লুসিফার
নাসরিন তামান্না ||
১.
ফারহিনের স্কুলে আজ
বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিলো। গতবছর কোন পুরষ্কার পায়নি সে, তাই এইবারে
একটা হলেও পুরষ্কার নিতেই হবে ধরনের মনোভাব ঠিক করে রেখেছিলো সে। মোরগ
লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে তৃতীয় হয়েছে । তার দাবি বাকী সবাই তার তুলনায় অনেক
রিষ্ট পুষ্ট, তাই তাদের সাথে সে পেরে উঠেনি। আর না হয় প্রথম হতে পারতো।
তার খুব আফসোস, জীবনে কোনদিন সে কোন খেলায় প্রথম স্থান অধিকার করতে
পারেনি। কিন্তু এতো এতো শক্তিশালী মেয়েদের সাথে লড়াই করে তৃতীয় হতে পেরে সে
খুবই আনন্দিত। আর এই আনন্দের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটলো।
সরকারি স্কুল,
পুরষ্কার হিসেবে এখনো কাঁচের প্লেট বাটি আর মগ দেওয়ার রেওয়াজ রয়ে গেছে।
তৃতীয় হওয়ায় একটা সুন্দর ভাত খাওয়ার বাসন পুরষ্কার পেয়েছে ফারহিন।
"সামনের বছর আরেকটা পেলে তার ৬টা প্লেটের একটা সেট হবে, আর এতে করে মা ভীষণ
আনন্দিত হবেন" এই ভেবে ফারহিন এর মনে মনে খুব গর্ববোধ হচ্ছিল। ফারহিনের
মা ফরিদা বানু ওরফে পুতুল। সুন্দর সুন্দর ডিনার সেটের প্রতি তার ভীষণ
আকর্ষন। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে এইসবের সখ বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না বলে
তিনি মনে করেন। উনার মেয়েরা বিভিন্ন খেলাধুলায় নানান বাসনকোসন পুরষ্কার
পেলে তিনি অত্যন্ত খুশী হোন। কিন্তু আজ আর খুশী হতে পারলেননা। পুরষ্কার
নিয়ে যখন বাসায় আসছিলো ফারহিন, রাস্তায় পড়ে থাকা ইটে হোঁচট খেয়ে উল্টে
পড়লো রাস্তায়, আর তখনই হাতে থাকা পুরষ্কার পড়ে গিয়ে ভেঙে একাকার!
বাসায়
এসে সে কি কান্না তার! একেতো রাস্তায় সবার সামনে আছাড় পড়ার লজ্জা, তার উপর
এতো কষ্টে অর্জন করা পুরষ্কার ভাঙার কষ্ট! অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে
দুপুরে খাওয়ানো হয়েছে তাকে। প্রতিদিনের মতো আজ আর দুপুরে মায়ের চোখ ফাঁকি
দিয়ে সে খেলতে যায়নি অনুশ্রীদের ছাঁদে। মন খারাপ করে বড় আপুর পাশে শুয়ে
ছিলো। লাবনী, ফারহিনের বড় বোন, ইংরেজি সাহিত্যে নিয়ে পড়ছে, সারাদিন
সাহিত্যের জগতে হারিয়ে থাকে। লাবনীকে মাঝে মাঝে ফারহিন এর বিরক্ত লাগে।
সারাক্ষণ একটা মোবাইল নিয়ে বসে থাকে, ভূতের সিনেমা দেখে, অদ্ভুত সব বই
পড়ে, বিড়বিড় করে নিজে নিজে কি যেনো বলে সারাক্ষণ, রাতে আবার ওয়াশরুমে
যাওয়ার আগে ফারহিন কে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে, কারণ একা যেতে ভয় পায় সে।
মাঝে মাঝে ওয়াশরুমে বসে চিৎকার করে উঠে। এসব বই পড়বার কি দরকার এতো ভয়
পেলে? রাতে আবার কাকে যেনো ফিশ ফিশ করে এই ভূতের গল্পগুলো শোনায়। মাঝে
মাঝে কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে কি কি যেনো বলে। ইদানীং আবার কিছু অদ্ভুত
আচরণ করছে। ফারহিন শুয়ে শুয়ে ভাবছিলো "আচ্ছা আমি না হয় খুশীতে লাফাতে
লাফাতে আসছিলাম, আমার পুরষ্কারটা তো আপু হাতে নিতে পারতো, তাহলেই তো আর
