ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
হজ আদায় মোমিন জীবনের বড় প্রাপ্তিমুফতি এহছানুল হক মুজাদ্দেদীমহান আল্লাহ আল কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের ওপর অবশ্য কর্তব্য হলো ওই পবিত্র ঘর বায়তুল্লাহর হজ করা, সে যেখানে পৌঁছতে সক্ষম; আর যে কুফুরি করে, সে যেন জেনে রাখে আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭)পবিত্র হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইসলাম ধর্ম পাঁচটি খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো হলো- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও রসুল এ সাক্ষ্য দেওয়া, সালাত কায়েম, জাকাত আদায়, হজ করা ও রমজানে সিয়াম পালন।’ (বুখারি, মুসলিম)হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন, ‘হে আমার উম্মত! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং সামর্থ্য হলে তোমরা হজ আদায় কর।’ (মুসলিম) হজ সবার ওপর ফরজ নয়। হজ ফরজ হতে হলে এ শর্তগুলো থাকা জরুরি- ১. মুসলমান হওয়া। কোনো অমুসলিমের জন্য হজ আদায় করার অনুমতি নেই। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র। তারা যেন মসজিদে হারামের কাছেও না আসে।’ (সুরা তওবাহ, আয়াত ২৮) ২. প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও পাগলের ওপর হজ ফরজ নয়। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে আমলনামার কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে। তারা হলো- পাগল, যতক্ষণ না তার মস্তিষ্ক সুস্থ হয়। ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে জেগে ওঠে। শিশু, যতক্ষণ পর্যন্ত সে প্রাপ্তবয়স্ক না হয়।’ (মুসতাদরাক) ৩. আজাদ বা স্বাধীন হওয়া। দাস-দাসীর ওপর হজ ফরজ নয়। ৪. হজ আদায় করার সামর্থ্য থাকা। এ সামর্থ্য তিন দিক থেকে থাকা শর্ত যথা- ক. দৈহিক সামর্থ্য। অর্থাৎ কাবা শরিফ পর্যন্ত সফর করার শারীরিক যোগ্যতা থাকা। শারীরিকভাবে অক্ষম, অন্ধ, খোঁড়া, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, জরাজীর্ণ বৃদ্ধ স্বয়ং চলাফেরায় অক্ষম এরূপ লোকের ওপর হজ ফরজ নয়। এমন ব্যক্তির যদি আর্থিক সামর্থ্য থাকে তাহলে বদলি হজ করানো ওয়াজিব। খ. আর্থিক সামর্থ্য। অর্থাৎ পরিবার-পরিজন, চাকর-বাকরদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করে কোনো ব্যক্তির কাছে হজে যাওয়া-আসা ও পাথেয় খরচ থাকলে তার ওপর হজ ফরজ হবে। গ. নিরাপত্তা। যাতায়াতের পথ নিরাপদ থাকা। ৫. রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা না থাকা। ৬. হজের সময় বা মৌসুম হওয়া। হজের মৌসুম বলতে শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিনকে বোঝায় অথবা এমন সময়কে বোঝায় যখন থেকে রাষ্ট্রে হজের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কোনো ব্যক্তির জীবনের কোনো একটি বছরে উপরোক্ত শর্তগুলোর সমন্বয় ঘটলে তার ওপর হজ ফরজ হয়ে যায়। সে যদি ওই বছর হজ আদায় না করে এবং পরে যদি সামর্থ্য হারিয়েও ফেলে তবু সে হজ আদায়ের দায় থেকে মুক্ত হবে না। মহিলাদের হজ ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আরও দুটি শর্ত রয়েছে। ১. মহিলাদের সঙ্গে স্বামী অথবা এমন কোনো মুহরিম পুরুষ থাকা। মুহরিম তারা যাদের সঙ্গে চিরস্থায়ীভাবে বিয়ে নিষিদ্ধ। কোনো নারী যদি মুহরিম সঙ্গী ছাড়া হজ করে তার হজ আদায় হবে, কিন্তু মুহরিম ছাড়া সফরের কারণে গুনাহ হবে। এ ক্ষেত্রে বদলি হজ করানোই উত্তম। ২. স্বামীর মৃত্যু বা তালাকের কারণে ইদ্দত পালনকালে নারীরা হজে গমন করবে না। (ফাতহুল বারি)হজ কখন আদায় করতে হয় এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দুটি মত আছে। একদল আলেম মনে করেন কোনো ব্যক্তি যখন হজ করার সামর্থ্য লাভ করে তখন ওই বছরই হজ আদায় করা কর্তব্য। অন্যথায় বিলম্বের কারণে গুনাহগার হবে। বিলম্ব