ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যার সমাধান অনিশ্চিত
Published : Friday, 8 July, 2022 at 12:00 AM
রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যার সমাধান অনিশ্চিতগাজীউল হাসান খান ||
আবহাওয়া ও প্রকৃতিগতভাবে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং সমগ্র পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে দুঃসময় হচ্ছে তাদের লম্বা শীতকাল। প্রচণ্ড তুষারপাত ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে তখন যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে পুরো জনজীবনটাই স্থবির হয়ে পড়ে। বিপর্যস্ত গৃহবন্দি মানুষকে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করাই তখন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন একটি সম্ভাব্য দুঃসময় আসতে আর বেশি বাকি নেই সেখানকার জনপদের মানুষের জন্য।
সেদিকে দৃষ্টি রেখে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বর্তমান সংঘাত ও সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে হবে বিবদমান রাশিয়া ও ইউক্রেনকে। নতুবা অনেক বেড়ে যাবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আশ্বাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি মুখে যত হম্বিতম্বিই করুন না কেন, সেই সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাঁর। বিষয়টি খুব ভালো করেই এখন উপলব্ধি করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাই শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আগেই তিনি চান তাঁর বর্তমান মিশনের ইতি টানতে। ইউক্রেন সংঘর্ষ নিয়ে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ফায়সালায় পৌঁছতে চান পুতিন। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ উত্তরাঞ্চল নিয়ে তাঁর তেমন মাথা ব্যথা নেই। পুতিনের সব আশঙ্কা ছিল কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে। রুশভাষী লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক এবং দক্ষিণের প্রধান বন্দর দ্বীপ ক্রিমিয়া সমস্যার একটা স্থায়ী অথচ টেকসই সমাধানে পৌঁছতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ইউক্রেনে মস্কো সমর্থিত সরকারের পতন ঘটলে লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের দখল নিতে শুরু করেছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কিন্তু লুহানস্কের হাতে ছিল না গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি সেভেরোদোনেৎস্ক ও দোেেনস্কর প্রশাসনিক রাজধানী মারিওপোল। মারিওপোল দোেেনস্কর প্রধান শিল্পাঞ্চল। আর লুহানস্কের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হচ্ছে সেভেরোদোনেৎস্ক। গত চার মাসের প্রাণপণ প্রচেষ্টায় রাশিয়া শেষ পর্যন্ত এসব অঞ্চলের দখল নিতে সক্ষম হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা পরিচালনাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট পুতিন লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন। এরপর এক পর্যায়ে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং পরে দ্বিতীয় প্রধান নগরী খারকিভ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন দক্ষিণাঞ্চল মুক্ত এবং সেখানে নিজের অবস্থান সংহত করার দিকে। মুখে যত কথাই বলুন, প্রয়োজনীয় অস্ত্রের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন জেলেনস্কি। আর এখন শীত আসার আগেই এই চলমান সংঘর্ষের অবসান চান তিনিও। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে সম্ভব হবে এই সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি? এর উত্তর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও পুরোপুরি জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিংবা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যা-ই বলুন না কেন, তাতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না পুতিন। তাঁরা মুখের কথায় সব জয় করে নিতে চান। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সমস্যার সমাধান এখন সুদূরপরাহত। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কথাও হয়তো বিবেচনায় নেবেন না পুতিন। কারণ জাতিসংঘ ওয়াশিংটনের সুরে নৃত্য করে বলেই মনে করে রাশিয়া, চীন এবং আরো অনেকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা থেকে রাশিয়ার সদস্য পদ স্থগিত করার পর থেকে তারা এখন নিরাপত্তা পরিষদের সভায় যোগ দিতেও নারাজ। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতম মিত্র চীনও এ ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি কিংবা অস্ত্র সংবরণ অথবা বিরাজিত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সুচতুর দক্ষতার সঙ্গে কথা বলতে পারেন একমাত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। কারণ ন্যাটোর সদস্য হয়েও তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) নেই। এ ছাড়া ইউক্রেন ও রাশিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী হচ্ছে তুরস্ক। কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী অন্য বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে তুরস্কের অবস্থান। তুরস্কের অনুমতি ছাড়া তার বসফরাস প্রণালি দিয়ে কোনো জাহাজ পারাপার করতে পারবে না। এ ছাড়া কৃষ্ণ সাগরে মোতায়েন রয়েছে তুরস্কের শক্তিশালী নৌবহর। তদুপরি সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে বর্তমান বিশ্বে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে অত্যন্ত কৌশলী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশের সঙ্গে তাঁর রয়েছে একটি সুসম্পর্ক।
আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কংগ্রেসের সিনেটে এখন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের অবস্থান প্রায় সমানে সমান। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস হাউসের সভানেত্রী হিসেবে তাঁর ভোটটি প্রদান করলে ডেমোক্র্যাটরা এক ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেন। এ অবস্থায় জনপ্রিয়তা হারানো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে কয়েকটি সিনেট আসন হারালেই ডেমোক্র্যাটরা হয়ে যাবে সংখ্যালঘু। এর ফলে কংগ্রেসের উচ্চ হাউসে যেকোনো আইন পাস করার অধিকার হারাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। নিম্ন হাউস অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থা তুলনামূলক কিছুটা ভালো হলেও জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন প্রেসিডেন্ট নিজে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ মানুষও এখন চায় না বাইডেন আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিন। কারণ মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সামাজিক অসন্তোষের কারণে বাইডেন প্রশাসন এখন অনেকটাই ডুবন্ত টাইটানিকের মতো অবস্থায় রয়েছে। এতে বাইডেনের হুমকি-ধমকিকে পাত্তা দিচ্ছে না উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনও। সে অবস্থায় ‘এক চীন নীতির’ কথা ভুলে তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রশ্নে চীনকে যত কথাই বলছেন বাইডেন, ধীরস্থির স্বভাবের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিরক্ষা জোট নিয়েও বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছেন না তিনি।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের রাজনৈতিক অবস্থান খারাপের দিকে গেলে শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন সমস্যার কী সমাধান হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। এ ছাড়া আগামী শীতে জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর জ্বালানিসংকট কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে, তা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত জার্মান চ্যান্সেলর আলফ সুলজ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁর কনজারভেটিভ পার্টির যে হাল করে গেছেন, তাতে লেবার পার্টি একজন শক্তিশালী নেতা নির্ধারণ করতে পারলে তাদের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত। নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তুরস্কেও। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় সে নির্বাচন তুরস্ক এবং বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য হবে এক অগ্নিপরীক্ষার মতো। তুরস্কের মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এক উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। করোনা পরিস্থিতি এবং তার পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ তুরস্ককে এক চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাঁর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে সব নীতি-নৈতিকতার দিকটিকে পাশ কাটিয়ে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।

দনবাস অঞ্চলে অর্থাৎ লুহানস্ক ও দোেেনস্ক ঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের অবস্থানকে সুসংহত করার জন্য আগামী দুই মাসের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে রাশিয়াকে। এর সঙ্গে সঙ্গে চালাতে হবে ব্যাপকভিত্তিক পুনর্বাসন ও উন্নয়ন কার্যক্রম। পাশাপাশি ক্রিমিয়া বন্দর দ্বীপসহ কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলকে ন্যাটোর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে নিরাপদ করার জন্য রাশিয়া যে নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিল, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা সম্পূর্ণ কৃষ্ণ সাগরীয় উপকূল হয়ে উঠতে পারে অশান্ত ও সংঘর্ষপ্রবণ। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে ওদেসা ও অন্যান্য সমুদ্রবন্দরকে করতে হবে সামুদ্রিক মাইনমুক্ত। তবে ইউক্রেনের স্বীকৃত অঞ্চল দখল নিয়ে বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার চলমান সামরিক অভিযান যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, তা কিভাবে সমাধান করা যাবে সে আপস ফর্মুলা এখনো বেরিয়ে আসেনি। ইউক্রেনের মারিওপোল এবং বিশেষ করে ওদেসা বন্দর ভবিষ্যতে কিভাবে পরিচালিত হবে, তা এখনো কেউ বলতে পারছে না। মারিওপোল স্বাধীনতা ঘোষিত দোনেৎস্ক অঞ্চলের অংশ হলেও ওদেসা বন্দর ব্যবহার নিয়ে ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে কী ধরনের বোঝাপড়ায় আসতে হতে পারে, তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে রাশিয়া ওদেসা বন্দর দখল করেনি। কিন্তু ওদেসা বন্দরে নৌবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইইউয়ের পণ্যবাহী জাহাজ আসতে সক্ষম হলেও ন্যাটোর কোনো রণতরি ভিড়তে দেবে না রাশিয়া। এ ব্যাপারে রাশিয়া অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির আশঙ্কা দেখলে রাশিয়া ওদেসা দখল করতেও পিছপা হবে বলে মনে হচ্ছে না। সেখান থেকেই আবার এক নতুন সংঘর্ষের উৎপত্তি হতে পারে, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হলেও আশ্চর্যের কিছুই থাকবে না।
আসন্ন শীতে এ অঞ্চল স্থবির হতে এখনো দুই মাস বাকি। এ সময়ের মধ্যে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যার কতটুকু সমাধান সম্ভব, তা কেউ বলতে পারে না। রাশিয়া শেষ পর্যন্ত একটা আপস-নিষ্পত্তিতে সম্মত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এ সংঘর্ষ দীর্ঘায়িত করার পক্ষপাতী। তারা চায় বর্তমান রাশিয়াকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দুর্বল করে দিতে এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষমতা থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে। তেমন একটি অবস্থায় রাশিয়া চায় বেলারুশের সঙ্গে একত্রীকরণ এবং কাস্পিয়ান অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে (ইরানসহ) একটি বৃহত্তর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে। রুশ হামলার আগে যে ইউক্রেন বছরে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য রপ্তানি করেছে, তা এখন সাড়ে তিন লাখ টনে নেমে এসেছে। এ ছাড়া শিল্পক্ষেত্রে রয়েছে অভাবনীয় জ্বালানিসংকট। দেশের লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি ও যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা কেউ জানে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত সাবেক মিনিস্টার
[email protected]