ভাঙতোনা।" এই ভেবে লাবনীর উপর আরো বেশি রাগ হচ্ছিল তার। সে মন খারাপ করে
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। লাবনী হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। ফারহিন রেগে গিয়ে ওর
হাত থেকে বইটা নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আপুর হাতে এক কামড় বসিয়ে দৌড়ে ওর
বাবার রুমে চলে গেলো। বাবা বিছানায় আধশোয়া হয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন, সে এক
দৌড়ে বাবার পাশে যেয়ে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। কারণ সে জানে
মায়ের কাছে গেলে দুটো থাপ্পড় খেতে হতো উল্টো।
আর এদিকে লাবনী চেচিয়ে
যাচ্ছে, সে খুবই অলস প্রকৃতির, যার ফলে সে দৌড়ে এসে ফারহিনকে একটা জোড়েসোড়ে
থাপ্পড় দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করা স্বত্তেও উঠে আসেনি। পাশের রুম থেকে পুতুল সব
শোনার পর বিলাপ করে যাচ্ছে, " পাগলের ঘরে থাকি আমি, এইটা ঘর না, পাগলা
গারদ! একটা মেয়ে সারাদিন কি কি সব পড়ে, একটু পর পর চিৎকার করে উঠে,
অদ্ভুত সব কথা বলে, অদ্ভুত সব আচরন তার!আর আরেকটা বন্য, সারাদিন কোন
পড়ালেখা নাই, টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, কোথা থেকে এনে ফ্রিজের মধ্যে ব্যাঙ,
টিকটিকি, তেলাপোকা, যা তা রাখে। আবার আমাকে বলে একদিন সাপের মাংস রান্না
করে দিতে ভুনা করে! পোলাও দিয়ে নাকি খাবে। সব পাগল নিয়ে আমার সংসার। আর
একজন মহাজন, সারাদিন থাকেন উনার অফিস আর পত্রিকা নিয়ে। ছেলেমেয়েরা কি
করছে, কোথায় যাচ্ছে, উনার কোন খবর নাই। যত জ্বালা শুধু আমার।আমি আর
পারিনা! আমি মরলে এই ঘরের সবাই বুঝবে। তখন তারা শান্তি পাবে"।
২.
গত
কয়েকদিন যাবৎ ফারহিন আর অনুশ্রীর মাঝে কিছু একটা চলছে। স্কুল থেকে এসেই সে
অনুশ্রীদের বাসায় চলে যায়, অথবা অনুশ্রী আসে ওদের বাসায়। দু'জন কি যেনো
ফিশফিশ করে বলে, শলাপরামর্শ করে, দুজনকেই বেশ চিন্তিত মনে হয়। স্কুলে
তাদের বিজ্ঞান শিক্ষক জনাব ইমদাদুল হকের আশেপাশে কিছুদিন যাবৎ আবার দু'জন
কে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। ঘটনা আসলে কি কোনকিছু আঁচ করা যাচ্ছে না। অনুশ্রী আর
ফারহিন দু'জনেরই বিজ্ঞান ক্লাস করতে ভীষণ ভালো লাগে। ইমদাদুল স্যার এতো
সুন্দর করে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেন, স্যারকে দুজনেরই খুবই পছন্দ।
তাছাড়া একমাত্র বিজ্ঞান ক্লাসেই দু'জন কে কান ধরে দাঁড়াতে হয়না। স্যার
দুজনকে আদর করেন।
আজ শিক্ষকদের রুমের সামনে দু'জনকে বার বার পায়চারি
করতে দেখে রিতা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছে দু'জনের? এদিকে বার বার
উঁকিঝুঁকি দিচ্ছো কেনো? কোন দরকার আছে? নাকি দুষ্টুমির ধান্দা? সারাদিন তো
তোমাদের শুধু দুষ্টামি।"
ইমদাদুল স্যার ব্যাপার টা খেয়াল করলেন, দুজনকে ডাকালেন উনার কাছে। জানতে চাইলেন কি হয়েছে।
ফারহিন আর অনুশ্রী একসাথেই বলে উঠলো, "স্যার লুসিফার কে?"