করে পরবর্তী কোনো বছরে আদায় করলেও হজ হয়ে যাবে। কিন্তু অহেতুক বিলম্ব করা অনুচিত। কেননা হজ অনাদায়ী রেখে মৃত্যুবরণ করলে মারাত্মক গুনাহ হবে। হজ আদায়ের আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে তার জীবদ্দশায়ই বদলি হজ করানো উচিত। আর এ সুযোগও না পেলে ওয়ারিশদের উচিত ওই ব্যক্তির বদলি হজ আদায় করে তাকে দায়মুক্ত করা। কেননা হজ সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর মহান আল্লাহর হক। আরেক দল আলেম বলেন, হজ ফরজ হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে বিলম্ব করলে দোষ নেই। কারণ হজ ফরজ হয়েছে ষষ্ঠ হিজরিতে, রসুল (সা.) হজ আদায় করেছেন দশম হিজরিতে। তাই দেরি করে হজ করলে তাতে অসুবিধা নেই। তবে সব আলেম একমত, হজ ফরজ হলে বিনা কারণে দেরি করা উচিত নয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির) এ বছর আরাফার দিন জুমার দিন। হজে আকবর। আল্লাহ নবীজির অসিলায় সবাইকে মকবুল হজ মাবরুর হজ নসিব করুন।লেখক : খতিব, মণিপুর বাইতুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।ভাগে কোরবানির নিয়মমুসলিম উম্মাহর সার্বজনীন দুইটি উৎসবের অন্যতম একটি কোরবানির ঈদ। ঈদুল আজহার প্রধান আকর্ষণ পশু কোরবানি করা।নিজের অর্থে কেনা পশুটি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে জবাই করার মাধ্যমে একজন প্রকৃত মুসলমান মূলত নিজেকে আল্লাহর কাছে সমপর্ণের শিক্ষা নেয়।কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না।যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)* উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগেকোরবানি করা জায়েয। (মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)কোনো অংশীদারের নিয়ত গলদ হলে * অংশীদারদের কেউ যদি আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে, শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে; তাহলে তার কোরবানি শুদ্ধ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে অংশীদারদেরও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অংশীদার নির্বাচন করা জরুরি। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯)কোরবানির পশুতে আকিকার অংশ* কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে অংশীদার হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই  শুদ্ধ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে।* শৈশবে আকিকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকিকা করা যাবে। যার আকিকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকীকারগোশত খেতে পারবে। (ইলাউস সুনান: ১৭/১২৬)* ফাতাওয়া শামীসহ ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোরবানির সাথে আকীকা সহীহ। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; হাশিয়াতুত তহতাভি আলাদ্দুর: ৪/১১৬)হারাম টাকার কোরবানি শুদ্ধ নয়*কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কোরবানি করা শুদ্ধ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য অংশীদারদের কোরবানিও শুদ্ধ হবে না।* কেউ যদি গরু, মহিষ বা উট একা কোরবানি দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয়, তাহলে তার জন্য এপশুতে অন্যকে অংশীদার করা জায়েয। তবে এতে কাউকে শরিক না করে একা কোরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম।* আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কোরবানির নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তার জন্য এপশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ নয়। যদি শরিক করে তবে ওই টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি হবে। কোরবানির পশুতে কাউকে শরিক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে। (কাজিখান: ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১০)তাকবিরে তাশরিকের সূচনা ও গুরুত্বহজ ও কোরবানির মাস জিলহজ এলেই তাকবিরে তাশরিক পড়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়। অথচ বছরজুড়েই মুমিন মুসলমান তাকবিরে তাশরিক পড়েন। তবে হজ ও কোরবানির মাসে নির্ধারিত ৫ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। তাকবিরে তাশরিক আবশ্যক হওয়ার সূচনার ঘটনাও চমৎকার। এর গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং ফজিলতও অনেক বেশি। তাকবিরে তাশরিক কীভাবে শুরু হয়েছিল?তাকবিরে তাশরিক হলো মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশংসার ঘোষণা। আর কোরবানি হলো আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আরো বেশি প্রিয় হওয়ার মাধ্যম। কোরবানি ও তাকবিরে তাশরিক এক সুতোয় গাঁথা। কোরবানির সঙ্গে তাকবিরে তাশরিকের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।আরবি জিলহজ মাসে হজ সম্পাদন করতে হয় আবার এ মাসে হজের নির্ধারিত দিনগুলোর প্রথম দিন ফজর নামাজ থেকে শুরু করে হজের শেষ দিন সূর্যাস্তের আগ অর্থাৎ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত নামাজে আদায় করতে হয়। আর এ সময়ের মধ্যে ১০-১২ জিলহজের মধ্যে আল্লাহর জন্য কোরবানি করতে হয়।৫ দিন তাকবির পড়তে হয় আর এর মধ্যে ৩ দিন কোরবানি করা যায়। হজ, তাকবির ও কোরবানির মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক নিবিড় সম্পর্ক। হজ ও কোরবানি যেমন ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত তেমনি তাকবিরে তাশরিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দাবি রাখে।হজ কোরবানি ও তাকবিরে তাশরিকে সুসম্পর্কহজের মাস ও দিনক্ষণে তাকবিরে তাশরিক ও কোরবানি আদায় করতে হয়। যে দিন থেকে হজ শুরু হয় সেদিন থেকেই তাকবিরে তাশরিক শুরু করতে হয়। আবার সর্বশেষ যেদিন যে সময় মিনা ত্যাগ করতে হয়, সে সময়ই তাকবিরে তাশরিক পড়া শেষ করতে হয়। আর এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা ও ইতিহাস।কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেন-‘এরপর সে (ইসমাইল) যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহিম তাকে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি? সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যধারণকারীর দলভূক্ত পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২)এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে তার সন্তান কোরবানির নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের কথা সন্তানকে জানালে সে-ও তা মেনে নেন। অতঃপর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সন্তান ইসমাইলকে জবেহ করার প্রস্তুতি নিলে আল্লাহ তাআলা তার কোরবানিকে কবুল করে নিলেন।তাকবিরে তাশরিকের সূচনাহজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানির নির্দেশ পালনে জবেহ করার জন্য মাটিতে শোয়ালেন, তখন আল্লাহ তাআলা হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামকে বেহেশত থেকে দুম্বা নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।হজরত ইসমাইলকে জবেহ করার আগে হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম যাতে দুম্বা নিয়ে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ছুরির নিচে দুম্বা পৌঁছাতে পারেন, সে জন্য আকাশেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে থাকেন-(আল্লাহু আকবার; আল্লাহু আকবার) আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান।হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাকবিরের আওয়াজ শুনে কাপড় দ্বারা আবৃত চোখ খুলে দেখলেন হজরত জিবরিল আলাইহি সালাম আনিত দুম্বা ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে কোরবানি হয়ে যায়। তখন তিনি তাওহিদের কালেমা ও তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বলেন-(লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার) অর্থাৎ আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আপনিই শ্রেষ্ঠ।পিতার মুখে তাওহিদের এ অমূল্যবাণী শুনতে পেয়ে হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামও মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন-(আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) আল্লাহ মহান, সব প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।’ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরুত্বএ তাকবিরে তাশরিক হজ পালনকারী, কোরবানি দাতাসহ মুসলিম উম্মাহর জন্য উল্লেখিত ৫ দিন তথা ২৩ ওয়াক্ত নামাজ শেষে পাঠ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। তা শুধুই তাকবির নয় বরং তাকবিরে তাশরিক-মহান আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শুকরিয়া আদায়ের তাসবিহ। যা একজন প্রধান ফেরেশতা, একজন দায়িত্বশীল নবি ও ভবিষ্যৎ নবির কণ্ঠ থেকে আগত তাসবিহ-এর সমষ্টি।এ প্রশংসা বাক্য আল্লাহ তাআলার এতই পছন্দনীয় হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর জন্য কেয়ামত পর্যন্ত উল্লেখিত ৫দিন (৯জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত) ফরজ নামাজের পর তা পাঠ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক।সুতরাং মুসলিম উম্মাহর সব প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ, মুকিম-মুসাফির, গ্রামবাসী-শহরবাসী এবং জামায়াতে কিংবা একাকি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাকবিরে তাশরিকের ইতিহাস জানার পর উল্লেখিত দিনগুলোতে শুকরিয়া হিসেবে এ ওয়াজিব কাজ ‘তাকবির’ আদায় করে তার একান্ত নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আভিজাত্য যখন পুণ্যের কাজমুফতি মুহাম্মাদ ইসমাঈল   মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সবার ভেতর দিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের আকাঙ্ক্ষা। সবার আকাঙ্ক্ষা সমান নয়। কিন্তু আল্লাহ চান সবার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি উন্নত, উৎকৃষ্ট হোক।নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ যাবতীয় উন্নত ও উৎকৃষ্ট পছন্দ করেন এবং নিম্নতা অপছন্দ করেন। (সহিহুল জামে, হাদিস : ১৮৯০)অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দর ভালোবাসেন। (মুসলিম, হাদিস : ১৬৬)আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠটি চাওয়ার নির্দেশ : আমরা যখন মহান আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাই তখন যেন আমরা তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ জিনিসটিই চাই—সে নির্দেশই নবীজি (সা.) আমাদের দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, তোমরা আল্লাহর কাছে চাইলে ফিরদাউস চাইবে, কেননা এটাই সবচেয়ে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। (বুখারি, হাদিস : ২৭৯০)আমরা যেন আল্লাহর উত্তম বান্দা হতে পারি, সবার অনুকরণীয় হতে পারি, মুত্তাকিদের জন্য আদর্শস্বরূপ হতে পারি—তা কামনার নির্দেশও আমাদের দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের রব!...