ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
নজরুলের বাড়ি চুরুলিয়ায়
Published : Wednesday, 18 May, 2022 at 12:00 AM
নজরুলের বাড়ি চুরুলিয়ায়শাহজাহান চৌধুরী ||
২০১১ সালে কলকাতা গিয়ে ‘‘কাঞ্চনজজ্ঞা’’ এক্সপ্রেসে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং গেলাম। তিন দিন দার্জিলিং থেকে দার্জিলিং এক্সপ্রেসে কলকাতা ফেরার পথে আসানসোল নামার কথা, কিন্তু ভোর ৪টায় আসানসোল পার হয়ে গেলাম টেরই পাইনি। ৬ টায় নেমে পড়লাম বর্ধমান স্টেশনে। আসানসোলের ট্রেন আসতে অনেক দেরী। আমার আবার আজকেই কলকাতা ফিরতে হবে, কারণ কালকে বাংলাদেশে ফিরবো এয়ার টিকেট কনফার্ম। বর্ধমান রেলস্টেশন থেকে ১০ টাকায় রিক্সায় চলে আসলাম বর্ধমান বাস স্টেশনে। সেখানে রাস্তার কিনারে ডালপুরি দিয়ে নাস্তা করে উঠে পড়লাম আসানসোলগামী একটি বাসে। নিজেই সিট নিলাম ড্রাইভারের পাশে। দূরপাল্লার ভ্রমণে সবসময় ড্রাইভারের পাশে থাকার চেষ্টা করি। গাড়ির হাঁক-ডাক-চিৎকার-চেঁচামেচিতে বুঝলাম আমি লোকাল বাসে উঠেছি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন, ৫ থেকে ৬ ঘন্টা লাগবে আসানসোল যেতে। আমিতো হতাশ। বাস ছেড়ে দিয়েছে, প্রায় মাইল পাঁচেক চলে এসেছে। ড্রাইভারকে আমার পরিচয় দিলাম, বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি নজরুলের বাড়ি যাব। তিনি কনডাক্টরকে ডেকে আমার ভাড়া ফেরৎ দিতে বললেন এবং কিছুদূর যেয়ে হাইওয়েতে পেছনের একটি বাস থামিয়ে আমাকে উঠিয়ে দিলেন। এটা কলকাতা-আসানসোল সরাসরি বাস। আসানসোল ১২০ কি.মি.। ভাড়া ৪৫ টাকা। বাসের নাম কৃষ্ণ গোপাল নং ডই-৪১-ঊ-৩৯৮৪। বাস জিটি রোড হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে। বিহার বর্ডার পানাঘর, দূর্গাপুর, মুন্সিপাড়া, দূর্গাপুর ইস্পাত নগরীমোড় ভিডিঙ্গী এসে বিধি বাম; একটা এক্সিডেন্টকে কেন্দ্র করে বাস দু’ঘন্টা পথে দাঁড়িয়ে রইল। এখান থেকে আসানসোল ৩৫ কি.মি.। বেলা সাড়ে এগারটায় আসানসোল পৌঁছলাম। আসানসোল নেমে চুরুলিয়া যাওয়ার বাহন খুঁজতে গিয়ে জানলাম, আসানসোল থেকে চুরুলিয়া ১৯ কিলোমিটার। প্রথমে ভেবেছিলাম সিএনজিতে যাব কিন্তু আসা যাওয়া ৪০০ টাকা ভাড়া চায়। বাসে চেপে বসলাম। লোকাল বাস, ভাড়া ১০ টাকা। ‘‘টেটো চই’’ হেলে দূলে বাস চলছে। তখন স্কুল ছুটি হয়েছে দেখলাম। আস্তে আস্তে বাস ছাত্র/ছাত্রীদের দখলে। আমি ড্রাইভারের সাথে। ড্রাইভার বারবার বলে, বাবু পেছনে সিট আছে ওখানে বসুন, এখানে গরম। আমি বললাম, না চলবে। পরে ড্রাইভার আমাকে ১৯ কি.