আহমদ রফিক ||
‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’র মধ্যে ‘রাশি রাশি’ সোনালি ধান কাটার কবি রবীন্দ্রনাথ; বাইশে শ্রাবণেই তাঁর শেষ যাত্রা। আশ্চর্য সেদিনটি ‘বর্ষণমুখর’ ছিল না, বলতে হয় প্রকৃতির খেয়াল।
স্বদেশে প্রকৃতিমুগ্ধ কবি। হলে কী হয়।
তাঁর নেশা ছিল ভ্রমণে, শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-দক্ষিণেই নয়, নেশা প্রধানত বিশ্বসফরে—মূলত ইউরোপ-আমেরিকায়। সবচেয়ে বেশি ব্রিটেনে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এককথায় বিশ্বপথিক। বিশ্বের আর কোনো কবি-চিন্তাবিদ সম্ভবত বিশ্বের এত দেশ ভ্রমণ করেননি। এই ভ্রমণতালিকায় জাপানও ছিল তাঁর একটি প্রিয় দেশ। আর মাত্র একবার, একবারই সোভিয়েত রাশিয়া সফর করেন মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য (১৯৩০)।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব সফরের উদ্দেশ্য তাঁর চিন্তা-ভাবনার জগৎটার উন্মোচন, কিছু আদর্শিক ভাষণ, স্থানীয় মননশীল বা মনীষীদের সঙ্গে ভাববিনিময়। তবে জাপানসহ মার্কিন অঙ্গরাজ্যগুলোতে মূল কথা—জাতীয়তাবাদী-সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ভূমিকার সমালোচনা। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ছোট্ট আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য—তাঁর বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ।
চিন্তায়-বিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদী বিশ্বপ্রেমী; ‘মানুষ’ শব্দটি তাঁর কাছে সর্বাধিক তাৎপর্যময় আনন্দ ও মঙ্গলের হিসাব-নিকাশে। সেই মানুষের কল্যাণ তাঁর কাছে সর্বাধিক কাম্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দেশ-নির্বিশেষে। এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাত নেই, এমনকি স্বদেশ বিচারেও। উগ্রতা বা সংকীর্ণতা—কোনোটাই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রতিটি সফরে সাধারণ সূত্র হিসেবে মানবকল্যাণ চিন্তা ছাড়াও মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর তৃতীয় বিশ্বসফরে ইংল্যান্ড যাত্রার একটি মূল বক্তব্য ছিল পূর্ব-পশ্চিম অর্থাৎ প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলন; মূলত সাংস্কৃতিক ধারায়।
ইংরেজ কবির বহু উদ্ধৃত পঙিক্ত ‘প্রাচ্য প্রাচ্যই, তেমনি প্রতীচ্য প্রতীচ্যই, এ দুইয়ের মিলন কখনো সম্ভব নয়’—রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করে সাংস্কৃতিক ও মানবিক মিলনের বাণী জোরালো ভাষায় প্রচার করে গেছেন। সামান্যসংখ্যক ব্যক্তি এ তত্ত্বেও সায় দিয়েছে, বেশির ভাগই এর বিরোধী, জাত্যভিমান, শ্রেষ্ঠত্ববোধ সেখানে প্রচণ্ড গরিমা বহন করেছে। কিন্তু হতাশ হননি রবীন্দ্রনাথ।
সময়টা ছিল ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বের, মানবীয়-ভক্তিবাদী চেতনার। কিন্তু এ ধারাবাহিকতা কখনো ব্যাহত হয়নি। আর মার্কিন বর্ণবাদী পাপ, নিগ্রো লিঞ্চিংয়ের বিরুদ্ধে তাঁর তির্যক সমালোচনা তো অনেক আগেকার। একজন নিগ্রোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নর-নারী কিভাবে উপভোগ করে সে ভয়াবহ ঘটনার উল্লেখও করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায়।
দুই.
শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় ও সমাজে এক মস্ত অভিশাপ, রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় পাপ। কেকেকের মতো সংগঠনের কল্যাণে আধুনিক মার্কিন চেতনায়ও এর পরিপূর্ণ অবসান ঘটেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার প্রমাণ। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ উসকে দিয়ে নির্বাচনে তাঁর বিজয়!
