শাইখ সিরাজ ||
সংযোগ
মানেই পরিবর্তন, পারস্পরিক বিনিময়ের ফলে উন্নয়ন। সে অর্থে একটি সেতু
পাল্টে দিতে পারে জনপদ। যে কোনো অঞ্চলের সঙ্গে কেন্দ্রের অবিচ্ছিন্ন
যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ সৃষ্টি করবে, ফলে খুব
দ্রুতই পাল্টে যাবে ওই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপট। উদাহরণ
খুব দূরে নয়। ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর
উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় পিছিয়ে থাকা
উত্তরবঙ্গ এখন উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। কি কৃষি, কি শিল্প সব খাতেই ওই অঞ্চল
এগিয়ে যাচ্ছে। আরও ছোট্ট একটা উদাহরণ টানলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। রাজশাহীর
আম এখন যে পরিমাণে সারা দেশে পাওয়া যায়, ১৯৯৮ সালের আগে সে পরিমাণে কি
পাওয়া যেত? না, যেত না। ফেরি পার হয়ে আম বা যে কোনো কৃষিপণ্য রাজধানী ও
দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেতে যেতে অর্ধেকের বেশি পচে নষ্ট হয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে রাজশাহীর আমের স্বাদ এখন সারা দেশের মানুষ নিতে
পারছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে ঠিক এমনই অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটবে
পদ্মা সেতুর কারণে।
পদ্মা সেতুর স্বপ্নের বীজ অনেক আগেই বপিত হয়েছিল
বাংলাদেশের মানুষের মনে। বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ করবেন। তারই ধারাবাহিকতায়
২০০১ সালে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী
লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা আসে পদ্মা সেতুর। প্রায় দুই যুগের
প্রেক্ষাপট রচনাকারী পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয় ২০১৪ সালে। দীর্ঘ আট
বছরে একটু একটু করে নির্মাণ হয় বিশাল স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আমি অত্যন্ত
সৌভাগ্যবান যে নির্মাণের প্রতিটি দৃশ্যই দেখার সুযোগ পেয়েছি। পদ্মা সেতু
নির্মাণ কর্মযজ্ঞের দৃশ্যধারণের গর্বিত অফিশিয়াল পার্টনার ইমপ্রেস
টেলিফিল্ম লিমিটেড, ফলে নির্মাণের প্রতিটি ধাপের চিত্র আমার দেখার সুযোগ
হয়েছে। মনে পড়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু হওয়ার পর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটের
কাছাকাছি আয়োজন করেছিলাম কৃষকের ঈদ আনন্দের। পদ্মা সেতু ঘিরে কৃষক ও
সাধারণ মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস তুলে ধরেছিলাম। সেই সঙ্গে ওই এলাকার
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে ভবিষ্যৎ আর্থসামাজিক রূপরেখা সম্পর্কে একটা
ধারণা তুলে ধরেছিলাম। যতবার আমি পদ্মা পাড়ি দিয়েছি ততবার পদ্মা সেতুর
স্বপ্ন দৃঢ় হয়েছে। অপেক্ষা করেছি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের। আমি জানি এ
স্বপ্ন প্রতিটি বাংলাদেশির।
২০১৭ সালে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’
অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে
হেলিকপ্টারযোগে ঝালকাঠি যাওয়ার পথে ওপর থেকে দেখেছিলাম সেতুর কাজ চলছে
পদ্মায়। এ নিয়ে কথা হচ্ছিল মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, ‘এ সেতু
নির্মাণ মূলত প্রধানমন্ত্রীর দুরন্ত সাহসের উদাহরণ। নেতৃত্বে যদি সাহস না
থাকে তবে সে জাতি এগোতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর সাহসের কারণেই বড় বড়
প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে।’ পদ্মা সেতু নিয়ে দারুণ আশাবাদী ছিলেন
আবুল মাল আবদুল মুহিত। দেখেছি এ সেতুর কথা বলার সময় তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল
হয়ে উঠত। আজ পদ্মার বুকে সেই সেতু দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গর্বের প্রতীক হয়ে।
সশ্রদ্ধ স্মরণ করছি প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিতকে।
গত ১৭ জুন পদ্মা
সেতুর দুই প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করেছি এ সেতু নিয়ে
ওই অঞ্চলের মানুষের আশা-প্রত্যাশার বিষয়গুলো। দুই তীরের মানুষের স্বপ্ন ও
প্রত্যাশা দুই রকম হলেও, পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ার আনন্দ সবার মধ্যেই।
মাওয়া পাড়ের সাধারণ মানুষ ও কৃষক ভাবছে, এ সেতুর ফলে কৃষিবাণিজ্যের প্রসার
ঘটবে। লোকসমাগম বাড়বে। কৃষির পাশাপাশি লাভজনক অন্য পেশার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
জাজিরা প্রান্তের কৃষক ও সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস অন্যরকম। যোগাযোগ,