স্যার
একটু মুচকি হাসলেন, তারা কিছুটা বিব্রত হলো, তবুও উত্তরের জন্য স্যারের
দিকে তাকিয়ে ছিলো। তখন স্যার বলা শুরু করলেন, "লুসিফার একটি পৌরাণিক
চরিত্র । যার চরিত্রে চারটি বিষয় প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল: গর্ব, বিদ্রোহ,
জ্ঞান এবং বিশ্বাসঘাতকতা।যে সবদিক থেকেই নিপুণ এবং নিখুঁত ছিল।কিন্তু সে
স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে দেখে ক্রুদ্ধ এবং ইর্ষাপ্রবণ হয়ে পড়ে।যার
ফলস্বরূপ, তাকে স্বর্গ থেকে বের করে দেওয়া হয়। আর এই লুসিফার চরিত্রটি
বিভিন্ন পুরাণকাহিনি বা ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন নামে আবির্ভুত হয়েছে,
কিন্তু তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য সব জায়গায় একইরকম। সে মানবজাতির মধ্যে মন্দ,
প্রতারনা এবং প্রলোভন এনেছে। অবশ্যই একটি বর্জনীয় চরিত্র সে। কিন্ত একদল
লোক আছে যারা লুসিফারের আরাধনা করে এবং তারা বিশ্বাস করে যে লুসিফার এর
একদিন জয় হবেই, তাই তারা নানান পূজা অর্চনা করে থাকে, প্রাণী বলি দেয়, এবং
প্রয়োজনে তারা নিজেকে লুসিফারের পথে বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত।"
স্যার থামলেন, ওদের দুজনের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা আর ভয়ের ছাপ, তারা আরো জানতে চায় লুসিফার সম্পর্কে।
একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে, চোখে চোখে কথা বলছে।
স্যার
জিজ্ঞেস করলেন তারা এসবকিছু কেনো জানতে চাইছে। ওরা কিছু একটা বলতে যাবে
এমন সময় অফিসের দপ্তরি এসে বললো, "স্যার, আপনারে হেড স্যার সালাম জানাইছে,
এক্ষণে যাইতে কইলো!"
স্যার ওদের কে অন্যদিন আসতে বলে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন। দুজনকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
৩.
আজ
রাতে ফারহিন আর অনুশ্রী একসাথে থাকবে ফারহিনদের বাসায়। আজ স্কুল থেকে আসার
সময় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুশ্রী ফারহিনদের পাশের বাসায় থাকে,তারা
দুইজন বেস্ট ফ্রেন্ড। দুই পরিবারের মাঝেও আন্তরিক সম্পর্ক। সারা সন্ধ্যা
দুজন মিলে বুদ্ধি করেছে কি করা যায়। গত কয়েকদিনে যা যা ঘটেছে সব অনুশ্রী কে
খুলে বলেছে ফারহিন । অনুশ্রী বলছিলো, "জানিস আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম, যারা
লুসিফারের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তারা দিন দিন নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে
নেয়, গভীর রাতে পূজা করে, মোমবাতি জ্বালায়, কাপড়ের পুতুল ও থাকে তাদের
সাথে, আর তাদের..." তার কথা শেষ করার আগেই ফারহিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
আপুর ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে সে কালো বোরখার মতো কিছু একটা দেখেছে, ঠিক বোরখা
না, তাছাড়া অনেকগুলো মোম দেখেছে, আর সাথে একটা পাটের পুতুল ঝুটি ওয়ালা।
আর রাতে সে আমার পাশে থাকেনা, রান্না ঘরে আলো জ্বলে, ওর সাথে হয়তো কেউ