তার চেয়েও বড় কথা, আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রী আমেরিকার পুলিশি রাজ্যে বর্ণবাদ এমনই কায়েম, কায়েম বিচারব্যবস্থায় যে থেকে থেকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নিগ্রহে কৃষাঙ্গ হত্যা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। ঘাতক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের কখনো শাস্তি হয় না বিচারে। সম্প্রতি কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড হত্যা তাঁর বহু উদাহরণের একটি।
তাঁর মৃত্যুপূর্ব শেষ কথাগুলো ছিল বড় মর্মস্পর্শী, বড় করুণ। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটু তাঁর গলায় চেপে বসেছে। এর মধ্যেই তাঁর শেষ কথা : ‘আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমি মারা যাচ্ছি, সন্তানদের বলো, আমি তাদের ভালোবাসি। ’ রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘ভালোবাসা’ শব্দটি উচ্চারণ করে তাঁর মৃত্যু।
ব্যস, এবার সারা যুক্তরাষ্ট্রে মানবিক চেতনার মানুষের প্রবল বিস্ফোরক বিক্ষোভ, সহিংসতা, ভাঙচুর, দাসপ্রথার প্রতীক মূর্তিগুলোর ভাঙচুর। বিক্ষোভ সমুদ্র পেরিয়ে ইউরোপে, বিশেষত ব্রিটেনে। চার্চিলসহ একাধিক মূর্তির একই দশা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রকট না হলেও বর্ণবাদী চেতনা ইউরোপীয় সুসভ্য জাতি তথা নাগরিকদের মধ্যে যথেষ্ট প্রচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কী বলতেন, প্রতিবাদ করতেন না নাকি?
দীর্ঘ বিক্ষোভের পর বিরতি শেষে আবার দৈনিকে খবর—বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্র উত্তাল। রবীন্দ্র প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ এ কারণে যে রবীন্দ্রনাথ এই বর্ণবাদী পাপের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার ছিলেন। যেমন সোচ্চার ছিলেন পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্রের যুদ্ধবাদী চেতনা ও প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
রবীন্দ্রনাথ বরাবরই শান্তির পতাকাবাহী। বিশ্বের শান্তিবাদী মনীষী রোমাঁ রোলাঁ, রাসেল, আইনস্টাইন প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ছিল যোগাযোগ, বিশেষভাবে রোমাঁ রোলাঁর সঙ্গে। তিনি যেমন মানবধর্মের মনুষ্যত্বে বিশ্বাসী তেমনি চিন্তার স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিরোধী।
তিন.
আর তারই প্রমাণ মিলেছে যখন একাধিক আমন্ত্রণের পর ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত রাশিয়া সফরে যান। সব কিছু দেখে তাঁর মতামত লেখেন চিঠিতে এবং বিদায়ের প্রাক্কালে সংবাদপত্র ইজভেস্তিয়ায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেখানকার সমাজ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈষম্যের বিলোপ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশংসার পর বেশ কিছু প্রশ্নও উত্থাপন করেন সেখানকার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে, কিছু পরামর্শ দেন সেসব বিষয়ে।
সেখানকার সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে কদিনে যতটুকু দেখেছেন তাতেই অভিভূত হয়ে লিখেছেন তাদের ‘ধনগরিমার ইতরতার অবসান’ ঘটানোর কথা, কৃষি খাতে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন, যৌথ খামারের সমবায়ী ব্যবস্থার প্রবর্তন নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ, বিশেষ করে একদা নিরক্ষর চাষি ও সৈনিকদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চায় অভূতপূর্ব উন্নতি নিয়ে অনুরূপ বিস্ময়, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আধুনিকতার সর্বজনীন রূপ ইত্যাদি।
কিন্তু প্রশ্ন একনায়কি শাসন নিয়ে, চিন্তার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মতপার্থক্যবিষয়ক অসহিষ্ণুতা নিয়ে। তাঁর মতে, তাদের মহান আদর্শ যেহেতু আন্তর্জাতিক, বৈশ্বিক চরিত্রের, কাজেই তা সর্বজনীন সহিষ্ণুতা ও সবার অংশগ্রহণে সফল হতে পারে।
সেখানে দরকার ‘ভালোবাসা ও সহৃদয়তা’র আচরণ, যা দিয়ে মানুষের চিত্ত জয় করা সম্ভব। অর্থাৎ সেই পূর্বকথিত রাবীন্দ্রিক মানবতাবাদ। তা না হলে বিশ্ব হিংসা-প্রতিহিংসায় খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। তাঁর শেষ কথা, এ বিষয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
তাঁর মতে, ছকে ধরাবাঁধা সুনির্দিষ্ট ‘ছাঁচে বাঁধা মনুষ্যত্ব’ এবং সেভাবে মানুষ গড়ার চেষ্টা টেকে না, তা একসময় ব্যর্থ হতে বাধ্য।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুস্থ জীবদ্দশায় বিশ্বসফরে উন্নত দেশগুলোতে এভাবে তাঁর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও জীবনদর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন শিক্ষিত শ্রেণিতে, মনীষী মহলে। এর মধ্যে অধ্যাত্মবাদও স্থান পেয়েছে, যা অবশ্য প্রগতিশীল আধুনিক চেতনায় প্রশ্নের অবকাশ তৈরি করে। কিন্তু তাঁর মানবতাবাদ, মানবধর্ম, বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণের মূল্যবোধগুলো নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব। মৃত্যু তাই তাঁকে জয় করতে পারেনি। তিনি এখনো এ কালকে ধারণ করে আছেন তাঁর মানবিক চিন্তায়।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী