জুলফিকার নিউটন ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
১৮
আমাদের বাড়িতে একজন সাধু পুরুষকে প্রায়ই দেখতাম। দিব্যকান্তি অত্যন্ত উজ্জল প্রফুল্ল পুরুষ। তিনি আমার এক নানার কাছে দীক্ষা লাভ করেছিলেন। তার বাড়ি ছিল বক্রিকান্দি। তার নাম মানিক ফকির। যে সময়ের কথা বলছি তখন তিনি দাউদকান্দির একটি বাসায় থাকতেন। সেখানে বৈঠকখানায় ফরাস পেতে প্রতিদিন সকালে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বসতেন। একদিন বিলেত-ফেরত এক ভদ্রলোক স্যুট পরিহিত অবস্থায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এল। মানিক ফকির তাকে তাড়াতাড়ি একটি চেয়ার এগিয়ে দিলেন। কিন্তু কয়েকদিন আসা যাওয়া করতেই লোকটির মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল। একদিন ভদ্রলোক পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে ফরাসে এসে বসলেন এবং লজ্জিতভাবে বললেন হুজুর আমি এ কয়দিন স্যুট পরে এসে বেয়াদবী করেছি, আপনি আমাকে মাফ করবেন।' মানিক ফকির বললেন বাবা পোশাকে কি আসে যায়, মনটাই তো আসল। তোমার মনই তোমাকে বলে দেবে তুমি কিভাবে চলবে। তবে পোশাক যে একেবারে প্রভাব বিস্তার করবে না তা নয় কিছুটাতো করেই। ধরো তুমি শান্তিপুরী ধূতি পরে রেশমের চাদর কাঁধে রেখে ঠনঠনে চটি জুতা পায়ে দিয়ে, হাতে একটি বেত নিয়ে যদি পথ চলতে থাকো তোমার মুখে নিধুবাবুর টপপাই আসবে, আল্লার নাম নয়। ভদ্রলোক এহেন বিশ্লেষণ শুনে খুবই লজ্জিত হয়েছিলেন, পোশাকের অভিমান তার দূর হয়েছিল। মানিক ফকির যেখানে থাকতেন তার পাশে কয়েক ঘর বারবণিতা থাকতো। এদের মধ্যে একটি অল্পবয়স্কা যুবতী প্রতিদিন তার বাড়ির সামনে দিয়ে পুকুরে গোসল করতে যেত। এবং ফিরতি পথে মানিক ফকিরের বৈঠকখানার ভেতরে জানালা দিয়ে উঁকি দিত। সে তন্ময় হয়ে দেখতো যে ধবধবে সাদা ফরাসের উপর কয়েকজন মানুষ ধ্যানরত অবস্থায় মাথা নিচু করে বসে আছে। একদিন মানিক ফকির মেয়েটিকে দেখে ফেললেন। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন মা তুমি কি চাও? মেয়েটি বললো বাবা আমি পাপী আমি মুক্তি চাই। মানিক ফকির বললেন মা মানুষ কখনো পাপী হয় না। পাপ হচ্ছে এক রকমের অসুখ। শরীরকে অপরিচ্ছন্ন রাখলে রোগ হয়। মনকে অপরিচ্ছন্ন রাখলে পাপ সেখানে এসে আশ্রয় নেয়। এই মেয়েটি পরে পাপের পথ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে যায় এবং মানিক ফকির একজন বিপত্মীক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন।
যেহেতু পৃথিবীতে মানুষের অবস্থিতি চিরকালের জন্য নয় সুতরাং এই অবস্থিতিকে সমপূর্ণ এবং বিনয়ে ও আত্মত্যাগে সমৃদ্ধ করা আমাদের কর্তব্য। আমার শৈশবে যে পরিমণ্ডলে আমি মানুষ হয়েছিলাম সেখানে ত্যাগের কথা সহিষ্ণুতার কথা বিনয়ের কথা অহমিকাশূন্যতার কথা শুধু যে শুনতাম তাই নয়, জীবনক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকের মধ্যে এগুলো প্রত্যক্ষ করেছি। বাবার কাছে জ্ঞান