নগর কবি ফকরুল হুদা হেলাল
কবি ফকরুল হুদা হেলাল ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন কুমিল্লার তৎকালীন মহকুমা চাঁদপুরের মতলব থানার একলাছপুর গ্রামে মামাবাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে।
তাঁর অগ্রজ বিশিষ্ট ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং বিলুপ্ত সাপ্তাহিক মাতৃভূমি পত্রিকার সম্পাদক মাইনুল হুদা দুলাল। তাঁর অনুজ বদরুল হুদা জেনারেল । জেনু সকলের প্রিয়ভাজন ক্রীড়া সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী। তিনি একজন পরিশীলিত বাচনশিল্পী। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তিন ভাই-ই আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাশীল।
কবি ফখরুল হুদা হেলালের উত্থান মূলত মঞ্চনাটক বা থিয়েটারের অভিনয়শিল্পী হিসেবে সেই উন্মাতাল ১৯৬৯ সালে। অসহযোগ আন্দোলনের সময়। নগর মিলনায়তনের রঙ্গমঞ্চে ‘পাহাড়িফুল’ নাটকে এদেশের প্রতিষ্ঠিত অভিনয় শিল্পীদ্বয় ব্যক্তিজীবনে দুবোন আনোয়ারা ও নার্গিসের সঙ্গে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এমনকি নিজেও শিশু-কিশোরদের জন্য ‘মণিমালা’ নামে নাটক লিখে এবং নির্দেশনা দিয়ে তুমুল আলোড়ন তুলেছিলেন । ‘ত্রিধারা’ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ‘রেঁনেসা নাট্যগোষ্ঠী’ এবং ‘প্রগতি নাট্য সংঘে’র উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি
১৯৭৭ সালেই তিনি ‘প্রতিধ্বনি’ নাট্য সংগঠনের নাটক ‘অভিশপ্ত প্রেম’ নাটকে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ২০০০ সালে পেলেন কুমিল্লার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত ‘কুমিল্লার সাংস্কৃতিক/নাট্য অঙ্গনের গুণীজন সংবর্ধনা ও নাট্যোৎসব-২০০০’ এর সম্মাননা স্মারক পদক ও সদনপত্র।
কাব্যজগতে তাঁর আগমন ঘটে স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে তিনি অসামান্য একটি কাজ সম্পাদন করেন কুমিল্লায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কবি সম্মেলন এর আয়োজন করে। তখন আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বিশিষ্ট কবিবৃন্দ যথাক্রমে শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মহাদেব সাহা, আবু করিম ও আসাদ চৌধুরী।
কবি আবুল হাসানের আসার কথা ছিল আসতে পারেননি। আর এসেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মুহম্মদ জাহাঙ্গীর এবং বিদেশ থেকে বিশিষ্ট লেখক মৈত্রেয়ী রায়---যিনি বিখ্যাত মননশীল সাহিত্য সাময়িকী ‘জিজ্ঞাসা’র সম্পাদক ও গবেষক শিবনারায়ণ রায়ের কন্যা। ভাবাই যায় না কী অসাধ্য সাধন করেছেন হেলালভাই! ওই সালেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সে আমি তুমি’ সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠনের মাধ্যমে! উল্লেখ্য যে, এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম রচি। এই সংগঠনটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল এবং এর সুনাম কুমিল্লা ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি শহরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
কবি ফখরুল হুদা হেলাল দাপটের সঙ্গে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন তাঁর কনক কান্তি যৌবনে ।তিনি যখন কুমিল্লা শহরের নাভিস্থল বলে পরিচিত কান্দিরপাড়সহ নগর মিলনায়তন, ভিক্টোরিয়া কলেজ ক্যাম্পাস, পৌর উদ্যানে হেঁটে যেতেন বীর দর্পে। কেঁপে উঠতো চারপাশ তাঁর জলদগম্ভীর অর্জুন-কন্ঠস্বরের ধ্বনিতে মোহিত হত কলেজের ছাত্ররা। রানীর দিঘিস্থ ভিক্টোরিয়া কলেজের ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে তাঁকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন তাঁর সময়কার পরিচিত- অপরিচিত জনেরা। আধুনিক কবিরা তাহলে এমনই হয়! দীর্ঘচুল, খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে পাতলা স্যান্ডেল, মুখে ধূমায়িত সিগারেট, রাজার মতো অকুতোভয়, দুর্বিনেয়, আপাদমস্তক চৌকস এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। সে এক দারুণ স্মার্ট কবি ফখরুল হুদা হেলাল!