থাকে। রান্না ঘর আলোকিত হয়ে থাকার ঘটনা এবং সেখানে কিছু একটা দেখতে
পাওয়া, সেটাতো আগেই অনুশ্রী কে জানিয়েছে। গত এক সপ্তাহে সে এমন আরো অনেক
অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করেছে। আজ দুজন মিলে এই রহস্যের সমাধান করবেই, আজকে
তারা জানবেই আসলে হচ্ছেটা কি। লাবনী কি সত্যিই লুসিফারের পূজা করছে নাকি
তাকে দিয়ে অন্য কেউ কিছু করাচ্ছে। ঘটনা আর বেশিদূর এগোতে দেয়া যাবেনা।
ওদের দুজনকেই কিছু একটা করতে হবে। ফারহিন অনুশ্রী কে বলছে, মা কে বললে তো
মা ওদের কথা বিশ্বাসই করবেনা। উল্টো বকা শুনিয়ে দিবে। মা বুঝবেইনা
লুসিফারের কথা। আর বাবা তো সারাদিন উনার অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বড় আপুনির
জন্য কিছু একটা তো করতেই হবে। ওকে বিরক্ত লাগলেও, ভালোও তো বাসে সে।
রাত
তখন বাজে ১১ টা। দুজন খেয়ে দেয়ে বড় আপুর বিছানায় একসাথে শুয়ে পড়লো। দুজনেই
চোখ বন্ধ করে আছে। সবাইকে বুঝাতে চাচ্ছে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। আসল কাজ রাত
বারোটার পর করবে।
কিন্তু এই ঘুমের অভিনয় করতে যেয়ে দুজন যে সত্যিই কখন
ঘুমিয়ে পড়লো সেই খেয়াল আর নেই তাদের। রাত তখন বাজে ২ টা। হঠাৎ অনুশ্রীর ঘুম
ভাঙলো। সে আস্তে করে ফারহিন কে ডেকে উঠালো। তারা দেখলো তাদের পাশে মশারির
ভেতর বড় আপু নেই। এবং রান্না ঘর আলোকিত হয়ে আছে, একজন অথবা দুইজন বসে আছে,
কি যেনো নড়ছে, লম্বা চুল আর ওড়নাও উড়ছে, খুব মৃদু শব্দে ভৌতিক একটা সুর
বেজেই চলেছে। ওরা দুজন ভয় পাচ্ছে। একজন আরেকজনকে সূরা ফাতিহা আর ইখলাস পড়ে
ফূ দিলো। তারপর বিসমিল্লাহ বলে মশারীর ভিতর থেকে দুইজন একই সাথে নামলো। আর
সাথে সাথেই পর পর তিনটা চিৎকার শোনা গেলো। প্রথম চিৎকার লাবনীর, তারপর
অনুশ্রীর এবং সর্বশেষ ফারহিনের।
৪.
আজ যখনি কেউ লাবনী কে দেখছে, সাথে
সাথে হেসে দিচ্ছিলো। আর লাবনী রেগে গিয়ে চিৎকার করছিলো। বেচারির ঠোঁট
কেটে ফুলে গেছে, পেটেও ব্যথা পেয়েছে, গালের অংশটুকু কালো হয়ে আছে। আর ওদিকে
ফারহিন আর অনুশ্রী লজ্জায়, অনুতপ্ত হয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে বাসার বাইরের
বারান্দায়। তাদের মিশন লুসিফার যে এরকম কিছু ঘটাবে, সেটা তারা কোনদিন
ভাবেনি। অবশ্য ভালোই হলো, ফরিদা বানু সচেতন হলেন, বিরাট একটা দুর্ঘটনা থেকে
বাঁচা গেলো। লাবনীর জন্য নতুন মশারী আনা হলো আর ফারহিনের নতুন বিষয়
সম্বন্ধে জানা হলো।
আসল ঘটনাটি খুলে বলা যাক, সেদিন রাতে যখন রান্না ঘরে
কারো চুল আর ওড়না উড়ছিলো বাতাসে, আর ভৌতিক শব্দ ভেসে আসছিলো, ফারহিন আর
অনুশ্রী ঠিক করলো আজকে তারা এই সবকিছুর রহস্য ভেদ করবেই। যখনি তারা বিছানা
থেকে নিচে নামার উদ্দেশ্যে নামলো একজন পা রাখলো লাবনীর মুখে, আরেকজন পেটে।
মশারীর ছিদ্র খুবই সূক্ষ্ণ হওয়ায় সেটা দিয়ে বাইরের দক্ষিণা বাতাস লাবনীর
গায়ে এসে লাগতোনা। যার ফলে ভিতরে লাবনীর প্রচন্ড গরম অনুভব হচ্ছিল। আর
যেহেতু ওদের বাসায় কয়েল জ্বালানো একান্তই বারণ, ফারহিনের মায়ের আদেশ
