ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আলেয়ার জীবন সংগ্রাম সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়
Published : Wednesday, 3 August, 2022 at 12:00 AM
এডভোকেট গোলাম ফারুক ||
আলেয়া চৌধুরী কুমিল্লা শহরের উত্তর চর্থ এলাকার এক হত দরিদ্র পরিবারে জম্ম গ্রহন করেন পঞ্চাশের দশকে। তার মায়ের নাম আম্বিয়া খাতুন ও পিতার নাম সুলতান আলম চৌধুরী। বাবার নামের সাথে চৌধুরী দেখে মনে হয় এক সময় পরিবারের আর্থিক সংগতি ছিল সাথে বুনিয়াদীপনা। পরিবারটি জীবন সংগ্রামে টিকে থাকলেও নামের সাথে চৌধুরী পদবীর সংযুক্তি ছাড়া এ পরিবারের আর কিছু নেই। দারিদ্রতার কারনে শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয় কিন্তু তার কাব্য প্রতিভা স্বত:স্ফুর্ত ভাবেই বিকশিত হতে থাকে। তিনি এক স্বশিক্ষিত নারী। ত্রিশ বছর বয়সে মাছ ধরার নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মার্কিন মূল্লূকে যান। তিনি বিভিন্ন দেশে গেছেন কাজের সন্ধানে এবং নানা বর্ণের, ধর্মের মানুষের একান্ত সান্নিধ্যে এসেছেন; যার ফলে তার দৃষ্টি ভঙ্গি ব্যাপক ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
আলেয়ার পরিবারটি এতটাই দরিদ্র ক্লিষ্ট ছিল যে,তার সঠিক জম্ম তারিখ টি ও আজ  পর্যন্ত নিরুপন করা যায় নি। আলেয়া জম্ম গ্রহন করেন কুমিল্লা শহরের উত্তরচর্থা গ্রামে, তার মাতার নাম আম্বিয়া খাতুন ও পিতার নাম সুলতান আলম চৌধুরী। পরিবারটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার তাই কন্যা সন্তানের লেখা পড়ার দিক তেমন আগ্রহ নেই। তবে পরিবারের আর্থিক সঙ্কট ও কন্যা সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে বিরাট বাধা সত্বেও লেখাপড়ার  প্রতি আলেয়ার দূর্বার আকর্ষণ আলেয়া কে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে ভর্তি হয়ে যান এলাকার প্রাইমারি স্কুলে। বিষয়টি লোকমুখে শুনে পরিবারের নিকট জানাজানি হয়ে গেলে আলেয়ার ভাগ্যে জুটে বেদম শারিরীক নির্যাতন। কন্যা সন্তানের প্রতি এরুপ শারিরীক নির্যাতন কিছুতেই মানবার পাত্রী নন আলেয়া। স্কুলের এক বান্ধবীর নিকট শুনতে পেয়েছিল কুমিল্লা শহরের ফরিদা বিদ্যায়তন নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় আছে যার প্রধান শিক্ষিকা ছাত্রীদের লেখাপড়ায় সাহায্য করে। কাউকে না জানিয়ে বাড়ী থেকে বেড় হয়ে দেখা করলেন ফরিদা বিদ্যায়তনের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকা সেলিনা বানুর সাথে। সেলিনা বানুর সম্পর্কে দুটি কথা বলা প্রয়োজন। সেলিনা বানু পাবনার মেয়ে স্বামী শাহাজাহান খন্দকার। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সর্বহারার রাজনীতি করেন,  কমিউনিষ্ট পাটির সদস্য। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করে পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামীলীগ নেতা শিল্পপতি হালিমা টেক্সটাইল এর মালিক জনাব জহিরুল কাইয়ুম তাহার একমাত্র কন্যা ফরিদার স্মৃতি রক্ষার্তে ফরিদা বিদ্যায়তন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্কুলটির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তিনি একজন মানবিক গুন সম্পন্ন প্রধান শিক্ষকের সন্ধানে ওনার কলেজ জীবনের সহপাটি রাজনৈতিক বন্ধু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদ কে অনুরোধ করলে, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদ বন্ধু শাহাজাহান খন্দকার ও ওনার স্ত্রী ৫৪ পার্লামেন্টের সদস্য সেলিনা বানুর সাথে যোগাযোগ করে দিলে সেলিনা বানু ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন। এ ব্যাপারে বিপ্লবী অতীন রায় বাবুর ও ভূমিকা ছিল। সেলিনা বানু আলেয়ার পিতা ও মাতার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে তাকে ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আলেয়া বাসা বাড়ীর কাজের কথা বলে চলে আসতো সেলিনা বানুর বাসায়। এই বাসা থেকে সেলিনা বানুর দেওয়া স্কুলের ইউনিফর্ম পরে ক্লাসে যেতেন ক্লাস শেষ হলে স্কুলের ইউনিফর্ম সেলিনা বানুর বাসায় রেখে তার নিজ পোষাকে বাড়ী ফিরতেন। এই ভাবে চলছিল তার লেখাপড়া। সেলিনা বানু ছিলেন সর্বহারা আদর্শে দিক্ষিত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। তাই তার এই ছাত্রীকে স্কুলে পাঠ দানের বাহিরে প্রচলিত নারী বিদ্বেশী সমাজ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শিক্ষা দেয়। যা আলেয়ার জীবন চলার পথে অমোঘ শক্তি।
পরিবারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে লেখাপড়া চলছিল আলেয়ার। এর মধ্যে বিষয়টি পরিবারের নিকট জানাজানি হয়ে গেলে অভিভাবকরা তার উপর অকথ্য নির্যাতন করে এবং মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে জোর করে বিবাহ দিয়ে দেয়। রীতি মাফিক বিবাহের পর দিন স্বামী কে নিয়ে (আড়াইয়া) বাপের বাড়ীতে আসে। মা’কে জানায় সে কিছুতেই স্বামীর বাড়ী যাবে না। মা বুঝেছিল এই মেয়ে কে জোর করে ঘরে আটকানো যাবে না। মা’কে বলে ঐ রাত্রে বাড়ী থেকে পালিয়ে ট্রেনে চড়ে ঢাকা কমলাপুর ষ্টেশনে পৌছায়। কিশোরী এই বালিকা সমাজ এর প্রতি এক বিস্ফোরনের আগুন নিয়ে অজানার পথে পা বাড়ালো। এই কমলাপুর ষ্টেশনে একটি টি ষ্টলে তার সাথে পরিচয় হলো এক কিশোরীর, তাকে আপ্যায়ন করল চা আর বন রুটি দিয়ে। এই চা দোকানে ই তার চাকুরী হল কাপ প্লেইট ধোয়ার বিনিময়ে জুটল তিন বেলা খাবার।
সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় গাড়ী চালক আব্দুল আওয়ালের সাথে। তিনি তাকে তার বাসায় নিয়ে যান। আলেয়ার বয়সী রওশন নামে তার একটি মাতৃহারা কন্যা ছিল। সকাল বেলা কাজে যেতে তাদের দু’জন কেই সাথে করে নিয়ে যেতেন আওয়াল ড্রাইভার। এই ভাবে বাসে থাকতে থাকতে আলেয়া বাস কন্ডাক্টর হয়ে উঠেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মহিলা বাস কন্ডাক্টর হিসাবে সেই সময় আলেয়ার ছবি ছাপা হয়েছিল জাতীয় দৈনিকে। এর মধ্যে আলেয়া পত্রিকা বিক্রির কাজ নেয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের প্রবেশ পথের কোনে দাড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করে। আজ থেকে অর্ধশত বছর পূর্বে এইরুপ উঠতি বয়সের একটি মেয়ে পত্রিকা হকার ব্যাপাড় টি অনেকের নজরে কাড়ে। একদিন চলচিত্র নির্মাতা উদয়ন চৌধুরী আলেয়াকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করেন ” তুই আমাকে পত্রিকা দিতে পারবি”?  