এমন সুদর্শন বাঙালি কবি খুব কমই দেখা গেছে। শহরে তাঁকে চিনতো না এমন কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী কেউ ছিল না। নাট্যাভিনয়ের মতো কাব্যচর্চায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত, এখন আরও ধারালো। কিন্তু গত ২২ এপ্রিল শুক্রবার আমরা তাঁকে হারিয়েছি। চলে গেছেন তিনি না ফেরার দেশে। আমরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। যেখানে থাকেন তিনি যেন ভালো থাকেন।
নগর কবি ফখরুল হুদা
মোহাম্মদ শাহজাহান
হেলাল ভাই, আমি ছোট আপনি বড়
কবিতা কিংবা নাটকের সংলাপে
মঞ্চ কাঁপতো করত থর থর।
আরে বাপরে বাপ, সেই যে দরাজ কন্ঠের ডাক
কে দেখেনি কে শুনেনি, সাহিত্য কি নাট্যাঙ্গনের।
হেলাল ভাই, আপনাকে চেনে বাংলাদেশের
কবি সাহিত্যিকরা, সেদিন ও ঢাকার বড় দরা
কবি সাহিত্যিক, নাম ভুলে গেছি, ইতো মধ্যে
কবিতা ক্যাফে, সমতটের কাগজের এক অনুষ্ঠানে
জানতে চাইলো আপনাকে।
হেলাল ভাই, আপনি আছেন আপনি আরো থাকেন
আপনাকে গর্ব করা যায় শিল্প সাহিত্যে কবিতা কাব্যে
ধুম ধাম। আপনি একটাই তো নগর কবি ফখরুল হুদা হেলাল।
দরাজ কন্ঠের বিচ্ছুরিত কুমিল্লায় যে নাম।
আবারো আপনাকে ষ্পার্টাকাস থেকে লেনিন, সিরাজদৌলা,
পাহাড়ি ফুলের মত নাটকে খলনায়কের চরিত্রে মানাবে ভালো
থাকেন। এমন সব চরিত্রে আপনি ছাড়া আর কেহ নাই।
হেলাল ভাই আপনি থাকেন, আপনাকে নিয়ে গর্ব করা যায়
আপনিই ত কুমিল্লায় ধুম ধাম। নগর কবি ফখরুল হুদা হেলাল
একটা মাত্র নাম।
(জীবদ্বশায় ১৯-০৪-২০২২ কবিতাটি লিখা হয়েছিল হেলাল ভাইকে উদ্যেশ্য করে)
কবি ফকরুল হুদা রচিত পংতিমালা।
১ # সিদ্ধান্ত
নৌ বিহারে যাবো বলে স্থির করেছি
পদ্মার উন্মুক্ত ঢেউয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
মামার বাড়ী
আকাশে মেঘের সাজ,জলে পদ্মার গন্ধ ইলিশ
স্থির হলো সঙ্গীনি হিসাবে কালো মেয়ে নাজ
রহিম মাঝি হেইও বলে পাতলা কোশা নৌকায়
ঢেউয়ের উপর সাজালো জলরাজ
তবলঅর ত্রিতাল বোলের তালে নৌকা আমার যায়
মঞ্চের যশ আর হৃদয়ের অভিনেত্রী নাজ
ম্যানোলঅর ম্যান্ডিলিনে বুকের কাছাকাছি এসে
হেসে বলে- দেখছো কি শুভ্র গাঙচিল
আমি রহিম মাঝির স্টাইলে হেইও বলে
কাছে টেনে জীবনের কাছাকাছি যেতে চেয়েছি
পেয়েছি তো তোমাকে
ইলিশের গন্ধে সচকিত জলপরী হঠাৎ
স্বাগত জানিয়ে দিয়ে গেলো
মামার বাড়ির লোকেরা পায়নি আমাদের
নৌ বিহার স্বাগত
রহিম মাঝি হলো স্বর্গবাস
আমি, তুমি, এখোন চিন্তার রাজ্যে নৌ বিহার
সমাপ্ত করে বেড়াই মঞ্চে, কখনো
সমাজে, কখনো আপনা রাজত্বে
জলপরী হলো আমাদের মাধ্যম
আমার আবারো নৌ বিহারে যাবো
নিশ্চিত যাবো বলে স্থির করেছে।
( গ্রন্থঃ অনামিকায় প্রবাল)
৩#দহন
তোমার অপেক্ষায় থেকে চলমান বাস হারালাম
পথে পথে অনেক দূর-দূর হাটলাম
হাতের ঘড়ি সংকেত দেয় তুমি নেই
কে যে বলল এই
ফিরে দেখি ছোটবেলার বন্ধু বিষ্ণু
হাসছে এবং বলছে কিরে বন্ধু প্রভূ
আমি তাকে কিছুই বলতে পারিনি
কাঁপছে হৃদয় কাঁপছে তটিনি
তুমি আসবে না বললেই পারতে
