অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭ এ, ইপিআই-২০২২ এর সূচক অনুযায়ী। ১৭৯ এ তার অবস্থান ছিল ২০১৮ সালের সূচকে। আইন ও নীতিমালার মধ্যে পরিবেশ নীতি ১৯৯২, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র আইন ২০১৭, ইটপোড়া আইন ১৯৮৯, বাংলাদেশ শব্দদূষণ বিধি ২০০৬ (পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর অধীনে) মহানগরী জেলা ও বিভাগীয় শহরের পৌর এলাকাসহ পৌর এলাকায় খেলার মাঠ, উদ্যান, খালি জায়গা, ও প্রাকৃতিক জলাধার আইন-২০০০, মাংশ নিয়ন্ত্রণ ও পশু জবাই আইন ও বিধিনিষেধ ১৯৫৭, উল্লেখযোগ্য এবং পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। তারপরেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সই করেছে সেইরকম প্রটোকল রয়েছে অনেক। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জলাভূমি রক্ষায় ‘রামসার কনভেনশন-১৯৭১, বায়োলজিক্যাল ভেরাইটি কনভেনশন ১৯৯২, ওজোন স্তর রক্ষার্থে ‘মন্ট্রিয়েল প্রটোকল ১৯৮৭’, গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে কিয়াটো প্রটোকল ১৯৭৭, ইউনাইটেড নেশানস কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ১৯৯২ ইত্যাদি। পরিবেশ সংরক্ষনে বাংলাদেশ তার নীতিমালা, বিধি, আইন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকল বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করে নাই। যার জন্য পরিবেশ দূষণে আজ দেশ এক হুমকির মোকাবেলায় উপস্থিত হয়েছে।
বায়ূদোষনের জন্য বাংলাদেশীদের গড় আয়ু অনেক কমে আসছে বলে গবেষণায় উঠে আসছে। শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউটের গবেষকরা বলেছেন গড়ে সাড়ে সাত বছর আয়ু হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা শুধু দূষনের কারনে। স্যাটেলাইট তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে শিকাগো বিশেষজ্ঞরা বাতাসে ক্ষতিকর ভাসমান কনা যা ফুসফুসের ক্ষতি করে তার পরিমান বেড় দাড়িয়েছে পিএম-২.৫। তাঁরা বায়ুদোষণে বাংলাদেশকে সবচে বেশি দূষনের দেশ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বায়ুদূষনের সবচে বেশি দূষনের শিকার বিশ্বের পাঁচটি দেশের মধ্যে চারটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বায়ু মানের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী হচ্ছে ভারতের নয়াদিল্লী। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় যদি ডব্লিউএইচও বেধে দেয়া সীমা প্রয়োগ করা হয় তবে গড় আয়ু ৬ বছর ৯ মাস করে কমেছে। কিছু এলাকায় দূষণের মাত্রা এতই বেশী যে সেখানে গড় আয়ু কমার পরিমান ৯ বছর। গবেষকরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রসূতি মা এবং শিশুদের বেলায় গড় আয়ু দেড় বছর কমে যাচ্ছে অপুষ্টির কারনে বলে স্বীকার করেন। ধূমপানের জন্য আরও দেড় বছর গড় আয়ু কমে যায় বলেও গবেষনায় এই গড় আয়ু কমার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। গবেষণায় ভারতের কয়েকটি এলাকাকে সর্বোচ্চ দূষনের উপস্থিতি শনাক্ত করা হলেও সার্বিকভাবে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশী বায়ুদূষণকারী দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এক সংবাদ সম্মেলনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে রাজধানীর ১০টি স্থানে বছর জুড়ে বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে ছিল এর মধ্যে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বেশী দূষনের স্থান হিসাবে শাহবাগ এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে গবেষণায় চরম ক্ষতিকর বাতাসে ভাসমান সুক্ষ বস্তুকণা ২.৫ এর গড় উপস্থিতি নির্ধারন করা হয়েছে যাহা আদর্শ মানের তুলনায় ৫.৬ গুন বেশী। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশী শব্দ দূষণ পাওয়া গিয়েছে গুলশান-২ এ। এ এলাকায় গড় শব্দমান ছিল ৯৫.৪৪ ডেসিবেল, যা মানুসের স্বাভাবিক সহ্য ক্ষমতার ১.৭ গুন বেশী। ২য় অবস্থানে ছিল আব্দুল্লাহপুর। সেখানেও শব্দের মান ৯৫.৪৩ ডেসিবেল পাওয়া যায়। তবে শব্দ ও বায়ুদূষণ উভয় ক্ষেত্রে সংসদ ভবন এলাকা ছিল সর্বনিম্নে। শব্দের দিক থেকেও সবচে কম মাত্রা ছিল সংসদ ভবন এলাকায়। শব্দের মাত্রা ছিল ৩১.৭ ডেসিবেল। ঋতুর দিক থেকে শীতকালে ঢাকায় বায়ুদূষণ হয় সবচেয়ে বেশী। সেই সময়ে বস্তুকনার উপস্থিতি আদর্শ গড় মাত্রার চেয়ে ৮.৪ গুন বেশী। প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণাধীন এলাকাগুলোতে উপাত্ত সংগ্রহের সময়ের ১০ শতাংশ সময়ে গড়ে ৮৪.৬২ ডেসিবেলের উপরে ছিল। ৫০ শতাংশ সময় গড়ে ৭০.২ ডেসিবেলের উপরে ছিল এবং ৯০ শতাংশ সময় শব্দের মাত্রা ছিল গড়ে ৫৬.২৩ ডেসিবেল।
