অজয় দাশগুপ্ত ।।
সিডনিতে ইউক্রেন ডাক্তারদের বেশ সুনাম। সবাই জানেন তারা ভালো চিকিৎসক। ইউক্রেন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গ, তখনো আমাদের দেশের যুবক-যুবতীরা সেখানে পড়তে যেতেন, বিশেষত চিকিৎসাশাস্ত্রে। আজ যখন ইউক্রেন যুদ্ধে ভয়াবহ আক্রান্ত এবং সবকিছু ল- ভ-, তখনো আমরা শুনছি বাংলাদেশি ডাক্তার আর ওপার বাংলার মেডিক্যাল ছাত্রের করুণ সব কাহিনি। এসব কাহিনি এখন পুরো দুনিয়াকে আলোড়িত করছে। সিডনি একটি বহুজাতিক মানুষের আবাসভূমি। এখানে দুনিয়ার সব দেশের মানুষ বসবাস করে। তাই আন্তর্জাতিক মতামত কিংবা অভিমত যা-ই বলেন, তা পাওয়া সম্ভব। রাশিয়ার অনেক মানুষও আছে এখানে। রাশিয়ার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক সব সময় ওঠানামার। এই ওঠানামার কারণ হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি।
আমাদের এই দেশ মূলত ব্রিটেন-আমেরিকার ছায়াসঙ্গী। পররাষ্ট্রনীতিও চলে ওই পথে। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার সরকার ইউক্রেনের সঙ্গে আছে, থাকবে। ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞা জারির সক্রিয় অংশ হয়েছেন তারা। এই নিষেধে রাশিয়ার কী লাভ, কী লোকসান- এ হিসাব হবে পড়ে। কিন্তু সিডনি ফুঁসছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ বিষয়টিই সভ্যতার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ হুঙ্কার। সিডনি কেন তা মানবে? একটা কথা বলে রাখা ভালো, এ কারণে কারও বিরুদ্ধে বা কোনো জাতির বিরুদ্ধে ঘৃণা নেই। রাশিয়ার জনগণের জীবন এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ। পুতিন সরকারের আগ্রাসনের নিন্দা থাকলেও রাশিয়ার জন্য নেই কোনো ঘৃণা বা রাগ।
আজকের এই যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে তরুণদের। তারুণ্য এমনিতেই করোনায় ক্লান্ত। সিডনি এখনো ওমিক্রনের ধাক্কায় ধুঁকছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সংগ্রামে অর্থনীতি যখন একটু করে উঠে দাঁড়াচ্ছে, তখন এই যুদ্ধ ছিল একেবারে অনভিপ্রেত। কী তার কারণ বা কে দায়ী, সেটি বড় বিষয় নয়, বড় ব্যাপার মানুষের ভবিষ্যৎ। এ জায়গাটি আবার আক্রান্ত আজ। এমনিতেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় সবার। কাজকর্ম, জীবন- সব আছে তোপের মুখে। এর ওপর এই যুদ্ধ। তা মানুষকে আবার পিছিয়ে দেবে অনেক বছর। আমি কথা বলে দেখেছি, যুক্তিতর্ক সবকিছুর ওপরে মানুষ চায় শান্তি। পুতিন যা করছেন, তা যেমন কেউ সমর্থন করেন না- তেমনি আমেরিকার এসব ভেলকিবাজিও মানুষের অপছন্দ। কাউকে যুদ্ধের উসকানি দেওয়া বা তাকে প্ররোচিত করাও সমান অপরাধ। আমেরিকার কাজই হচ্ছে যুদ্ধ প্রলম্বিত করা। বলা হয়- তারা হারজিতের জন্য যুদ্ধে যায় না, যায় অস্ত্রের ব্যবসা করতে। অন্যদিকে রাশিয়া আফগানিস্তান ছাড়া আর কোনো দেশ থেকে কখনো ফিরে আসেনি। তারা জিতে ফেরে- এটি ইতিহাস। কিন্তু আজ যে যুদ্ধ, এর জয়-পরাজয় বড় বিষয় নয়- দুনিয়াকে আবারও নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে এই অনভিপ্রেত সমর।