কবি হৃদয় থাকতো পওে পথে
শুক্র কীট এভাবেই কাটে পৃথিবীর ইতিহাস
প্রেমে জয়গান করে বইছে দারুণ সু-বাতাস
সেই বিষ্ণু এবং আমি আজো দেখি
তোমার জ¦লন্ত শরীরের নাজুক বেদী
হাত বাড়ালেই যদি ঈশ্বর পাও
তাহলে সুর তোলে ইচ্ছে মতো গাও
দেখবে সুখ শান্তি
সবই তোমার ভ্রান্তি
করেছো পূণ্য এ জনমে
ঘাসবে হৃদয় জিতবে দহনে।
(গ্রন্থঃ অনামিকায় প্রবাল)
৮#চিন্তা
অনেকবার ভেবেছি কবিতা লিখবো না
অথচ আমি জানি কবিতাই আমার প্রেরণা
তাইতো বার বার ফিরে আসি কবিতার কাছে
ধন্য করেছে কবিতা আমায়
তাইতো কবিতায় ব্যয় করি সময়
তোমাদের ভালোবাসা পাই
নিয়মিত লিখতে চেষ্টা করি
কবিতার রক্ত প্রবাহমান কলমে
ইতিহাসে তোমাদের সাথে থাকবো আমি
সুন্দর হোক কবিতার চলা
সুন্দর হোক কবিতার বলা
সুন্দর হোক কবিতার লেখা
সব ধ্যানে কবিতা হোক প্রেম
কবিতা হোক শত সহস্র বৎসরের আরাধনা
আমি নাই
এ কথা কবিতায় পাই
( গ্রন্থঃ তোমাদের জন্য কবিতা )
৯#জান্নাত
(প্রিয়তমাষু পারভীনকে )
ব্যাথাতুর হৃদয়ে তোমাকে স্মরি
তুমি এখন কোথায়
বলো তুমিও যেন চলে আসি
তোমারেই বায়ে
আর ভালো লাগে না তুমি বিনা
কেমনতরো জীবন আমি বুঝি না
ব্যাথাতুর হৃদয়ে তোমাকে স্মরি
বলো কিভাবে তোমার কাছে আসা যায়
শীত এখন তোমাকে ডাকে পুবালী বায়
প্রচুর সময় তোমার জন্য প্রার্থনার
প্রতিনিয়ত প্রতিদিন সময়ে অসময়ে
হে বিধাতা কবুল করুন
আমার প্রার্থনা জান্নাত দেন তাঁকে
শুদ্ধ হোক আমার কামনা ও প্রাণ
( গ্রন্থঃ তোমাদের জন্য কবিতা )
হেলালের প্রতি
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
পরীক্ষায় পাশ করা
কঠিন কাজ, পড়তে হয়।
সাঁতার কাটার জন্য অভ্যাস করতে হয়।
খেলাধূলার পর ক্লান্তি আসে
দৌড়ালে হাঁপাতে হয়
খাওয়াতে কী কম শ্রম?
তবে সহজ কাজটি কি?
মৃত্যু! শুধুমাত্র মরণে ক্লান্তি নেই,
হাঁপাতে হয় না, অভ্যাসও করতে হয় না।
অপেক্ষা করার বালাই নেই
যখন-তখন, যেখানে-সেখানে
অতি সহজ পাঠ।
এ পাঠক্রম রেখে গেলো
আমাদের হেলাল
ফখরুল হুদা হেলাল।
জোড়া শালিক-এ মঙ্গলবারে
কথা হলো-
কোথায় থাকো, কোথায় খাওয়া-দাওয়া করো
শরীরের খবর কী? সবই প্রথাগত আলাপ।
হেলাল-এর উপর বই লেখা হবে-
দু’কলম লিখবেন অনুরোধ-দাবি।
নিজেকে দেখেতে চেয়েছিলো, চিনতে চেয়েছিলো।
আপন জনের চাহনিতে
সেজন্য পরপারে বসে? ফাঁকিবাজ।
একটি সহপাঠ বই হাতে ধরিয়ে
কী খেলা খেলছে হেলাল,
তুমি না কবি? বিচিত্র তোমার জীবন যাত্রা
বাঁক ফিরিয়ে দেখিয়েছো কারিশমা?
যতটুকু জানি-মৃত্যু আসে
না জানান দিয়ে-
মৃত্যু কষ্ট দেয়, কষ্ট যাপনে সঙ্গীও দেয়
তুমি কি এতটা আওলিয়া দরবেশ
কষ্ট পেলে নয়,
দিলে না চোখের নোনা জল ফেলতে
ফাঁকবাজ হেলাল তুমি নিছক.
হালিমকে বলছি
তোমার জোড়া শালিক-এ
হেলালের একটি ছবি রেখো
মন যখন চাইবে-
হেলালকে দেখে আসবো।
একজন কবিকে, নগর কবিকে
যে আমাদের আপন ডাক দিয়ে গেছে।
বলে গেছে- ‘আবার আসিবে ফিরে
গোমতী নদীর তীরে
এ বাংলায় হয়ত মানুষ হয়ে
অথবা নীলকণ্ঠ গায়কি পখি হয়ে।’
হেলাল- আমি আসছি, দাঁড়াও।