ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
Published : Wednesday, 15 June, 2022 at 12:00 AM
জীবনবোধ ও জীবনদর্শনজুলফিকার নিউটন ||
পূর্বে প্রকাশের পর
২৩
খৃস্টান ধর্মে এবং মুসলমান বিশ্বাসে শেষ বিচারের দিন বা পুনরুত্থান বলে একটি কথা আছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে সমস্ত জীবের অবস্থানকাল যখন শেষ হবে এবং পৃথিবীর আর যখন কোনো স্থিতি থাকবে না তখন বিলয়প্রাপ্ত সকল মানুষের আত্মাকে জাগ্রত করে বিধাতার সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। বিধাতা তখন মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব করে পুণ্যাত্মাগণকে স্বর্গে প্রেরণ করবেন এবং পাপাত্মাদেরকে নরকে। ঢাকাস্থ ব্যাপ্টিস্ট মিশনের প্রধান নর্থফিল্ড সাহেব এই বিষয়ে প্রায়ই বক্তৃতা করতেন এবং অন্ধকার কক্ষে ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে চিত্র প্রদর্শন করে যিশুখৃস্টের জীবনকথা বর্ণনা করতেন। শেষ বিচারের দিনের কথা আমাদের বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ নিয়ে কখনো প্রশ্ন করি নি কিন্তু বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছি। এ সময় হঠাৎ একদিন টলস্টয়ের “রেজারেকশন' বইটি হাতে এল। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে আমি বইটি পাঠ করলাম। তখন পর্যন্ত আমি টলস্টয়ের গল্পগুলো পড়েছি মাত্র। “রেজারেকশনই’ টলস্টয়ের প্রথম উপন্যাস যা আমি পাঠ করলাম।
‘নেকলিউডভ’ নামক একজন বিত্তবান জমিদার পুত্রের পতন এবং উত্থাপনের কাহিনী এই বইটিতে বর্ণিত হয়েছে। প্রথম যৌবনে সে উদ্দাম আনন্দ হিল্লোলের মধ্যে সময় কাটিয়েছে এবং সর্বোতভাবে কামনাবাসনা সে চরিতার্থ করেছে। এ পর্যায়ে সে তার মাতৃগৃহের একটি তরুণী দাসীকে নিজের শয্যাসঙ্গিনী করে এবং পরে এই ঘটনা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়। দাসীটির নাম ছিল নাতাশা। সে গর্ভবতী হয় এবং গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়। নাতাশার একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে কিন্তু আতুরেই মারা যায়। যাই হোক নেকলিউডভের কারণে এভাবে যে তার অধঃপতন ঘটে তার থেকে আর নিস্তার পায় না। আশ্রয়হীন বিতাড়িত অবস্থায় সে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এ পর্যায়ে একদিন পতিতালয়ে একটি হত্যাকাণ্ডে নাতাশা জড়িত হয়ে পড়ে। তার বিচার হয়। বিচারে জুরিদের মধ্যে নেকলিউডভও ছিল। অনেকদিন পর নেকলিউডভ নাতাশাকে দেখে চিনতে পারে এবং সে নাতাশার জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার মনে অনুভূতি জাগে যে এই মেয়েটির বর্তমান অধঃপতনের জন্য সেই দায়ী। তখন সে প্রায়শ্চিত্ত করবার সিদ্ধান্ত নেয়। নাতাশা সাইবেরিয়ায় শ্রম শিবিরে নির্বাসিত হয়। নেকলিউডভও সাইবেরিয়ায় যায় নাতাশাকে পাপমুক্ত জীবনে ফিরিয়ে আনবার জন্য। নাতাশা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। নাতাশার প্রত্যাখ্যানের পর নেকলিউডভ প্রায়শ্চিত্তের পথ বেছে নেয়। সাইবেরিয়ার বন্দীশিবির থেকে মুক্তি পেয়ে একই জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত একজন কয়েদীকে সে স্বামী হিসাবে বেছে নেয়। নাতাশা নেকলিউডভকে গ্রহণ করে না কিন্তু সংসারের একটি পবিত্র প্রত্যয়ের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্টিত করে। নেকলিউডডও সকল দ্বন্দ্বের অবসানে চিত্তের একটি অনাবিল প্রশান্তিতে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলি উদযাপন করে। রেজারেকশন’ দ্বিতীয়বার আমি পড়ি নি কিন্তু প্রথম পড়া আমাকে এত অভিভূত করেছিল যে আজো কাহিনীটি মনে আছে।
“রেজারেকশন’ উপন্যাসটি একটি রূপক। মানুষ পাপ এবং পুণ্য এ দুইয়ের সংঘর্ষের মধ্যে পৃথিবীতে বাস করে। জীবনের অন্বয় কর্ম যখন সে সংশোধন করে একটি প্রায়শ্চিত্তের পবিত্রতার মধ্যে অবস্থান করতে শেখে তখনই তার যথার্থ পুনরুত্থান ঘটে। খৃস্টান পুনরুত্থানকে টলস্টয় এই নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন।
টলস্টয় ছিলেন রুশ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক। জীবনকে তিনি তাঁর বিপুল বিস্তারের মধ্যে আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মহৎ উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’ বিশ্বসাহিত্যের একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থ। এ গ্রন্থ পাঠের সময় আমাদের মনে হয় যে আমরা ইতিহাসের একটি বিপুল ঘটনাক্রমের মধ্যে বাস করছি। নেপোলিয়ান এক সময় রুশ দেশ জয় করতে চেয়েছিলেন। সেই ঘটনা এবং তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রায় ১২ বছরের ঘটনা নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত। ইতিহাসকে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তিনি পুনর্র্নিমাণ করেছেন। মনে হয়, আমরা বর্তমান সময় অতিক্রম করে অকস্মাৎ একটি ইতিহাসের বিভিন্ন কার্যকারণের মধ্যে উপস্থিত হই এবং সকল ঘটনার সাক্ষ্য হই। আমি এই উপন্যাসের একটি সংক্ষিপ্ত ভাষ্য প্রথম পাঠ করি পরে ক্রমান্বয়ে এ উপন্যাসের ভেতরে প্রবেশ করবার সাহস অর্জন করি। দুটি রুশ পরিবারের জীবনযাত্রাকে অবলম্বন করে এ উপন্যাসের ঘটনাবলী আবর্তিত হয়েছে। উপন্যাসটি একান্তভাবে রুশদেশীয়। তৎসত্ত্বেও এটি সকল দেশীয়। অর্থাৎ সকল দেশের মানুষই এ উপন্যাসের মাধ্যমে তার অতীতকে যেন প্রত্যক্ষ করে। “রেজারেকশন’ পাঠ করার পর প্রথমে ‘ওয়ার অ্যান্ড পীস’ পরে আনা কারেনিনা’ আমি পাঠ করি! আনা কারেনিনা' কাহিনীটিও সর্বকালের পাঠককে বিহ্বল করার মতো। আনা কারেনিনার ঘটনাটি ১৮৭৬ সালের রুশ দেশের ঘটনা। সে সময়কার সেন্ট পিটারসবার্গ শহরের জীবনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের একটি তুলনা এই উপন্যাসে নির্মিত হয়েছে। রেজারেকশনে’ যে ধর্মীয় আবেশ আছে, আনা কারেনিনাতেও সে ধর্মীয় আবেশ আমরা লক্ষ্য করি। এই গ্রন্থটি অবশ্য রেজারেকশনের আগের রচনা। এভাবেই আমি আমার কলেজ জীবনে ১৯৮১ সালের দিকে আকস্মিকভাবে টলস্টয়ের ভক্ত হয়ে পড়ি। স্কুল এবং কলেজ জীবনে আমি প্রচুর উপন্যাস পড়েছি কিন্তু টলস্টয়ের সঙ্গে কোনো লেখকের মিল খুঁজে পাই নি। টলস্টয়কে আমার সকলের ঊর্ধ্বে মনে হয়েছে। তাঁর শিল্প নৈপুণ্য কোথায় এটা তখন ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল কিন্তু তার বর্ণনার সরলতায় আমি যে প্রবাহিত হতে পারতাম এটাই আমার জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। টলস্টয়ের সঙ্গে আর কারো সঙ্গে তুলনা দেয়া যায় কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়। টলস্টয় নিজেই নিজের তুলনা। বাংলা সাহিত্যে টলস্টয়ের কোনো প্রভাব পড়ে নি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সকল খ্যাতিমান গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক টলস্টয়ের রচনা পাঠ করে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছেন এবং অভিভূত হয়েছেন। টলস্টয়ে জটিল কোনো কলাকৌশল নেই এবং তার রচনার নিশ্চিন্ত সহজতা তাকে একক করেছে। বলা যায় যে এই সহজতার কারণেই তাকে অনুকরণ করা অসম্ভব ছিল এবং এখনও অসম্ভব। স্কুলে টলস্টয়ের কিছু গল্পের বাংলা অনুবাদ পড়েছি। কলেজে টলস্টয়ের কয়েকটি উপন্যাস পাঠের পর ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকন্সে প্রকাশিত ২৩টি গল্পের সংকলন পাঠ করি। ধর্মীয় বিশ্বাস, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণকর্মের জীবন তার গল্পগুলির প্রতিপাদ্য। কী আশ্চর্য সহজ উচ্চারণে এ গল্পগুলি যে রচিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে বলা যায় না। একজন নাস্তিকও এসব গল্প পড়ে অভিভূত হতে বাধ্য। নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের একটি সান্ত্বনা আছে। এ গল্পগুলো পাঠ করলে সে সান্তনাকে খুঁজে পাওয়া যায়। একটি গল্পের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। গল্পটির নাম কতটুকু জমি মানুষের দরকার। একজন লোক শুধু কৃষি জমি কিনতো। এবং জমির সংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েছিল। সে একবার খবর পেল যে কোনো এক অঞ্চলে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে জমি বিতরিত হচ্ছে। পদ্ধতিটি হচ্ছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে যতটুকু জমি একজন লোক বেষ্টন করে সূর্যাস্তের পূর্বে প্রথম পদক্ষেপের ক্ষেত্রে উপস্থিত হতে পারবে ততটুকু জমিই সে পাবে। গল্পের মানুষটি এভাবে পায়ে হেঁটে প্রচুর জমির অধিকারী হল। কিন্তু পদযাত্রার ক্ষেত্রে সূর্যাস্তের পূর্বে সে পা রাখলো ঠিকই। কিন্তু ক্লান্তিতে এবং অবসাদে মৃত্যুমুখে পতিত হল। তখন দেখা গেল যে তার কবরের জন্য তার মাত্র সাড়ে তিন হাত জমির প্রয়োজন হয়েছে। আসলে অতটুকু জমিরই তার দরকার ছিল। গল্পের মধ্যে কোনো আবেগ নেই। একটি নিষ্কম্প সহজ স্বাভাবিক বার্তার মতো সমগ্র কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বাসের একটি বিনম্র সততা আছে। তাকে উপলব্ধি করতে হয় এবং আপন অন্তরঙ্গ সত্তায় জাগরুক করতে হয়। আমি আমার পারিবারিক জীবনের ধর্মীয় বিশ্বাসের পটভূমিতে মানুষ হয়েছি। তাই টলস্টয়কে গ্রহণ করতে আমার কোনো অসুবিধা হয় নি। টলস্টয়ের এই ২৩টি নির্বাচিত গল্প আমি বারবার পাঠ করেছি। সে মুহূর্তে আমার মানসচৈতন্যের সামগ্রিক প্রশান্তির জন্য টলস্টয়ের আশ্বাসের প্রয়োজন ছিল। সে আশ্বাস আজো আমি অনুভব করি।
চলবে.....