কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
আমি এবং মামুন এক সঙ্গে চলতে শুরু করেছিলাম। ধূলুমাখা পথের চেয়ে ভাবনার পথে বেশি। তার গতি আবার বিভিন্ন রকমফেরের। ক্রিকেটের গতি, ফুটবলের গতি, ব্যাডমিন্টনের গতি, এবং দাবা-বলিবলের গতি। আমি এসবের সঙ্গে তাল মিলাতে পারতাম না। আমি অনেকটা পিছিয়ে ছিলাম,শুধু (টেনিস বলের) ক্রিকেট ছাড়া। নিজে প্রায়ই দর্শক। দর্শক এবং খেলোয়াড়, কে বেশি স্বপ্নবাজ? সেই সময় থেকে জানতাম খেলোয়াড় স্বপ্নবাজ। মামুনের শীত-গ্রীষ্মের সকালটা শুরু হতো ব্যায়াম দিয়ে, নাস্তা শেষে ধীরে ধীরে ক্রিকেট মাঠে। মাঠ তাকে চুম্বকের মত টানতো। হাউজিং এস্টেট ক্রিকেট মাঠ সবচেয়ে বেশি টেনেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল-শুরু হলেই বলিবল, সন্ধ্যারপর ব্যাডমিন্টন। রাতে পিতার কড়া নজর, ঘরে ঢুকতে বারণ। মায়ের প্রশ্রয়, চারটা খেয়েছে হয়তো খায়নি। পূর্বদিকের ঘরে সুরুৎ করে ঢুকে পড়েছে। মামুন কই.. মামুন কই..। মামুন নেই।
ফজরের কালে ওজুর সময় পিতার খরমের শব্দে তারও হয়তো ঘুম ভেঙেছে। তারপর আরেকটি দিন এভাবে অথবা অন্যভাবে।
এভাবে কতো শতো দিন!
জেলা পরিষদ লাইব্রেরি থেকে মামুনের পিতা মোহাম্মদ উল্লাহ সাহেব পরিবারের সকলের জন্য বই আনতেন। আমি শরৎ সাহিত্যের অর্ধেকের বেশি তখনই পড়ি । মামুনের বড় বোন খুকি আপা পড়ার পর আমরা বই নিতে পারতাম।
মামুন যেন টেক্সট বই না পড়েই এস এসসি অল্পের জন্য প্রথম বিভাগ মিস করলো। রাগ হলো তার । এইচ এসসি তে প্রথম বিভাগ নিয়ে নিলো মনের জেদে। ওই দিকে আবার লিয়াকত টেকনিকেল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং। তারপর কিছুটা সময় ঢাকায় ব্যবসা। স্নাতক পরীক্ষা প্রচণ্ড জ¦রে পুড়ে গেলো। পরীক্ষা সমাপ্ত করতে পারেনি। এতো কিছুর পর সে কেন বিদেশ যাবে? তবু বোধ হয় সেই সময় অনেকে বিদেশে যায়। ৮৬ বা ৮৭ সালের পরবর্তী কোন সময়ে দেশের অনেকের মতো মামুনও চলে গেলো। অনেক বছর পর ফিরে এসে পোশাক শিল্পে মহা ধৈর্যের পরিচয় দিলো। সংসার শুরু করলো। নিরব নিস্তব্দতার সংসার। চারদিকে এতো হৈ চৈ উৎপদন এর ভেতর গভীর প্রশান্ত তার জীবন। জোর গলায় কাউকে কোনদিন ধমক দেয়নি। উঠতি যৌবনে কনক কান্তিময় শরীর। কারো বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। শ্রম তার বন্ধু। ক্লান্তি তাকে কোনদিন আলিঙ্গন করতে পারেনি।