সেটেলাইটের তথ্যানুযায়ী ২০২০ সনে বাংলাদেশে প্রতি ঘন মিটার বাতাসে পিএম ২.৫ এর উপস্থিতি ছিল ৭৮.৮ মাইক্রগ্রাম। কোভিড-১৯ মহামারিতে লকডাউন চালু অবস্থায়ও এই দূষণকারী কনার উপস্থিতি বেড়েছে ১৩.১ শতাংশ। তবে এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয় কারন এতে এক দশক ধরেই এদেশে দূষণকারী কনার উপস্থিতি ডব্লিউএইচও নির্ধারিত সীমার চেয়ে ১২ থেকে ১৫ গুন বেশী রয়েছে। ২০১৯ সনে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ এর পরিমান ছিল ৬৭ মাইক্রগ্রাম এবং গত একদশকে তা ৬৩ থেকে ৭৭ মাইক্রগ্রামের মধ্যে উঠানামা করিতেছে। গত দুই দশকে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্প স্থাপন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির বড় ভূমিকা রেখেছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। শিল্পায়ন ও উন্নয়নের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে বিপুল পরিমানে জীবাশ্ম জ্বালানীর চাহিদা। শুধু ভারত ও পাকিস্তানে ২০০০ এর শুরুতে মোটর গাড়ী বেড়েছে চারগুন। বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোটগাড়ী বেড়ে ৩ গুন হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বেড়ে তিনগুন হয়েছে। জ্বালানী একটি পরিবেশ সমস্যা এবং জীবাশ্ম জ্বালানী আরও বড় সমস্যা। জীবাশ্ম জ্বালানীও এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে অনেক বেশী দামে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের সব সময় জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর কথা চিন্তা করা উচিত। গোটা বিশ্ব বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষায় মনযোগী। উন্নত বিশ্বে অবাধে কার্বন নি:সরন অব্যাহত রেখেছে যা দরিদ্র জনগোষ্ঠির দূর্ভোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এসমস্ত কারনে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে সময়োপযোগী এবং পরিবেশ সম্মত শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনকে ঠেকাতে একটি টেকসই জ্বালানী ব্যবস্থায় পৌছাতে বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে আসছেন। নবায়নযোগ্য জ্বালানী এমন এক শক্তির উৎস যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং শক্তির উৎসটি নি:শ্বেষ হয় না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমন, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, সূর্য্যরে আলো ও তাপ, বায়োগ্যাস, সমুদ্র তরঙ্গ, জোয়ার ভাটা, শহরের আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে জনস্বাস্থ্যের জন্য বায়ু দূষণের হুমকিকে খাটো করে দেখা ঠিক নয় এবং এ সংকট মোকাবেলায় সঠিক পরিমাণে অর্থও বরাদ্দ করা হয় নাই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বায়ুদুষন রোধে বাংলাদেশ তাদের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াবে। বর্তমানে চার শহরে চালু থাকা তাৎক্ষনিক পরিমাপ ব্যবস্থা বাড়িয়ে আট শহরে বিস্তৃত করবে।
এ প্রসঙ্গে ঈদের ছুটিতে ফাঁকা ঢাকায় প্রায় দূষণ শূন্য দিনযাপনের সুযোগ পেলেন নগরবাসী। এসময়ে যারা ঢাকায় থাকলেন তারা বিশুদ্ধ বায়ু পেলেন বলেই ধরে নেয়া যায়। শব্দদূষণের আগ্রাসন থেকেও তারা কিছুটা মুক্ত ছিলেন। বায়ুমান নির্ধারনকারী ‘একিউআই’ ও ‘ক্যাপস’ এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ঈদের আগের ও পরের ৬দিন ঢাকার মানুষ বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে পেরেছিল। এই সময়টায় বন্ধ ছিল শব্দ ও বায়ুদূষণের সবগুলি উৎস। ঈদের ছুটিতে দূষণমুক্ত ছিল ঢাকার পরিবেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদের ছুটিতে প্রায় এক কোটি লোক ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। পরিবেশ সঠিক থাকায় চতুস্পার্শে থাকা বৃক্ষরাজি নগরীর শোভা বৃদ্ধি করে। শব্দদূষণ বিহীন যানজটমুক্ত নগরীতে বুক ভরা নি:শ্বাস নিয়ে প্রশান্ত প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায়। গবেষকরা বলেছেন, এমন পরিবেশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি দায়িত্বশীল আচরন করা হয় তবে বিশ্বের তালিকায় বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের শীর্ষে থাকা ঢাকাকে নির্মলতার সীমানায় নিয়ে আসা সম্ভব।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
সদস্য, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।