কোনভাবেই কয়েল জ্বালানো যাবেনা, কারণ একটা কয়েল একশোটা সিগারেটের সমান
ক্ষতি করে, আর তাই গরম সহ্য করতে না পেরে প্রতি রাতে লাবনী মশারী থেকে বের
হয়ে নিচে ফ্লোরে কাথা বিছিয়ে শুয়ে থাকতো। আর ওদিকে রান্না ঘরে প্রতিদিনের
মতো ফারহিনের মা চুলা না নিভিয়ে নিভু নিভু আঁচে রেখে দিয়ে চলে আসলো। রাতে
যেহেতু কেউ তেমন গ্যাস ব্যবহার করেনা, তাই গ্যাসের চাপ বেশি থাকে, তাই
চুলা ধাও ধাও করে জ্বলে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকের দক্ষিণা হাওয়ায় সে আগুনের
শিখা বাতাসের তালে তালে দুলতো , আর সেজন্যই কিছু একটা নড়ছে বলে মনে হতো।
তার উপর বাতাসে ওর মায়ের রান্না ঘরে ঝুলিয়ে রাখা ওড়না উড়তো, যেটার ছায়ার
নড়াচড়া কিছুটা কোন মানুষের চুলের মতো দেখতে। আর চুলার ঠিক পেছনেই রাখা ছিলো
একটার উপর একটা মশলার বয়াম, যার ছায়া দেয়ালে পড়ে কিছুটা অস্পষ্ট মানুষের
আকৃতি নিয়েছিলো। সবকিছু ফারহিন তার আপু লাবনীর টেবিলে রাখা কিছু বই (ভৌতিক
কল্পকাহিনির, পৌরাণিক কাহিনি , আরো কিছু মিস্ট্রি বই), রাতে তার ভূত এফএম
শোনা, আর কথায় কথায় তার লুসিফারের নাম উচ্চারণ করা, রাতে ফিশফিশ করে
মোবাইলে কথা বলা, আরো কিছু কাকতালীয় ব্যপারের সাথে মিলিয়ে ফারহিন তার
আপুকে ভেবে বসলো সে হয়তো রাতে লুসিফারকে ডেকে আনার চেষ্টা করে। সেদিন রাতে
অবশ্য লাবনী ভূত এফ এম শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার ঠিক খেয়াল নেই।
সেই শব্দই ফারহিনের কানে আসছিল। লাবনীর বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চ নাটকের
কস্টিউমস ছিলো কিছু তার ড্রয়ারে, যা ফারহিন ভেবে বসলো লুসিফারের পূজার
উপকরণ।
ছায়া ব্যাপারে ফারহিন নতুন তথ্য পেলো। ইমদাদুল স্যার ফারহিন আর
অনুশ্রীর কাণ্ড শুনতে পেরে ক্লাসে সবাইকে একসাথে আলো ছায়ার ব্যাপারটা
বুঝিয়ে বললেন।
আলোর অনুপস্থিতিকে বলা হয় ছায়া। আলোর সরল রেখায় চলনের পথে
আলোর সামনে কোনো বস্তুু দ্বারা বাধা পেলে আলোর বিপরীতে একটি অন্ধকার আবহ
তৈরি হয়।যাকে আমরা বলে থাকি ছায়া । ঘনত্ব কম হওয়াতে আগুনের মাঝে আলোকে বাধা
দেওয়ার ক্ষমতা থাকেনা। তাই আলোর ছায়া হয় না। তাছাড়া আগুনের ক্ষেত্রে আগুন
নিজেই আলোর উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে, এবং উৎস একই সাথে উৎপত্তিস্থল এবং
প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতে পারেনা।
কিন্তু মোমবাতির শিখায় ছায়া দেখা যাওয়ার কারণ মোমবাতির মধ্যে কার্বন রয়েছে।
কিন্তু
অধিকতর উজ্জ্বল আলোয় আগুনেও ছায়া সৃষ্টি হয়। যেমনটা আমরা দেখতে পাই
বোনফায়ারের আগুনে দিনের বেলায় সূর্যের আলোয়, যা রাতে কোন ছায়া সৃষ্টি
করেনা। (সমাপ্ত)
লেখক: প্রভাষক, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
গোমতী ভবন, দাতিয়ারা ওয়াপদা কলোনি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
[email protected]০১৬৭৫৫৯১১৩৯
কবিতা.................................