কিন্তু গত ২৭ মার্চ মামুন চলে গেলো না ফেরার দেশে। চলে গেলো স্ত্রী কন্যা ভাইদের রেখে। পৃথীবিতে তার ফুটফুটে তিন কন্যা। তাদের আগলে নিলো পরম মমতায় ছোট দুই ভাই মাসুম ( প্রকৌশলী মসিউর রহমান) এবং নাছির। সমকালে তার বন্ধু বান্ধবরা রয়ে গেলো বস্তু জগতে। কালের ঘটনাপঞ্জি থেকে সংবেদ ও দৃশ্যে আক্রান্ত হতে লাগলো স্বজনরাঃ তাদের বিশাল বাড়ির দীর্ঘ উঠান, আম জাম পেয়ারা কাঁঠাল জলপাই গাছসমূহ সংবেদ দিলো, ওরাও একদিন ছিল এখন নেই। পাশের পুকুরটা ভরাট করা হয়েছে। কলপাড়রে জলপাইয়ের পাতা যেমন রং বদলিয়েছে, সবুজ থেকে হলুদ- হলুদ থেকে কমলা, তারপর বিবর্ণ পৃথিবী। সময় সেভাবে তাদের বাড়িতে প্রত্যেক আগমনকারীর বয়স পাল্টে দিয়েছে। পুবে পশ্চিমের জমিনের চিকন দূর্বারাও মাঘের সর্বশেষ শিশিরে চোখ ভিজিয়ে নিয়েছে। ওরাও মামুনের জন্য কেঁদেছে নিশ্চয়।
আমি বদলে যাওয়া বাড়িটির, ‘মা বাবা নীড়’এর একবারে সামনা সামনি, ফটকের বাইরে কখনো সখনো দাঁড়াই। তার তিন কন্যার ফুটফুটে মুখ, ছুঠে বাইরে আসা, দ্রুত ভেতরে চলে যাওয়া দেখি, অবচেতনে বেশি দেখি। ভাবতে থাকি, ওরাও কী বাবার মত গণিতে, রসায়নে, জীববিজ্ঞানে, দক্ষ হয়ে ওঠবে। তিন কন্যার কেউ হয়তো কোনদিন সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত হবে না। কিন্তু মামুনের সাহায্য ব্যতিত হযরত পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্ভব ছিল না। মামুন ছিল হাউজিং এস্টেটের সঙ্গে হজরত পাড়ার মেল বন্ধনের সেতু। তখন হাউজিং খেলাঘর অত্যন্ত শক্তিশালী সংঘটন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা দর্শক। করিম স্মৃতি ক্রিকেট টূর্র্নামেন্ট-হাউজিং মাঠে কুমিল্লার প্রায় সকল ক্রিকেটারদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, সব জায়গায় মামুন।
উইকেট কিপিংয়ে দক্ষ মামুন যেন নিজের প্রাণকে নিজে ধরে ফেললো।
মৃত্যু যেন শব্দহীন সঙ্গীতের মতো। যে পৌঁছে সে ছাড়া অন্য কেউ শুনতে পায় না। মামুন দেখছিল, সে চলে যাচ্ছে,জগতের সঙ্গে সকল যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসেছে। অপার এক টানে চলে যাচ্ছে। চলে যেতে প্রকৃতিও হাত বাড়িয়েছে, আরও প্রলম্বিত করেছে আপন স্কাল, ঢুকে পড়েছে চিন্তার আধারে, গ্রে ম্যাটারে, টুকরো টুকরো হয়ে। বিদায়ের কী অপূর্ব আয়োজন। হজরত পাড়ার মানুষজন, তাদের অন্তর হায় হায় করে ওঠলো।
কচি তিনটি মুখ তাদের পিতার বিদায় দেখলো।
তার এ চলে যাওয়া মানা যায় না। জানি না এর কোথায় কল্যাণ রয়েছে। তিনি একমাত্র জ্ঞাতা, তিনি জানেন কী ঘটবে, তারপর এবং তারপর।
আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ, যিনি পরম এবং সব কিছুর মালিক। যিনি জানেন মামুনের তিন কন্যার দৃশ্য-অদৃশ্যমান চেষ্টা ও ভাগ্যের সমস্ত। তাদের মঙ্গল কামনায়...।