প্রভাষ আমিন ||
রোজা মুসলমানদের পাঁচ ফরজের একটি। প্রতিবছর রমজান আসে রহমত, বরকত, আত্মত্যাগ আর আত্মশুদ্ধির বার্তা নিয়ে। রমজান এলেই পাল্টে যায় বাংলাদেশের চিত্র। বদলে যায় অফিস সময়। বদলে যায় রাস্তাঘাটের ছবিও। হোটেল-রেস্তোঁরা দিনের বেলা বন্ধই থাকে। অল্প কিছু খোলা থাকলেও থাকে অবগুণ্ঠনে ঢাকা। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানও থাকে পর্দা ঢাকা। অন্য সময় রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রমজানেও খোলা আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রমজান আসে চাঁদের হিসাবে। তাই বাংলাদেশে প্রতিবছরই রোজার সময় একটু একটু করে বদলে যায়। কোনও বছর শীতকালে রোজা হয়, কোনও বছর ভরা বর্ষায়। এবার রোজা পড়েছে ভরা চৈত্রে। এবারের রোজার সময়টা রোজাদারদের জন্য একটু কষ্টকরই। সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত ন্যূনতম ব্যবধান ১৪ ঘণ্টা। এবার এই ১৪ ঘণ্টার সময়টা কাটছে তীব্র, অসহনীয় গরমে। কিন্তু একজন প্রকৃত মুসলমানের কাছে এই ১৪ ঘণ্টা সময় বা তীব্র দহন কোনও বিষয় নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তারা সব কষ্ট মেনে নেন হাসিমুখে। অনেকে ভাবেন, যত কষ্ট, তত সওয়াব। তাই রোজার কষ্ট তাদের কাছে কোনও কষ্টই নয়।
প্রকৃতির ওপর আমাদের কোনও হাত নেই। কিন্তু এর বাইরে রমজানের সময়টা একটু সহনীয় করা অসম্ভব নয়। কিন্তু আমরা যেন নেমেছি মানুষকে কতটা কষ্ট দেওয়া যায়, সেই প্রতিযোগিতায়। ঘরে-বাইরে এক অসহনীয় সময় পার করছে বাংলাদেশের মানুষ। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে আলোচনা রোজা শুরুর অনেক আগে থেকেই। রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় মাত্রায় থাকার আশ্বাস মিললেও বাস্তবায়ন মেলেনি। গত দুই মাসের বিবেচনায় কিছুটা কমলেও নিত্যপণ্যের দাম এখনও আগের অবস্থায় পৌঁছায়নি। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আগের অবস্থায় আর কখনোই পৌঁছাবে না। অবস্থাটা সেই কৌশলি ডিসকাউন্টের মতো। রমজানের আগে ২০০ টাকা দাম বাড়িয়ে, ঈদের সময় ১০০ টাকার বিশাল ডিসকাউন্টের ফাঁকিটা অনেকেরই অজানা নয়। তেমনি নিত্যপণ্যের দাম রমজানের দুই মাস আগে চূড়ায় উঠে এখন কিছুটা নেমে আসাকে সহনীয় মাত্রা বলে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছুই করছে না, এমন দাবি আমি করছি না। কিন্তু এটা মানতেই হবে সরকার সময়ের কাজ সময়ে করতে পারেনি। ভোজ্যতেলের বাজার যখন তেলেসমাতি চলছিল, তখনও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু করেনি। ভোজ্যতেল আমদানির শুল্ক যখন কমানো হয়েছে, ততদিনে তেলের বাজার উঠে এবং নেমে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। আর নতুন শুল্কে আমদানি করা তেল এখনও বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি।
দুই মাস আগে যদি শুল্ক পুনর্বিন্যাস করা হতো, তাহলে সাধারণ মানুষ এর কিছুটা সুফল পেলেও পেতে পারতো। এখন লাভ যা হবে ব্যবসায়ীদের। এটা ঠিক আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশে তার প্রভাব পড়বেই। কিন্তু যেসব পণ্য দেশেই উৎপাদিত হয়, রমজান এলেই তার দাম আকাশ ছোঁয় কেন? মঙ্গলবার প্রথম আলোর একটি শিরোনাম, ‘আড়ত থেকে বের হলেই ২ টাকার লেবু হয়ে যায় ১০’। পত্রিকা খুঁজলে এমন একশোটা শিরোনাম পাওয়া যাবে। সম্পূর্ণ দেশে উৎপাদিত খিরা, শসা, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনে পাতার মতো পণ্যও কেন রোজা এলেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে? বিশ্বের সব দেশেই ধর্মীয় উৎসবে সব পণ্যে বিশাল ছাড়া দেওয়া হয়। আর বেশি