মি. রাস্তায় অনেক কিছু দেখিয়েছে। একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগলো, উঠতি বয়সের মেয়েরা সব শাড়ি পরা। বাম দিকের সিটের একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, সে ক্লাশ সেভেনে পড়ে। আসানসোল স্কুলটি কম্বাইন্ড স্কুল। সব স্কুলেই ক্লাশ সেভেন থেকে মেয়েদের স্কুল ড্রেস শাড়ী। শুনে খুব ভালো লাগলো; দেখতেও ভালো। ছাত্র/ছাত্রীদের কিচিরমিচির শব্দের মাঝ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলছে। রাস্তার বায়ে চোখে পড়লো কাজী নজরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়। বাস চুরুলিয়া গ্রামের মোড়ে নামিয়ে দিলো। হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়লাম চুরুলিয়া গ্রামে। এক সময় ছিল মেঠো পথ, এখন সান বাঁধানো রাস্তা। দু’ধারে ছবিতে দেখা মাটি, শন ও বেড়ার কিস্তি টুপির মতো ঘর। নজরুল এমনি একটি ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। এসে পড়লাম কবির জন্ম ভিটায় কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দোতালা ভবন। ১৯৫৮ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘‘নজরুল একাডেমী’’। জায়গার নাম হয় কবিতীর্থ চুরুলিয়া। ভিতরে প্রবেশ করতেই কাঁচে বাঁধানো নজরুল ও প্রমীলার দু’টি ছবি। পাশের রুমেই টেবিলে থরে থরে সাজানো নজরুলকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, বইপত্র ইত্যাদি। অফিস রুমে পরিচয় হলো সেখানকার তত্ত্বাবধায়কের সাথে। তার সাথে কথা বলে একাডেমী পরিচালনা ও নজরুলের জন্ম, মৃত্যু দিনে চুরুলিয়ায় অনুষ্ঠিত মেলার বিষয়ে জানলাম এবং ভারতীয় ১০০০ (এক হাজার) টাকায় আমিও একাডেমীর জীবন সদস্য হলাম। এ মাটিতেই ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৯ সালের ২৪ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া নামের এই গ্রামটি ছিল রাজা নরোত্তম সিংহের রাজধানী। এই রাজধানীর একটি বিরাট অংশ জুড়ে তৈরি হতো সব অস্ত্রশস্ত্র। আর এ কারণে এলাকাটি ‘চুরুলিয়া গড়’ নামেও পরিচিত ছিল। বর্ধমান জেলার আন্ডাল থেকে গৌরান্ডী পর্যন্ত ব্রাঞ্চ রেল লাইনের শেষ প্রান্তের স্টেশন চুরুলিয়া।

উত্তর দিকে অজয় নদীর বিস্তীর্ণ চর, আর কাশফুলে ঘেরা পঞ্চ পাণ্ডশ্বরের পাঁচটি মন্দির। নদীর ওপারে বীরভূম, কবি জয়দেবের লীলাভূমি। দক্ষিণ দিকে কয়লা খনি আর আর ইস্পাত শিল্প কারখানায় সমৃদ্ধ রাণীগঞ্জ এবং আসানসোল। পূর্ব দিকে শালবন, আর তমাল হরিতকির বন। পশ্চিমে বন্যা প্রতিরোধক মাইথন। এরই মাঝখানের গ্রাম চুরুলিয়া। মোঘল আমলে এক সময়ে এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কাজীর বিচার। এই বিচারালয়ের দায়িত্ব নিয়ে আসে বেশ ক’টি মুসলিম পরিবার। পাটনা থেকে আসে একটি কাজী পরিবার। চুরুলিয়া গড়ের বিচারালয় পরিচালনার দায়িত্ব তাঁদের। মোঘল সম্রাট শাহ আলমের সময়ে সম্রাট এই কাজী পরিবারটিকে ধর্মীয় পাণ্ডিত্য এবং ধর্ম প্রচারের জন্য বেশ কিছু করমুক্ত জমি দিয়েছিলেন। এই আয়মা সম্পত্তি এবং সম্মানের জন্য কাজী পরিবারগুলো এ এলাকায় আয়মাদার হিসাবে প্রথাসিদ্ধভাবে পরিচিত ছিলেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এসে কাজী ফকির আহমেদ তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে এই আয়মা সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন।