অচিরেই বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ দেখব আমরা। যতদূর জানি, বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরাও প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। মানুষ শান্তি আর নিরাপদ জীবনের জন্য লড়াই করবে- এটিই তো সবার চাওয়া। সিডনির নীরব প্রতিবাদ রাশিয়ার ভাবমূর্তিকে ইতোমধ্যে বিপাকে ফেলেছে। এখন দেখার বিষয় কত তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হয় আর কত দ্রুত নিরাপদ বাসভূমিতে ফিরতে পারে মানুষ। এগিয়ে যাওয়া আজকের এই দুনিয়ায় শরণার্থী ব্যাপারটি বড় বেমানান। এটি মানা যায় না। মানা যায় না বলেই খোদ রাশিয়ায় চলছে প্রতিবাদ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় জড়ো হন হাজারো রুশ নাগরিক। ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের প্রতিবাদে স্লোগান দেন তারা। বিক্ষোভকারীরা বলেন, যুদ্ধের পক্ষে নন সাধারণ রাশিয়ানরা। এদিনও বিক্ষোভ কর্মসূচির দায়ে আটক করা হয় অনেককে। টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, এক হাজার আটশর বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ। গ্রিসের এথেন্সে রুশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ জানান হাজারো বিক্ষোভকারী। ইউক্রেনের সহায়তায় এগিয়ে না আসায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র নিন্দা জানান তারা। রুশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে লাতিন দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে। কিয়েভ থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় বিক্ষোভে। ইউক্রেনে হামলার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্জিয়া, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডও।
আজকের পৃথিবীতে মানুষ যখন উন্নয়ন আর ভালোবাসায় এক হতে চাইছে, তখন এমন হামলা আরও একবার মনে করিয়ে দেয় মানুষ কতটা অসহায়। সিডনি বা ঢাকা- যে যেখানে সবার এক প্রশ্ন, এক জিজ্ঞাসা এর শেষ কোথায়? আসলেই এর শেষ কোথায়? যুদ্ধ, সংঘাত, মানুষের জীবনহানি আমাদের দেশের মতো সব দেশের মানুষকেও উদ্বিগ্ন করে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে ধাবমান। কিন্তু আমেরিকা, চীন বা রাশিয়া যখন একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ, সংঘাত ও দ্বন্দ্বে জড়ায়- তখন বাংলাদেশও চিন্তিত হয় বৈকি। কারণ সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার এবং তা মেনে চলা কারও একার কাজ হতে পারে না। এ জন্য চাই সবার সহযোগিতা। ওই জায়গাটিই এখন বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি।
বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছে রাশিয়া। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি আমদানি করে থাকে রাশিয়া থেকে। তা ছাড়া এখন তৈরি পোশাকশিল্পের নতুন বাজার হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকে। কিন্তু ইউক্রেনের ওপর হামলার জেরে রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের ওপর? রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি। আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য। এর বেশিরভাগই খাদ্যপণ্য। ইউক্রেনের সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। আছের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ফলে সমীকরণ সহজ কিছু নয়।
সিডনিতে আমরা নিরাপদ বা দেশের মানুষও এই যুদ্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু থেকে যাচ্ছে গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক দুর্ভাবনা। এর পরিণাম টানতে হবে পুরো বিশ্বকে। যেভাবেই হোক শান্তি আর সহাবস্থান নিশ্চিত করাই এখন মানুষের চাওয়া। মানুষ করোনা মহামারীর ভয়াবহ তাণ্ডবে দিশাহারা। তারা আর কোনো নতুন উৎপাত মানতে নারাজ। লেনিনের দেশকে এটি বুঝতে হবে, মানতে হবে আমেরিকাসহ ইউক্রেন বা অন্যদেরও। যত তাড়াতাড়ি শান্তি ফিরে আসে, ততই মঙ্গল।
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক, সিডনি