ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেটে দুর্ভোগ চরমে
Published : Saturday, 18 June, 2022 at 12:00 AM, Update: 18.06.2022 1:10:51 AM
বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেটে দুর্ভোগ চরমেস্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছে সিলেট। পানি বেড়েই চলছে। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সিলেট নগর ও জেলার সবকটি উপজেলায় পানি ঢুকে পড়েছে। জেলা প্রশাসনের হিসাবে জেলার এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। পানি ঢুকে পড়েছে সবগুলো উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। এ দুই উপজেলার প্রায় শতভাগ পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে দুই উপজেলা কমপ্লেক্সও। বন্যার কারণে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার মানুষজন। পানিতে উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইন তলিয়ে যাওয়ায় জেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। নগরের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এ ছাড়া ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না অনেক এলাকায়। খবর নিউজ বাংলার।
পানি আর ৪ ইঞ্চি বাড়লেই কুমারগাঁও গ্রিড সাবস্টেশন বন্ধ করে দিতে হবে। আর এটি হলে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহরের পুরোটা। এমন তথ্য জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাদির। তিনি বলেন, ‘আমি ২৯ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। ২৯ বছরেও এমনটি দেখিনি। কখনই কুমারগাঁও গ্রিড লাইনে পানি ওঠেনি। এবারের পানি ভয়ংকর।’
একই কথা বললেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পারুয়া গ্রামের সাইদুল হক। তিনি বলেন, ‘এইভাবে পানি আর কখনও হয়নি। পুরো উপজেলা তলিয়ে গেছে। কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নৌকার অভাবে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছে না।’
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার আজির উদ্দিন বলেন, ‘দক্ষিণ সুরমা সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে আমাদের এলাকায়ও বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেটও নেই। একে তো পানিবন্দি অবস্থায় আছি; তার ওপর সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।’
ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের দাঁড়িয়াপাড়ায় আত্মীয়ের বাসায় রেখে এসেছেন নগরের কাষ্টঘর এলাকার বাসিন্দা সুবল দাস। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এক মাসের ব্যবধানে দুবার উদ্বাস্তু হলাম। গত মাসের বন্যায়ও ঘরে পানি ঢুকে আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজকে আবার একই দশা।’
বিদ্যুতের অভাবে খাওয়ার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে নগরের বহু এলাকায়। নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত মাসের বন্যায় সাত দিন পানি ছিল না। গোসল করতে পারিনি। এবারও একই সমস্যায় পড়েছি।
‘রাস্তাঘাট ও দোকানপাট তলিয়ে যাওয়ায় পানি কিনে আনার মতোও অবস্থা নেই। ফলে খাওয়ার পানির পাশপাশি গোসল ও টয়লেটের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’
নগরের চালিবন্দর এলাকার রামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ছড়ারপাড়ের একটি কলোনির বাসিন্দা তেরাব বিবি। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো খাবার নেই। রান্নার ব্যবস্থা নেই। এ পর্যন্ত কেউ কোনো ত্রাণও দেয়নি। কেবল মুড়ি ছাড়া সকাল থেকে সন্তানদের কোনো খাবার দিতে পারিনি। এ অবস্থায় আমরা এখানে থাকব কী করে?’
তিন দিন ধরে পরিবার নিয়ে পানিবন্দি গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর এলাকার সামুসুদ্দিন আহমদ। বাড়ির টিউবওয়েলও পানিতে ডুবে গেছে। তবু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না তিনি।
সুবল বলেন, ‘চারদিকে পানি, পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য কোনো নৌকাও পাচ্ছি না। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনেও চার্জ নেই। ফলে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। এ অবস্থায় ঘরে পানির ওপরই থাকতে হচ্ছে।’
একই সমস্যার কথা জানালেন একই উপজেলার হরিপুরের বাসিন্দা চেরাগ মিয়া। বলেন, ‘পানিতে চুলা তলিয়ে গেছে। তাই রান্নাবান্না বন্ধ। ঘরে শুকনা খাবারও নেই। নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানিও পাচ্ছি না। আবার আশপাশে বুক থেকে গলাসমান পানি। ফলে ঘরের বাইরেও যেতে পারছি না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।
‘কীভাবে যে বাইচ্চা আছি তা একমাত্র আল্লাহই জানে।’
বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রমও। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমরা জেনারেটর দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু জেনারেটরের সাহায্যে এক্স-রে মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চালানো সম্ভব হয় না। তাই এই সেবাগুলো বন্ধ রয়েছে।
‘জেনারেটরের তেলও ফুরিয়ে আসছে। চারদিকে পানি থাকায় তেল আনাও সম্ভব নয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে সেবা আরও ব্যাহত হবে। মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’
ঘরে বন্যার পানি অথচ খাওয়ার পানি নেই। শুকনো খাবারও ফুরিয়ে আসছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় ফোনে কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। এমন অবস্থাকে বিভীষিকাময় উল্লেখ করে জৈন্তাপুর উপজেলার হেমু এলাকার দিনমজুর উসমান মিয়া বলেন, ‘এমন অবস্থায় একদিনও কাটানো সম্ভব না। পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে সহজে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও অনেক দিন দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’
সিলেটের সবগুলো উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘অনেক এলাকায় বাহনের অভাবে পানিবন্দি লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে। তারা কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়ানঘাট উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করেছে।
‘আমাদের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখন ফাঁকা নেই। বেশির ভাগই তলিয়ে গেছে। বাকিগুলো আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। ফলে নগরের বাইরের প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।’
এদিকে ক্যাম্পাসে পানি উঠে যাওয়ায় আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুক্রবার সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘দুই যুগ পর এবার ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎও নেই। তাই ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’
সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অনেক মানুষ পুরোপুরি ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে কুমারগাঁও সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এটি তলিয়ে গেছে পুরো সিলেট বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে। এতে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সিলেট।
‘তাই আমরা এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। যাতে অন্তত নগরের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। সিটি করপোরেশন, সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎ বিভাগ একসঙ্গে মিলে এই কেন্দ্র সচল রাখার চেষ্টা করছি।
‘বালির বস্তা দিয়ে কেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি সেচে সরানোর চেষ্টা করছে’ বলেন মেয়র।