বিক্রি হলে লাভের পরিমাণ অল্প হলেও শেষ হিসাবে ব্যবসায়ীদের লাভই হয়। কম লাভ, বেশি বিক্রি, বেশি লাভ– এই থিউরিটা আমাদের ব্যবসায়ীরা বোঝেন না নাকি জানেন না। জানেন ঠিকই কিন্তু তারা একবারে ব্যবসাটা করে ফেলতে চান। এই যে ব্যবসায়ীরা সারা দিন রোজা রেখে মানুষকে ঠকাচ্ছেন, তাদের মনে কি আল্লাহর ভয় নেই। আন্তর্জাতিক বাজার বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু দেশে বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর মনিটরিং, পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে দ্রব্যমূল্য আরও কমিয়ে রাখা সম্ভব হতো। সেই সম্ভব কাজটাও আমরা ঠিকমতো করতে পারিনি।
বাজার থেকে রাস্তায় নামলেই সবকিছু স্থবির। বাজার তবু চলে, রাস্তা তো একদম অচল। করোনার ভয় কাটিয়ে সব স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই রাস্তা অস্বাভাবিক। মানুষের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে রাস্তায়। সকালের ঘুমটা আমি এখন রাস্তায় ঘুমাই। মোহাম্মদপুর থেকে কাওরানবাজার আসতে দুই ঘণ্টাও লাগে। যারা উত্তরা থেকে মতিঝিলে অফিস করতে চান, তাদের নিশ্চয়ই সেহরি খেয়েই রওনা দিতে হয়। ফেরার সময় আরেক যুদ্ধ। ঢাকায় প্রতিদিন কত মানুষকে রাস্তায় ইফতার করতে হয় তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এই অচল রাস্তায়ও দুর্ঘটনার বিরাম নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন আমাদের নিত্যদিনের শোক।
রাস্তায় দিনভর যুদ্ধ করে বাসায় ফিরে আরাম করে ইফতার করবেন, সে জোও নেই। প্রথম রোজা থেকেই ঢাকায় গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক বাসায় ইফতার বানানোর মতো গ্যাস ছিল না। হোটেল থেকে কিনে এনে ইফতার বা সেহরি করার মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা সইতে হয়েছে এবং হচ্ছে অনেককে। কোনও কোনও এলাকার অবস্থা এতটাই খারাপ, হোটেলেও খাবার নেই। খেয়ে না খেয়ে রোজা রাখতে হচ্ছে অনেককে। জানা যাচ্ছে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে সমস্যার কারণে গ্যাস সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কবে এই সংকটের সমাধান হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউই। গ্যাস সংকটের কারণে টান পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও। শতভাগ বিদ্যুতায়িত দেশেও এখন বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলা চলছে।
গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই; সারা দিন রোজা রেখে একটু বিশুদ্ধ পানি খাবেন, সে উপায়ও নেই। ওয়াসার এমডির বেতন আর চাকরির মেয়াদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। কিন্তু তাদের সরবরাহ করা পানির শুদ্ধতা নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন আছে। ঢাকায় যে এখন ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব, তার জন্য ওয়াসার পানিকেই দুষছেন অনেকে। ওয়াসার এমডি নিজেই স্বীকার করেছেন, তার বাসার পানিতেও গন্ধ আছে। গ্যাসের দাম বাড়বে, বিদ্যুতের দাম বাড়বে, পানির দাম বাড়বে; বাড়তি বিলও দেবেন। কিন্তু সময় মতো সব সরবরাহ পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বাজারে আগুন, রাস্তায় জট, চুলায় গ্যাস নেই, ওয়াসার লাইনে বিশুদ্ধ পানি নেই, বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলা চলছে- এত সমস্যার মধ্যেও মানুষ তীব্র গরমে ১৪ ঘণ্টার রোজা রাখছে। অসীম ধৈর্যের জন্য বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই বিশেষ পুরস্কার পাবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