আসা-যাওয়া করি। ১৯৭০
সালে নির্বাচন, রমজান-পূজা-নির্বাচন উপলক্ষে এক নাগারে কলেজ ৭২ দিন বন্ধ।
স্ত্রীসহ আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার ২২নং
মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে ছিলাম। দীর্ঘসময় ছুটিতে বাড়িতে
থাকায় অনেকে মনে করতেন আমি বিয়ে করে চাকুরি ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছি বা আমার
চাকুরি নেই। এতদিন ছুটি থাকার কথা নয়। নির্বাচন হয়ে গেল, রাজনৈতিক
পরিবর্তনের নানা ঘটনাপ্রবাহে দেশ তখন উত্তাল, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি।
১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন। জাতি দিকনির্দেশনা পেয়ে গেলো এবং
তার ফলশ্রুতিতে ২৫ মার্চ এর কালোরাতি এবং মুক্তিযুদ্ধ। এ সময়কার ঘটনা
ঐতিহাসিকভাবেই নানাজন আলোচনা করেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন- পূর্বাপর ঘটনা
সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। আমি যেহেতু আমার কথা বলতে চাই। তাতেই সীমাবদ্ধ
থাকতে চেষ্টা করব।
(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