আপনি আমাদের মুত্তাকিদের জন্য আদর্শ বানান। ’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭৪)উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেলাকদের সঙ্গী বানাতে হবে : যারা উচ্চতা ও শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষা করে, আকাঙ্ক্ষা করে মহান রবের সন্তুষ্টি ও তাঁর দিদার লাভের—তাদের সঙ্গী বানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে জুড়ে রাখুন, যারা নিজেদের রবকে সকাল-সন্ধ্যায় ডাকে—তাঁর সন্তুষ্টির অভিলাষী হয়ে। ’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ২৮)রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩৩)অলস সফল হতে পারে না : অলস কখনো সফল হতে পারে না। অলসরা সব কাজ আগামীকালের জন্য রেখে দেয়। কিন্তু আগামীকাল আর আসে না। সফল হতে যদি কোনো কিছু ত্যাগ করতে হয়, তাহলে অলসতাকেই ত্যাগ করতে হবে। কখনো অলসতার দাপটে উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নিঃশেষ হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রাতের বেলা শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের মাথায় একটি দড়ি দিয়ে তিনটি গিরা দেয়। সে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করলে একটি গিরা খুলে যায়। সে উঠে অজু করলে আরেকটি গিরা খুলে যায়। অতঃপর সে যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন সব গিরা খুলে যায়। ফলে সে প্রশস্ত মনে হূষ্টচিত্তে ভোরে উপনীত হয় এবং কল্যাণপ্রাপ্ত হয়। আর সে যদি এরূপ না করে তবে তার ভোর হয় অলসতা এবং অপবিত্র মন নিয়ে। ফলে সে কল্যাণ লাভ করতে পারে না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩২৯)উচ্চাকাঙ্ক্ষার সহায়ক : দৃঢ় সংকল্প ও অবিচলতা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অন্যতম সহায়ক। দৃঢ় সংকল্প ও অবিচলতা ছাড়া অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না। তাই মহান আল্লাহ আমাদের নবীজি (সা.)-কে অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অতএব আপনি অবিচল থাকুন, যেমন অবিচল থেকেছেন দৃঢ় হিম্মতের অধিকারী রাসুলরা এবং আপনি তাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। ’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ৩৫)লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকাবিশুদ্ধ ও উত্তম কোরবানির জন্য পশু নির্বাচনআল্লাহ তাআলা বান্দাকে কোরবানির জন্য তার দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু তাঁরই নামে জবাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের কোরবানি বিশুদ্ধ ও উত্তম হওয়ার জন্য হাদিসের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী পশু নির্বাচন করা জরুরি। পশু নির্বাচনের দিকনির্দেশনাগুলো কী?কোরবানি, আত্মত্যাগের এক অনন্য ইবাদত। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক জাতির জন্যেই ছিল কোরবানির বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)পশু নির্বাচনকোরবানির পশু যেন সেই শ্রেণি বা বয়সের হয় যে শ্রেণি ও বয়স ইসলামি শরিয়ত নির্ধারণ করেছে। ইসলামি বিধান মতে মোট ৬ ধরনের পশু দিয়ে কোরবানি করা যায়। তাহলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এ পশুগুলোকে সুনির্দিষ্ট কিছু দোষ বা খুঁত থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কোরবানির জন্য পশুগুলো অবশ্যই সুস্থ, সুন্দর ও হৃষ্টপুষ্ট হওয়া চাই।অধিকাংশ আলেমদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কোরবানি হল ‘উট’, এরপর ‘গরু’, তারপর ‘মেষ বা ভেড়া’, তারপর ‘ছাগল’। আবার নর মেষ (মহিষ) মাদা মেষ অপেক্ষা উত্তম।’কোরবানির পশুর বয়সইসলামি শরিয়তের আলোকে কোরবানির পশুর বয়সের দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। যে ৬ ধরণের পশু দ্বারা কোরবানি করা যায়, সেগুলোর যথাযথ বয়স হতে হবে।১. উটকোরবানির সময় উটের বয়স ৫ বছর হতে হবে। সহজে উট বা উষ্ট্রী পাওয়া গেলে তা যেন ৫ বছরের নিচে না হয়।২, গরু-মহিষকোরবানির সময় গরু বা মহিষের বয়স ২ বছর হতে হবে।৩. ছাগল-ভেড়া-দুম্বাকোরবানির জন্য ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার পূর্ণ ১ বছর বয়সের হতে হবে।