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ সব বিষয়ে পরিবর্তনকে গ্রহণ করার এক প্রস্তুতি
যেন তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বড়রা তো বটেই, শিশুরাও উদ্গ্রীব হয়ে আছে
সেতু দিয়ে পদ্মা পারাপারে। নদী থেকে পানি নিচ্ছিল ১০-১২ বছরের এক কিশোর।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পদ্মা সেতুতে কী লাভ হইল তোমার? অবাক করে দিয়ে
বলল, ‘পদ্মা পার হইতে গিয়া ট্রলার ডোবার আর ভয় থাকত না’।
আশা করা হচ্ছে,
পদ্মা সেতুর প্রাথমিক প্রভাব পড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি খাতে আর
দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে ভারী শিল্পে। একদিকে সচল হয়েছে মোংলা বন্দর।
অন্যদিকে পায়রা বন্দরে কাজ শুরু হয়েছে। পরিবহন খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন
আসবে। তবে শুরুতেই সবচেয়ে গতিশীল হবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। সেতুর কারণে সব
ধরনের কৃষিপণ্য ঢাকাসহ বড় বড় জেলা শহরে দ্রুত সময়ে পরিবহন সহজ হবে।
পদ্মা
সেতু নির্মাণের আগে করা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল- দেশের
মোট জিডিপিতে ১.২৩ শতাংশ যুক্ত করবে পদ্মা সেতু। ২০০৫ সালের সম্ভাব্যতা আর
বর্তমানের প্রেক্ষাপট এক নয়। নিশ্চয়ই এ পরিমাণটা আরও বেশি হবে। যদিও ধারণা
করা হচ্ছে, কৃষিপণ্য পরিবহন ও কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকা
থাকবে বেশি। আমি মনে করি, এর প্রভাবটা হবে বহুমুখী। আমরা জানি, খুলনা ও
বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি আর ফুল, বরিশালের ধান, পান, আমড়া, পেয়ারা পুরো
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি-অর্থনীতির ভিত্তি। নদী থেকে পাওয়া যায় বিপুল
পরিমাণ মাছ। এসব কৃষিপণ্য ঢাকার বাজারে আনাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবহনের
দীর্ঘসূত্রতায় নষ্ট হয়ে যেত বেশির ভাগ পণ্য। লোকসানের পরিমাণটা ছিল অনেক
বেশি। এখন সেটি সহজ হবে বলে আশা করছে ওই অঞ্চলের কৃষক। যশোরের গদখালীর ফুল
ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় আসে। পাশাপাশি রপ্তানি হয় বিদেশেও। আবার দেশের সবজি
বাজারের বড় একটি অংশই আসে যশোর অঞ্চল থেকে। সেতুর ফলে এ পরিবহনের বিষয়টি
সহজ হবে। শরীয়তপুরের খামারিরা বলছিলেন, তাঁরা প্রচুর পরিমাণে দুধ ও মাংস
উৎপাদন করেন। কিন্তু এসব ফেরি দিয়ে ঢাকায় নিতে নিতে নষ্ট হয়ে যেত। এখন
উৎপাদিত মাংস ও দুধ মাত্র দুই ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছাবে। আমি মনে করি, চিংড়ির
বাণিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। চিংড়ি বাংলাদেশের দ্বিতীয়
বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য। শতকরা ৯০ ভাগের বেশি চিংড়ি উৎপাদিত হয় খুলনা বিভাগে।
পদ্মা সেতুর ফলে চিংড়ি খামারের উৎপাদনশীলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জাতিক মানদন্ডে চিংড়ি উৎপাদন হবে এবং বিদেশে রপ্তানি বাড়বে। রপ্তানি
বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে বিশেষ করে রাজধানী শহর থেকে শুরু করে
অন্যান্য বিভাগীয় শহরে চিংড়ির সরবরাহ বাড়বে। কৃষক পাবে ন্যায্যমূল্য। ২২
জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি সবিনয়ে জানতে চেয়েছিলাম, দেশের
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে
বিনিয়োগকারীদের অনুপ্রাণিত করতে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেবেন কি না? মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী আশার বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও
প্রসেসিং সেন্টার গড়ে তোলার ব্যাপারে অনেককে তিনি অনুপ্রাণিত করছেন। এর
আগে এ বিষয়ে বহুবার কথা হয়েছে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি
জানিয়েছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি নিয়ে তাঁর বহুমুখী পরিকল্পনার কথা।
তাঁর আশাবাদ, দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আগে থেকেই ওই অঞ্চলে
বিনিয়োগ আছে, তারা সে কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করবেন পদ্মা সেতু ঘিরে।
পদ্মা
সেতু মূলত সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এখন অনেক কিছুই করা সম্ভব।
সম্ভব অনেক কঠিন স্বপ্ন সহজে বাস্তবায়ন করা। কৃষিশিল্পের নতুন দ্বার
উন্মোচন হবে। উপকৃত হবে কৃষক। পরিবর্তিত সময়ের কৃষিতে দক্ষ হয়ে উঠবে উভয়
অঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতুই নির্মাণ করবে আগামী কৃষি-অর্থনীতির গৌরবান্বিত
ধারা- এ আমার প্রত্যাশা, দৃঢ়বিশ্বাস।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।