সম্পর্কে শুনেছি। তিনি বলতেন, 'মানুষ কখনো জ্ঞানী হতে পারে না, যথার্থ জ্ঞানী যে সে আজীবন জ্ঞানার্থ থাকে। কেননা আমি যদি নিজেকে জ্ঞানী মনে করি, তাহলে আমার জ্ঞান লাভের আকাক্সক্ষা আর থাকবে না। কিন্তু জ্ঞানার্থী যদি মনে করি তাহলে নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য সর্বদাই ব্যাকুলতা থাকবে। আমরা নয়ন দিয়ে রসনা দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করি না, আমরা হৃদয় দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করি। মানুষ যেদিন সর্ব অভিমান ত্যাগ করে হৃদয়ের নিষুণ্ঠ কামনায় আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হবে সেদিনই তার যথার্থ মুক্তি ঘটবে। আমার বাবা-মা দারিদ্রের মধ্যে থেকে সদা প্রফুল্ল থাকতেন এবং একটি সততা ও সম্রমে জীবনযাপন করেছিলেন। যদি তাদের মত হতে পারতাম তাহলে একটা নিশ্চিন্ত থাকতো যে জীবনে অসম্ভবকে মান্য করিনি। কিন্তু সে কথা কি আজ বলতে পারি? চিরকাল শুনে এসেছি মানুষের জীবনে সকল অনুষ্ঠানের মূলে তিনটি আদর্শ আছে-একটি হচ্ছে জ্ঞান দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সংকল্প এবং সর্বশেষটি হচ্ছে প্রেম। মানুষ যদি আল্লাহর উপর নির্ভর করতে পারে তাহলে নির্ভরতারূপ জ্ঞানের সাহায্যে সংসারের দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে। ফলে লাভের বাসনা যদি পরিত্যাগ করা যায় তাহলে কর্মসাধনের সংকল্প শুদ্ধ হয় এবং প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর বিধিতে সম্মত হলে আনন্দ লাভ করা যায়। এ মুহূর্তে চুর্তুদিকে দৃষ্টিপাত করে এ আদর্শকে আর দেখি না। সন্ত কবীর তার একটি দোহাঁয় বলেছেন, পানির মধ্যে মীন বা মৎস্য পিপাসার্ত একথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে। ঘরের মধ্যে বস্তু রয়েছে কিন্তু তার সন্ধানে উদাসী বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আত্মজ্ঞান ব্যতীত সমস্ত পৃথিবী তো মিথ্যা। মথুরা কিংবা বৃন্দাবনে গেলেই সত্যকে পাওয়া যাবে না। ক্ষিতিমোহন সেনের একটি রচনায় কবীরের এ উদ্ধৃতি পেয়েছিলাম। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে তার আত্মজীবনী থেকে পর্বতের বর্ণনাসূচক একটি অধ্যায় উৎকলিত হয়েছিল। সেখানে পানিমে মীন পিয়াসী’ এই বাক্যটি পেয়েছিলাম। অন্যান্য চরণগুলি আমি পরে অনুসন্ধান করে খুঁজে পাই। আমার যদ্দুর মনে হয় আমাদের স্কুলের সংস্কৃত পণ্ডিত অবিনাশ পোদ্দার কবীরের দোহাটি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কাছে তখন কোলরীজের ইংরেজি কবিতা প্রাচীন নাবিক মনে জেগেছিল। সেখানে দুর্গম সমুদ্রপথে মানুষ পিপাসার্ত হয়েছে কিন্তু সমুদ্রের লবণাক্ত পানি পান করতে পারছে না। চতুর্দিকে শুধু পানি, অর্থই পানি, কিন্তু পান করবার জন্য এক বিন্দু পানিও নেই। কবীর অবশ্য অন্য কথা বলেছিলেন, সেটি বুঝেছি বড় হয়ে। মানুষ যখন পর্যাপ্ততার মধ্যে থাকে তখন সে নিশ্চিন্ত