আলেয়া খুশি হয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়েন। এরপর তিনি একটি কাগজে লিখে দেন বাড়ির ঠিকানা, কি-ভাবে কোন বাসে যেতে হবে তা ও বলে দেন তিনি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যখন পত্রিকা দিতে যেতেন আলেয়া তখন তার পাশে বেগম সুফিয়া কামাল এর বাড়িতে ও পত্রিকা দিতেন । এর মাস ছয়েক পর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল। ফলে পত্রিকা বিলি করার কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন আলেয়া।
পরিবার সূত্রে জানা যায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আলেয়া একবার কুমিল্লায় এসেছিল। সেই সময় তার বাড়ীর এলাকার কিছু বয়োজ্যাষ্ঠ ব্যাক্তি তথাকতিথ হুজুর রা তাকে দেখে ভিশন ক্ষুব্দ হয়ে উঠেন। এর কারণ ছিল আলেয়ার গৃহ ত্যাগের মূল কারন ছিল আলেয়ার প্রতি তাদের বিরুপ মন্তব্য ও বিদ্বেস। এমন অবস্থা হলো যে তাকে আর কিছুতেই তার বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে আলেয়ার মামা আব্দুল মজিদ আলেয়াকে নিয়ে চাঁদপুর গিয়ে ঢাকাগামী লঞ্চে তুলে দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকালিন সময়ে আলেয়া সম্পর্কে আর বেশী কিছু জানা যায়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র ১৩ বৎসর বয়সে আলেয়া গাড়ী চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে ভর্তি হন একটি ড্রাইভিং স্কুলে। ড্রইভিং শিক্ষা সমাপ্ত করে আলেয়া হয়ে যান বাংলাদেশের প্রথম মহিলা বাস ড্রাইভার। পেশাদার ড্রইভিং লাইসেন্স এর আবেদন করলে মহিলা হওয়ার কারনে আবেদন না মঞ্জুর হয়। ইতমধ্যে আলেয়ার ড্রাইভার হওয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হলে সংবাদটি বঙ্গবন্ধুর নজড় কাড়ে। আলেয়া কে গন ভবনে ডেকে আনেন বঙ্গবন্ধু। বলেন,“মেয়েদের জন্য বাস ড্রাইভার হওয়া নিরাপদ নয়” আমি তোকে একটা সেলাই মেশিন দেই সেলাইয়ের কাজ শুরু করে দে। পুরুষ শাষিত সমাজের রক্ত চক্ষুকে অগ্রাহ্য করবেই তাই আলেয়া তখন বিনয়ের সাথে সেলাইয়ের মেশিন নিতে অস্বীকার করেন এবং তার ড্রইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পক্ষে জোড়ালো যুক্তি তুলে ধরেন। আলেয়া বঙ্গবন্ধু কে অনুরোধ করেন বাংলাদেশে এমন একটি আইন করতে, যাতে মেয়েরা গাড়ী চালানোর প্রশিক্ষন নিতে পারে এবং নির্ভিগ্নে গাড়ি চালানো কে পেশা হিসেবে গ্রহন করতে পারে। প্রচন্ড ক্ষোভ ও অভিমানে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসেন। এরপর বঙ্গবন্ধু তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ফোনে বলেন আলেয়াকে খুঁজে বের করে তাকে একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতে। বঙ্গবন্ধু জননেতা বুঝতে পেরেছিলেন আলেয়ার অন্তরের মর্মজালা। তাই আলেয়ার জীবনকে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর এ প্রয়াস।