উত্তম কোরবানির জন্য করণীয়যদি কোনো ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা গত কোরবানির দিন জন্ম নেয়; সেই ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা এ বছর ঈদের দিন কোরবানি না করা বরং একদিন পর কোরবানির দ্বিতীয় দিন তা কোরবানি করা উত্তম। যাতে পশুর বয়স পূর্ণ হয়ে যায়। আর এভাবে কোরবানি করাই উত্তম। তেমনি অন্যান্য পশুর বেলায়ও একই মত।ব্যতিক্রম হলো-যদি কোনো কোরবানির পশুর বয়স ৫, ২ ও ১ বছর না হয়; কিন্তু দেখতে ৫, ২ ও ১ বা তার চেয়েও বেশি বলে মনে হয়। অর্থাৎ দেখতে নাদুস-নুদুস, হৃষ্ট-পুষ্ট হয় তবে ওই পশু দিয়ে কোরবানি করা যাবে।উত্তম কোরবানির জন্য পশুর পূর্ণ বয়স হতে হবে। হাদিসে পশুর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। একান্তই যদি উল্লেখিত বয়সের কোনো পশু পাওয়া না যায়; তবে সে ক্ষেত্রে করণীয়ও নির্ধারণ করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে-১. হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর (পাওয়া কষ্টকর) হলে ছয় মাসের মেষশাবক কোরবানি করতে পারবে। (মুসলিম)২. হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা দুই বছরের কম বয়সী পশু কোরবানি করো না। কিন্তু যদি (তা সংগ্রহে) তোমাদের পক্ষে কঠিন হয় তখন তোমরা এক বছর বয়সী ভেড়া যবেহ করতে পার।’ (নাসাঈ)৩. হজরত ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের মধ্যে কোরবানির পশু বন্টন করলেন। আমার অংশে একটি এক বছরের বকরী পড়লো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার অংশে একটি এক বছরের বকরী পড়েছে। তিনি বললেন, তুমি তা কোরবানি কর।’ (নাসাঈ)৪. হজরত কুলাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একবার সফরে ছিলাম, তখন কোরবানির ঈদ উপস্থিত হল। আমাদের একেক ব্যক্তি দু’টি বা তিনটি এক বছরের ভেড়ার পরিবর্তে একটি দু’বছরের বয়সের ভেড়া খরিদ করছিল।তখন মুযায়না গোত্রের এক ব্যাক্তি বলল আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। এমন সময় (কোরবানির) দিনটি উপস্থিত হলে এক ব্যাক্তি দু’টি বা তিনটি এক বছরের ভেড়ার পরিবর্তে একটি দু’বছরের ভেড়া তালাশ করছিল।তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বকরীর ক্ষেত্রে দু’বছর বয়সী দ্বারা যেভাবে কোরবানি আদায় হয়, তদ্রুপ এক বছর বয়সী দ্বারাও আদায় হয়ে যাবে।’ (নাসাঈ)মনে রাখতে হবেযেহেতু দিন-তারিখ নির্ণয় করে বয়সের ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া কঠিন তাই আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত যে কোরবানিদাতার সুবিধার্থে এ বয়স পূর্ণ হওয়ার আলামত স্বরূপ দুটি দাঁত গজিয়ে দেন। কোরবানি বৈধ হওয়ার জন্য পশুর দুটি দাঁত গজিয়েছে কিনা তা দেখে নেয়া। এ দাঁতকে পশুর বয়স নির্ধারিণী দাঁত বলা হয়। এ দাঁতগুলো পশু কোরবানি দেওয়ার উপযুক্ত হওয়ার আলামত বা চিহ্ন মাত্র।বয়স পূর্ণ হলেও দাঁত কখনো কখনো নাও গজাতে পারে কিন্তু দাঁত গজালে বয়স পূর্ণ না হয়ে পারে না। একারণে দুটি দাঁত দেখা গেলে কোরবানির পশুর বয়স যে পূর্ণ হলো তার নিশ্চিত প্রমাণ মিলে। বিধায় দাঁত গজানো একটি জরুরী বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। তবে অনেক পশুর বয়স হওয়া সত্ত্বেও দাঁত ওঠে না; সেক্ষেত্রে দাঁত শর্ত নয় বরং দাঁত দেখা যাক আর না যাক পশুর বয়স হলেই কোরবানি দেওয়া। মূলত দাঁতের কথা হাদিসে উল্লেখ নেই; বয়সের কথাই হাদিসে বলা আছে। (তাফসিরে বাইজাবি)ইসলামি শরিয়তের নীতিমালা হচ্ছেকোরবানির ব্যাপারে পশুর সর্বনিম্ন যে বয়স হওয়া বাধ্যতামূলক তার এক ঘণ্টা কম হলেও কোরবানি সহিহ বা বিশুদ্ধ হবে না। তাই কোরবানির পশুর বয়স যথাযথ হওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশুদ্ধ ও উত্তম কোরবানি আদায়ের জন্য পশু নির্বাচনে উল্লেখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে খেয়াল রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Published : Friday, 8 July, 2022 at 12:00 AM