থাকে, তার যথার্থ যে কি আছে সে জানে না। সে অনুসন্ধান করতে থাকে বাইরে এবং অনুসন্ধানে সে ব্যর্থকাম হয়। মূলত এভাবে স্বরাজ্যে আমরা বঞ্চিত, অন্য রাজ্যে আমরা নিজেদের খুঁজে ফিরি। প্রভূত পানির মধ্যে মাছ যদি পিপাসার্ত থাকে তাহলে সে মাছের মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি সব কিছুর মধ্যে থেকেও যদি না জানি কোথায় আমার প্রাপ্য বস্তু তাহলে সেটা তো আমার মৃত্যুর মতোই হলো।
কৈশোরে একাকী ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে নদীতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। লোকেরা সন্ধান করে আমাকে না পেলে আমি নিঃশেষ হয়ে যেতাম। তাই জীবন নদীর প্রতি আমার আকর্ষণ প্রবল এবং নদীকে নিয়ে আমার ভয়ও অনেক স্কুলেই সমুদ্রের কথা প্রথম পড়ি এবং সমুদ্র দেখবার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু শৈশবে বা কৈশোরে সমুদ্র আমি দেখতে পারিনি। তখন বর্ষাকালে বাংলাদেশের প্রমত্তা নদীকূলকে দেখে তার মধ্যেই সমুদ্রের সন্ধান আমি করেছি। বর্ষাকালে নদীর দিকে তাকালে শুধু সম্মুখগামী স্রোতধারাই দেখা যায়। ঢেউ তুলে নদীর স্রোতগুলি সামনে এগিয়ে চলেছে, বাতাসে কখনো কখনো ঢেউ উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়ে ফেটে গিয়ে পানির কণা ছিটাচ্ছে। নৌকোগুলো দুলে উঠছে এবং কোথাও কোনো অসচল স্তব্ধতা নেই। তখন শুনতাম সমুদ্র এ রকমই এবং এর চেয়েও অজস্র গুণ বেশী। তাই বোধহয় প্রাচীন আর্য ঋষিগণ বার বার সমুদ্রের স্তব করেছিলেন। সমুদ্র কোনো বন্ধন মানে না, কোনো বিপাক তাকে বিচলিত করে না, সকল প্রকার কল্যাণ, অসদ্ভাব, গ্লানি ও আবর্জনাকে সমুদ্র বিতাড়িত করে। সমুদ্রের যাত্রা অসম্ভব সুস্পষ্ট, অসম্ভব তীব্র এবং সর্বতোভাবে অসম্ভব রকম সত্য। পৃথিবীতে সব কিছু জীর্ণ হয়, হারিয়ে যায়, প্রাচীন সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়, বিমূঢ় লোকালয় নিঃশেষ হয় কিন্তু সমুদ্রের কোনো শেষ নেই। সমুদ্র সর্বদাই স্বতন্ত্র, স্বয়ম্ভ এবং নিশ্চিন্ত আমি বর্ষাকালের পদ্মাকে দেখে সমুদ্রের কথাকে ভাববার চেষ্টা করেছি। তখন আমার ভাবনায় সমুদ্রের যে চিত্র উদঘাটিত হতো বড় হয়ে সমুদ্র দেখে সমুদ্রের প্রবাহের মধ্যে। সেই চিত্রকেই নতুন করে প্রত্যক্ষ করেছি।
কবীরের আর একটি দোহা ক্ষিতিমোহন সেনের রচনায় পাঠ করেছিলাম। সেখানে কবীর বলছেন, রুক্ষ সূক্ষ্ম গমের রুটি আমার কাছে আছে, তাতে লবণ আছে কি নেই এটা ভেবে কি লাভ? যদি কাউকে হৃদয়ে পেয়েই থাকি তবে তাকে হারাবার ভয় কেন? যে আঁখিতে ঘন হয়ে এসেছে তার জন্য তাকিয়াই বা কি, শয্যাই বা কি? যদি মস্তক দিয়ে থাকি উৎসর্গ করে তাহলে আর ক্রন্দনের প্রয়োজন কোথায়? অথৈ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অথবা নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে সেই স্রোঁতোপ্রবাহে যদি ভেসে যেতে ইচ্ছা করে তাহলে বিচার বিবেচনাকে বাদ দিয়েই সে ইচ্ছাকে সফল করতে হয়।
চলবে...