যেই কথা সেই কাজ জনাব মিজান চৌধুরী আলেয়াকে খুঁজে বের করে বাংলাদেশ বেতারে চাকুরী দিয়ে দিলেন। এতদিনে হয়ত আলেয়ার বাউন্ডুলে জীবনের অবসান হল। মিজান চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতের সময় তার সঙ্গী হয়েছিল সেলিনা হোসেন ও কবি নির্মলেন্দু গুন। স্বশিক্ষিত কবি আলেয় চৌধুরী বাউন্ডুলে জীবনে ও কবিতা লিখেছেন নিরন্তর, ছাপা হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে, কবি সুফিয়া কামালের সাথে আলেয়ার পরিচয় ঘটেছিল হকারী জীবনে। পরবর্তীতে পরিচয় ঘটে সেলিনা হোসেন ও কবি নির্মলেন্দু গুন এর সাথে। সুশৃংখল জীবনে চলার সুবাদে তার কাব্য প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। এবার তার সাথে পরিচয় ঘটে সাংবাদিক শাহারিয়ার কবির ও সোহরাব হাসানের সাথে আরো পরিচয় ঘটে এক সময়ের বাম রাজনীতির সক্রিয় নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর ঘনিষ্ট সহচর বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক আব্দুল মোনেম সরকারের সাথে। কবি, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিকদের এক বিশাল বলয়ে আলেয়ার জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাংগালী জাতীর জীবনে নেমে আসে এক অমানিসার ঘোর অন্ধকার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর জন্য স্ব-পরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। এর ই সাথে আলেয়ার জীবনে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। পাকিস্তানী ধারার রেডিও বাংলাদেশে চাকুরিতে ইস্তেফা দিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। কিছুতেই ভুলতে পারছিল না জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ধন্য স্মৃতি কথা।
আবারো বদলে যায় আলেয়ার জীবনের দৃশ্যপট। দেশে তখন জিয়াউর রহমানের রক্তের হুলি খেলা। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের ফাঁসি যখন নিত্য দিনের খেলাধূলা। কবি আলেয়া চৌধুরীর কলমে তখন আগুন ঝড়ে। তিনি লিখলেন,“ মানুষ কেন গরীব হয়”। পত্রিকায় ছাপা হলো,‘ ‘পতিতালয়’। এই কবিতায় দৃষ্টি গেল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এর। ক্ষুব্দ জিয়াউর রহমান ডেকে নিলেন আলেয়াকে বললেন তুমি দেশ ছাড় না হলে মোল্লা মৌলভীরা তোমাকে মেরে ফেলবে সাথে আমাকে ও। সামরিক আইন বলে কথা, সকালে আলেয়ার সাথে এই কথা আর বিকালেই আলেয়াকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় বিমান বন্দরে, সেখানে পরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধুর খুনী বজলুল হুদার সাথে এবং তারই সাথে ইরান গামী একটি বিমানে তুলে দেওয়া হয় আলেয়াকে। বঙ্গবন্ধুর খুনীর সাথে ইরানে বসবাস আলেয়ার জন্য মৃত্যুর সামিল। বজলুল হুদা আলেয়াকে ইরানস্থ বাংলাদেশ দূতবাসে চাকুরী দিতে সম্যত হলে ও আলেয়া রাজী হয়নি। বজলুল হুদাকে অনুরোধ করে অন্যত্র একটি চাকুরী নিয়ে দেওয়ার জন্য। বজলুল হুদা আলেয়াকে ইরানস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছে নিয়ে যায়। জার্মান রাষ্ট্রদূত আলেয়া কে প্রশ্ন করে তুমি কি কাজ জান? আলেয়া উত্তর দেন গাড়ি চালাতে জানি। রাষ্ট্রদূত এর এ কথা বিশ^াস হচ্ছিল না তাই তার গাড়ির চাবি আলেয়ার দিকে ছূড়ে দিয়ে বলে যাও গাড়ি ষ্টার্ট দাও। আলেয়া ও তড়িৎ গতিতে গাড়িতে উঠেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম নকেই ষ্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালাতে উদ্যত হলে রাষ্ট্রদূত তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলে এবং বলে যাও তোমার চাকরী হয়ে গেল। বিদেশে তুমি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারবে না তাই আমার অফিসে আমার চবৎংড়হধষ অঃঃবহফধহঃ হিসাবে কাজ করবে। আলেয়ার চাকুরী হয়ে গেল ইরানস্থ জার্মন এম্বেসিতে । অভাগিনী যে দিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। স্বস্থির মাঝে অশনি সংকেত বেজে উঠল। এই জার্মান রাষ্ট্রদূত বদলী হলেন পাকিস্তানে। আলেয়াকে বললেন আমার সাথে চল পাকিস্তানে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। আলেয়া বলল যে পাকিস্তান আমার ৩০ লক্ষ বাংগালীকে হত্যা করেছে আর চার লক্ষ মা বোনের ইজ্জত হরণ করেছে সেই নর পশুর দেশে আমি কিছুতেই যেতে পারি না। অবশেষে জার্মান রাষ্ট্রদূত  বলল আমি জার্মান যাব জার্মান হয়ে পাকিস্তান যাব। তুমি চাইলে আমার সাথে জার্মান যেতে পার আমি তোমাকে জার্মানিতে রেখে পাকিস্তান যাব। আমি আশাকরি জার্মানিতে তোমার কোন না কোন একটা চাকুরীর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। জার্মানীতে যেয়ে আলেয়া বুঝতে পারেন জার্মান ভাষা না জানলে জার্মানীতে থাকা দুস্কর। তাই মনে মনে পরিকল্পনা করেন যে করেই হোক আমেরিকার পৌছাতে পারলে আমার হয়ত ভাগ্য খুলবে। এখন আলেয়ার একমাত্র চিন্তা কি ভাবে আমেরিকায় পৌছানো যায়। আমেরিকার উদ্দেশ্যে আলেয়া জার্মানী ছাড়েন এবং জর্ডানে আসেন অভিবাসী হয়ে সেখানে থেকে যান বাহামা।
এই দেশ থেকে সমুদ্র পথে আমেরিকার যাওয়ার পথ খুজছেন আলেয়া, ঘটনা পরিক্রমায় আলেয়া এখন ৩০ বছর। খোজ মিলল চোরাই ভাবে সমুদ্র পথে আমেরিকার যাওয়ার পথ। পরিচয় হলো এক নিগ্রো মহিলার সাথে। মহিলার সাথে চুক্তি অনুযায়ী মহিলা আলেয়াকে নিদৃষ্ট দিনে আরো ১২জন পুরুষের সাথে একমাত্র মহিলা কে তুলে দিল একটি ইঞ্জিন চালিত রাবারের নৌকায়। মনে মনে আলেয়া ভাবল বাংলাদেশকে যেমন নৌকা মার্কা স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাকে ও নৌকা ই আমেরিকা পৌছে দেবে। নৌকাতে তুলে দিয়ে ঐ নিগ্রো মহিলা পুরুষ যাত্রীদের সপথ করায়ে বলল,  আমি আশাকরি তোমরা ১২জন পুরুষ এই একজন মহিলাকে বিপদে রক্ষা করবে। নিগ্রো মহিলা সংগোপনে যে কাজটি করলেন তিনি আলেয়ার নিকট কিছু জম্ম নিয়ন্ত্রন বটিকা দিয়ে দিলেন হাজার হলে ও পুরুষ মানুষের সাথে যাচ্ছ কখন কি ঘটে যায়। ঈশ^র তোমাকে রক্ষা করুক। আলেয়া ভেবে নিল স্বাধীনতা যুদ্ধে হাজার হাজার মহিলা পাক সেনার হাতে সভ্রম হারিয়ে ও সংবাদ পৌছে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। আমি তাদের ই বোন। যে কোন যুদ্ধেই আমাকে জিততে হবে এখানে নৈতিকতা পরাভূত। জীবন যুদ্ধের জয় না সতিত্বের জয়, কার জয় হয় হবে এই যুদ্ধে একথা শুধু জানেন সৃষ্টিকর্তা। সাগরের উত্তাল তরঙ্গে ভাসছে তরি, দুলছে আলেয়ার স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পৌছা। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কোনরূপ দূঘর্টনা ছাড়াই সোনার তরি আমেরিকার মাটি স্পর্শ করল। বিপত্তি ঘটালো আমেরিকার ইমিগ্রেসন পুলিশ। গ্রেফতার করলো তাদের ১৩জন অভিবাসী কে। আলেয়া পুলিশের কাছে খুব করে কান্না কাটি করাতে ও নারী হওয়ায় পুলিশের দয়া হলো এবং আলেয়া কে ছেড়ে দিল। প্রসঙ্গত বলে রাখি আলেয়া ইরানে অবস্থান কালে ভারতীয় এক নারী মঞ্জু ব্যানার্জির সাথে পরিচয় ঘটেছিল। যিনি বর্তমানে নিউইর্য়কে বসবাস করেন। ওনার সাথে আলেয়ার যোগাযোগ থাকায় মঞ্জু ব্যানার্জির ঠিকানা জানা ছিল। আলেয়া সাহায্যের আশায় মঞ্জু ব্যানার্জির বাসায় যেয়ে উঠলেন তখন রাত্রী কাল। এবার বাধ সাধল মঞ্জু ব্যানার্জির স্বামী কিছুতেই তাকে যায়গা দেওয়া যাবে না। মঞ্জু ব্যানার্জি স্বামী কে বললেন মেয়ে মানুষ  রাত্রীবেলা অপরিচিত শহরে কোথায় যাবে রাত্রীটা কাটুক। রাত্রী শেষে ভোর হলে মঞ্জু ব্যানার্জি আলেয়াকে বলল তুমি খানিক সময়ের জন্য ঘুরে আস  সাহেব অফিসে গেলে তুমি আমার কাছে আস। কথানুযায়ী তাই হল। রাত্রে স্বামী বাসায় ফিরলে মঞ্জু ব্যানার্জি স্বামীকে বুঝাতে সক্ষম হল মহিলা আমাদের বাড়ীতে থেকে যাক আমাদের ছেলেকে দেখাশুনা করবে। আলেয়া মঞ্জু ব্যানার্জির দুরন্ত এই ছেলেটিকে আদরে স্নেহে মানুষ করতে পেরেছিলেন। এই জন্য মঞ্জু ব্যানার্জির পরিবার আলেয়ার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।
অস্তিতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেশাগত গাাড়ি চালক হওয়ার প্রচেষ্টাকে সম্মান এবং স্বীকৃতি দান করে তাকে নিয়ে আমেরিকার ঝঁসসবৎ ম্যাগাজিন ডড়সবহং ড়ভ ঃযব ণবধৎ শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে। অষবুধ : অ ইধহমষধফবংযর ঢ়ড়বঃ রহ অসবৎরপধ. শীর্ষক ডকুমেন্টারি তৈরী করেছেন দিনা হোসেন। এই ছবিতে মজদুর শ্রেণী থেকে আগত এক নারী বাদী কবির সংগ্রামের কথা চিত্রায়িত হয়েছে। এই ফ্লিমের জন্য কলকাতা থেকে ‘কলাকিতি’ পুরুষ্কার অর্জন করেন দিনা হোসেন ২০১৬ সালে। নিউইর্য়ক থেকে প্রকাশিত নারী ম্যাগাজিন থেকে ও সম্মাননা জানানো হয় তাকে।
২০০১ সালে আলেয়ার জীবনের ঝড় যখন থেমে গেছে, তখন প্রাকৃতিক এক ঝড়ে আলেয়ার নিউইর্য়কের বাড়ীর একটি গাছ পরে গেলে  আলেয়া নিজেই গাছ কাটতে গেলে বুকে ব্যাথা অনুভব করেন, তখন ই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরাপরে আলেয়ার শরীরে মরণ ব্যাধী ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। এর সাথে যুদ্ধ করে হার না মানা এই নারী ক্যান্সার এর নিকট হেরে  ২০২০ সালে ৩ আগষ্ট এই নশ^র পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
এডভোকেট গোলাম ফারুক
লেখক ও গবেষক