চুরুলিয়ায় হাজী পালোয়ান ফকির নামে একজন ওলি আওলিয়া ছিলেন। যাঁর খনন করা পুকুরের পানি থেকে এক সময় চুরুলিয়া গ্রামের মানুষদের গৃহস্থালীর কাজ চলতো। পুকুরের পূর্ব প্রান্তে ছিল এই মহান ফকিরের মাজার। আর পশ্চিম প্রান্তে ছিল একটি মসজিদ। ব্রিটিশ শাসন আমলে কাজীর বিচারালয় উঠে গেলে, এই ফকিরের মাজার এবং মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্ব পান কাজী আমিনউল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর দায়িত্ব পান তাঁর ছেলে কাজী ফকির আহমেদ। কাজী আমিনউল্লাহ থেকে কাজী ফকির আহমেদ পর্যন্ত আসতে, তাদের আগের জৌলুস কমে আসে। কাজী ফকির আহমেদের কিছু মাত্র আয়মা সম্পত্তি ছিল। যা দিয়ে সারা বছর সংসার চলতো না। এরই মধ্যে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। ফলে হাজী পালোয়ানের মাজার দেখা এবং মসজিদের ইমামতি দিয়ে তাঁর অভাব দূর হতো না। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় পক্ষে জন্ম হয় তাঁর একটি সন্তান কাজী সাহেবজান। এরপর জন্ম নেয় পরপর চারটি সন্তান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে চারটি সন্তানই মৃত্যবরণ করে। এরপর জন্ম হলো আরো একটি পুত্রের। চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী, সুন্দর চেহারার এই সন্তানের জন্ম হলে কাজী ফকির আহমেদ উচ্চ স্বরে আজান দিয়ে ঘোষণা করলেন তাঁর আরো একটি সন্তান এসেছে। দুঃখের মধ্যে যার জন্ম, তাঁর ডাক নাম ঘোষণা করা হলো দুখু মিয়া। ভালো নাম কাজী নজরুল ইসলাম।একাডেমী থেকে বেরিয়েই ডানে মোড় এবং একাডেমীর লাগোয়া নজরুল একাডেমী শাহর গ্রন্থাগার ও ত্রিশাল। দু’পাশের রাস্তার মাটির দেয়াল, ইটের দেয়ালে ‘প্রমীলার ছবি’র সাথে লেখা তুমিই স্ত্রী, তুমিই বন্ধু, তুমিই মাতা। সাথে কবির লেখা গান কবিতার সাথে বিভিন্ন চিত্রকর্ম। সামনে হেঁটে যেতেই নজরুল কমপ্লেক্স। কবি যে মক্তবে প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন তার উপর ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘‘কবিতীর্থ চুরুলিয়া নজরুল বিদ্যাপীঠ’’। তার সামনেই নজরুল ইসলামের স্মৃতিসৌধ যা ১৪ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী উদ্বোধন করেন। যেখানে রয়েছে প্রমীলা নজরুলের সমাধী এবং পাশে বাংলাদেশ থেকে কবির কবরের মাটি নিয়ে স্মৃতি সমাধী। কমপ্লেক্সের উল্টো দিকে ‘‘প্রমীলামঞ্চ’’ পুরো কমপ্লেক্সকে ঘিরে বসে প্রতিবছর কবির জন্ম ও মৃত্যু দিনে ‘‘নজরুল মেলা’’। ২০১১ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ; দিনটি ছিল শুক্রবার। সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন কবি যে মসজিদের মোয়াজ্জিন ছিলেন এবং মাঝে মাঝে ইমামতি করেন সেই মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ার। নামাজ পড়ে বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্য রাণীগঞ্জ শিয়ারসোল রাজ হাই স্কুল যেখানে কবির শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল।