খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ||
বেশ কয়েক মাস ধরে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জনজীবনে দুর্বিষহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। গত মাসের সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্টম্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। আগামী মাসে এটি হয়তো আরও বাড়বে। সম্প্রতি চলমান রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বাজারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আমরা দেখেছি, রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন রাষ্ট্র বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করেছে। এতে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক কারণেই বাজারে পড়বে। যুদ্ধ হয়তো শিগগিরই থেমে যাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সহজে উঠবে বলে মনে হয় না। ফলে আগামী দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সরবরাহে সংকট তৈরি হবে। যার মূল্য আমাদের দিতে হবে।
রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণে সার আমদানি করে। এই সংকটকালে যদি সার আমদানি বন্ধ থাকে, তাহলে দেশে সারের সংকট তৈরি হবে। এমনকি সারের দাম বেড়ে যাবে। এর ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাব বাজারে পড়বে। বেশি দাম দিয়ে সার কিনে ফসল উৎপাদন করলে সেই ফসল যখন বাজারজাত করা হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি এড়াতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে বাজারে খাদ্য সরবরাহ কমে যাবে। তখন পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ পাওয়া যাবে না। এ সময় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে মজুত করার প্রবণতা বাড়বে। তারা আমদানি কমিয়ে দিয়ে মজুতের দিকে মনোযোগী হবে। এসব কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে। বাজারে যদি পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ না থাকে তাহলে স্বাভাবিক কারণেই দাম বাড়বে। অর্থনীতির ভাষায় সবাই জানেন, চাহিদার তুলনায় জোগান না এলে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়।
কয়েক সপ্তাহ পর রমজান মাস। আমরা অতীতে দেখেছি, রমজান মাসে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ সময় খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে করি না। রমজান সামনে রেখে ভোক্তাদের সামনে নতুন খক্ষ আসছে। তাদের আবার বর্ধিত বাজারমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হবে। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির জন্য তিনটি কারণকে চিন্থিত করা যায়। বৈশ্বিক সীমাবদ্ধতা, উচ্চমূল্যের কারণে পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি না নেওয়ার মানসিকতা ও পণ্য মজুত রেখে বাড়তি লাভের প্রবণতা। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি চলছে। এ সময় দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় উৎপাদন কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়েছে- এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদিও মহামারির পর আবার বিশ্ব ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এখানে আবার নতুন সংকট হয়ে সামনে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপাত।
দাম বাড়ার পরের কারণ দুটি আমাদের মানসিকতার কারণে হচ্ছে এবং এটি সমাধানযোগ্য। বিশেষ করে শেষ কারণটি অর্থাৎ পণ্য মজুত করে বাজারে সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে ব্যবসায়ীদের বের হয়ে আসতে হবে। এ জন্য তদারকি বাড়াতে হবে। যাতে কোনো অসৎ ব্যবসায়ী চক্র এ কাজটি করতে না পারে, সে জন্য সরকারকে তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তদারকি করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। তবে সরকারের একার পক্ষে এ চক্রকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে না। এ জন্য অন্যান্য ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে যদি নৈতিকতাবোধ জাগ্রত না হয়, তাহলে এটা ঠেকানো অত সহজ হবে না। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে লোকসানের আশঙ্কায় আমদানি করতে চাইবে না। এ অবস্থায় সরকার অর্থায়ন করে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি সচল রাখতে পারে। তাহলে আর ব্যবসায়ীরা লাভ-লোকসানের ঝুঁকিতে পড়বে না।
বাজারের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে করণীয় হিসেবে আমার সুপারিশ হচ্ছে, পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রেখে বাজারে অস্থিরতা বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি আমদানিকারকদের আমদানিতে উৎসাহ দিতে হবে। সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা দেখি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে পণ্য কিনে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। এর পাশাপাশি সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের টাকা বিনিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করা। এতে ব্যবসায়ীরা স্বস্তি পাবে। তাদের ঝুঁকি কমবে। এক কথায় সরকার যদি লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে তাহলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
দ্রব্যমূল্য কমা আর বাজার স্থিতিশীল রাখা এক জিনিস নয়। বাজারে যদি পর্যাপ্ত পণ্য মজুত না থাকে তাহলে বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন পণ্যের দাম বেশি, তখন আমাদের বাজারে দাম কমার আশা করা যায় না। কিন্তু পর্যাপ্ত আমদানি করে বাজারে ঘাটতি পূরণ করে রাখতে হবে।
সম্প্রতি সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। সয়াবিন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে বলেই আমাদের দেশীয় বাজারকে সমন্বয় করতে হচ্ছে। আমরা তো এ তেল উৎপাদন করে চাহিদা মেটাতে পারছি না। যেহেতু বিদেশ থেকে কিনে এনে আমাদের চলতে হচ্ছে, তাই কেনা দামের সঙ্গে সমন্বয়ের বিকল্প নেই। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারণে কষ্ট হচ্ছে- এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাদের কষ্ট লাঘবে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
করোনার সময় আমরা দেখেছি, সরকার ১০ লাখ পরিবারের মাঝে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে প্রণোদনা দিয়েছে। এই প্রণোদনা বা ঈদ উপহার আবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আসন্ন রমজানে ৬টি পণ্য খোলাবাজারে (ওএমএস) ন্যায্যমূল্যে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রমজান পর্যন্ত অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব এসব পণ্য বাজারে বিক্রি শুরু করে দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে পারে সরকার। প্রয়োজনে ছোলা ও খেজুর বাদে অন্য ৪টি পণ্য তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ এখনই বিক্রি শুরু করা যেতে পারে।
এ মুহূর্তে কোনোভাবেই জ্বালানির দাম আর বৃদ্ধি করা যাবে না। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনসাধারণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। এসব জিনিসের দাম বাড়ালে মূল্যস্টম্ফীতির চাপ বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় আরও কমবে। সরকারের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে এই বাজারমূল্যের সময় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ালে জনসাধারণ সেই চাপ কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
জানি সরকারকে নানা খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেই অর্থ সমন্বয় করতে গিয়ে কোনোভাবেই উপরোল্লিখিত জিনিসের দাম বাড়ানো যাবে না। সরকার প্রয়োজনবোধ করলে চাপ সামলাতে আন্তর্জাতিক খাত থেকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ নিতে পারে। ২০০৭ সালে সরকার ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। ২০১৮ সালেও ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ অবস্থায়ও সরকার এ ধরনের ঋণ নিয়ে হলেও সাধারণ মানুষকে বাড়তি চাপ থেকে নিরাপদ রাখতে পারে। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ছাড়াও সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত থেকে এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে পরে দীর্ঘমেয়াদে সমাধান আনা যেতে পারে।
বাজার স্বাভাবিক রাখার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক কমিটি করা যেতে পারে। তারা নিয়মিত বাজার তদারকি করে মূল্যায়ন দেবে। পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে এই তদারকি কমিটি করতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজার না বুঝে দেশীয় বাজার নিয়ে কাজ করে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক করা যাবে না।
আরেকটি কথা বলে শেষ করতে চাই। পণ্য আমদানিতে শুল্ক্ক কমিয়ে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এতে বরং ব্যবসায়ীদের পকেটে অতিরিক্ত টাকা যাবে। কিন্তু সাধারণ ভোক্তারা লাভবান হবে না। বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক করা গেলেই সাধারণ মানুষ সুফল পাবে। তবে আপাতত দাম কমার সম্ভাবনা না থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রণোদনার বিকল্প দেখছি না। একই সঙ্গে খোলাবাজারে দ্রুত পণ্য বিক্রি শুরু করে দেওয়া উচিত।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম :গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)