"স্মৃতিবৈকল্য "
সামিরা আব্বাস পরশী ।।
আমি কাকে শুধাব?
কাকে বুঝাবো সেই মনের আকুলতা?
কাকে বলবো খুঁজে দাও, দিবালোকের আলো;
সে যে হারিয়ে গিয়েছে রবির চক্রাকারে,
অত্যন্ত প্রাতঃকালে, নীরব আওয়াজে,
আমি যে আর খুঁজে পেলাম না তাকে!
কাকে বলবো এনে দাও, বাকালতলার ছায়া;
সে যে সংকুচিত হয়েছে শীতের উষ্ণতায়।
চারিপাশ ঝাপসা করে,
আগন্তুক মেঘ ডেকে,
আমি যে আর খুঁজে পেলাম না তাকে!
কাকে শুধাব কঙ্কণে- কঙ্কণে রক্ত ঝরেছে অনেক।
বেলা বয়ে গেল সেই রক্তের স্রোতে।
তবু তাদের পিপাসা মিটল না, মন ভরল না।
কোন তৃপ্তির নিমিত্ত প্রকৃতি আমায় দূরে সরিয়ে দিল।
বলো?
আমি কাকে শুধাব?
কাকে বলবো সেই মনের ব্যাকুলতা।
আমার মধ্যরাত্রির আর্তনাদ আমাকে ছেড়ে গিয়েছে।
তপ্ত রোদ্রমাখা দ্বিপ্রহর বলতে পারো কনকনে শীত,
কিছুই আমাকে ক্লান্ত করতে পারে নাই,
থামাতে পারে নেই উত্তর আকাশের বিভীষিকা,
থামাতে পারে নেই তোমাদের নিয়মের যত বাঁধা।
আমি তবু পাই নি কিছু।
আমি বেঁচে আছি প্রত্যাখানের অবগুন্ঠণে।
স্মৃতিবৈকল্য ঘটল ; তবু স্মরণ করে নিলাম,
কোনো এক কালবৈশাখী ঝড়ে
আকাশ ভেঙে পড়েছিল;
তবু,
তীব্র পিপাসা বুকে নিয়ে আমি পথ হারিয়েছি।
খুঁজে নিয়েছি শুধু দুমুঠো ছাঁই।
আমি কাকে শুধাব?
কাকে বুঝাব সেই মনের আকুলতা!
সভ্যতার মতিভ্রম
নার্গিস খান ।।
সভ্যতার চিত্ত বিকার ঘটেছে, পদস্থলন হয়েছে,
তাল লয় ছন্দ ডিগবাজি খেয়ে নানা কসরৎ এ মত্ত
আলগোছে শক্তি চর্চা করছে
স্বভাব বিরুদ্ধ কাজে প্রকৃতিস্থ
হিংস্র শ^াপদসংকুল ছিঁড়ে খাচ্ছে সভ্যতার কক্ষ পথ,
সভ্যতার সংকট পৃথিবীময়
গ্রহান্তরে বিলীন হচ্ছে চির চেনা পৃথিবী
গভ্যতার কর্তব্য বর্বরতায় নিমজ্জিত,
দুর্দশায় চমৎকৃত শ্রেয় আর শ্রেয় মনুষত্বে
ভব্যতা সভ্যতার শ্রী বৃদ্ধি নাকি জবরদস্তি
চরিত্র চরিতার্থ নিষ্ফলা, কালের ইতরের ইতরতা
অন্তিমকালের চাঞ্চল্য
ভীতি আর বিস্ময়ে উর্দ্ধশ্বাসের ব্যবধানে,
অস্পষ্ট কুয়াশায় গোপন অস্থিরতা
জ¦লন্ত মরুর উত্তপ্ত পথ,
অনুগত ক্রীতদাসের সমানুসন্ধান।
ঝিনুকি চাঁদ, সৌন্দির্য কাঁদে বৈরাগী শহরে
উন্মাদ জোনাকীর বন্ধনহীন বহরে।