শাহজাহান চৌধুরী ||
আমি, বাবুল ইসলাম, দীপ্র আজাদ কাজল ধুমায়িত চাসহ আড্ডা মারছিলাম কবি বিজনের লন্ড্রি নিবাসে। বিজনের ব্যাপারটাই আলাদা, তার দোকানে শুধু কাপড় ইস্ত্রি হয়, ধোলাই বাদ। কারণ জিজ্ঞেস করলে কবিতার মত করে বিজন বলবে ‘ব্যাংক এণ্ড ট্যাংকের শহর কুমিলা থেকে ট্যাংক উধাও হয়ে গেছে, তাই সেই কষ্টে ধোলাই ছেড়ে দিয়েছি।’
আড্ডার মুহূর্তে ইন করল গাজী মোহাম্মদ ইউনুস। ‘বিজন সিগ্রেটটা দে’। স্টিলের মোড়াটার উপর বসে পড়ল গাজী। ঘ্যাটেস ঠং করে ইস্ত্রিটা রেখে বিজন গোল্ড লিফ কোম্পানির মার্কা থেকে দুই সুতা লম্বা সাদা ছড়িটা গাজীর হাতে হস্তান্তর করে। সাহেবি ঢংয়ে সিগ্রেটটায় টান দেয় গাজী। অধুনালুপ্ত লোকোমোটিভ ইঞ্জিনের উদ্গিরণ করা ধোঁয়ার মত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যা গিয়ে লাগে বাবুল ইসলামের চোখে।
ধোঁয়া থেকে ট্যারা করে চোখ বাঁচিয়ে ড্রেনের ভাঙ্গা দুই স্লেভে পা রেখে খাইবার মেলের নিলুর মতো দুই পা দু’দিকে দিয়ে বাবুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে গাজী কি অইছে, মন খারাপ কিলাইগা, বাসায় কারো অসুখ বিসুখ নি?’
বুকের ভেতর ধরে রাখা বাতাসের সাথে গাজীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, কবি শামসুর রাহমান আর বাঁচবে না রে! পেছন থেকে শুভ্র’র ছুটে আসা চিৎকার ‘বাবুল ভাই শামসুর রাহমান আর নাই’। ঠাস্ করে একটা আওয়াজ, বিজনের ইস্ত্রিটা ভাতের বাসনের উপর রাখার আওয়াজ। স্টিলের মোড়া থেকে পড়তে পড়তে গাজীর উঠে দাঁড়ানো, বাবুলের দুই পা একই ¯েবে চলে আসা, চেয়ারের উপর আমার দাঁড়িয়ে যাওয়া, সবগুলো ঘটনার ফাঁকে সবার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘কখন’? দীপ্র আজাদ কাজল বলে, বাবুল ভাই, ‘কবিতার জগতে আমরা এতিম হয়ে গেলাম’।
একজন কবির জন্য এতো ভালোবাসা ! আসলে কবি না হলে কবির দরদ বোঝা যায় না।
কবি শামসুর রাহমানকে চিনি আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মধ্য দিয়ে। সে কী উম্মাদনা, সে কী লেখাÑ
‘স্বাধীনতা তুমি অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে
মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক
স্বাধীনতা তুমি বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শাণিত কথার ঝলসানি লাগা সতেজ ভাষণ
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদাস জমিন
স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুকনো শাড়ির কাঁপন
স্বাধীনতা তুমি গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল
হাওয়ায় হাওয়ায় বন উদ্যম ...’
আহ! কোথা পাবো তারে এখন। ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, অথবা ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি গোলাপ নেব’। এরপর কবির সঙ্গে আমার পরিচয় কুমিলার এক অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে কবিকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
আশির দশকে মরহুম সৈয়দ আমিনুর রহমান তখন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক। ফখরুল ইসলাম রচি ‘কথকথা’ নামক তার সংগঠনসহ ঢাকার অনেক কবিকে কুমিলায় নিমন্ত্রণ করে। তাদেরকে কুমিলা টাউন হলের বাইরে মঞ্চ তৈরি করে সম্মান প্রদান করা হয়। তখন কবিতা পাঠের আসরও হয়। মনে পড়ে, অনুষ্ঠানের দিনই দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয় এবং গোয়েন্দা সূত্রগুলো অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য জেলা প্রশাসক এবং এসপি’কে আদেশ দিতে বলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক মরহুম সৈয়দ আমিনুর রহমান তা হতে দেননি। তিনি গোয়েন্দাদের এই বলে বোঝান যে এ মুহূর্তে অনুষ্ঠান বন্ধ করলে শহরের আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। জেলা প্রশাসক স্বয়ং কুমিলা ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে কবিদের কবিতা আবৃত্তি শোনেন। যদিও তিনি অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন যেহেতু জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়েছে তাই তিনি অনুষ্ঠান স্থানে যাওয়া পরিহার করেন।
বাংলা একাডেমি বই মেলা শুরু হওয়ার পর থেকে বই মেলায় যাওয়া আমার নেশায় পরিণত হয়। তখন রচি, রেজা সেলিম, মোমিন শাহগীর প্রমুখ কুমিলার কবিরা ঢাকায় থাকত। ওদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা হত রাগিব আহসান (রাগিব ভাইয়ের ) শাহবাগের রেখায়নে। সে সময় রেখায়নে কবি শামসুর রাহমানও মাঝে মাঝে আসতেন। কবি আসাদ চৌধুরী, কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি নির্মুলেন্দু গুণ, কবি মহাদেব সাহাও রেখায়নে ঢুঁ মারতেন। বই মেলার লেখক চত্বরে বড় ছোট সব কবিরাই আড্ডা জমাতেন আর ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতেন। সৈয়দ শামছুল হক, প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ, সদ্যপ্রয়াত শামসুর রাহমান এর মত কবি সাহিত্যিকরাও সেখানে আসতেন। জমপেশ আড্ডা হতো। রুদ্্র মোহাম্মদ শহীদুলাহ তখন আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখে নামকরা কবি।
এক বই মেলায় রচি একটি সুন্দর ম্যাগাজিন বের করেছিল। কার সম্পাদনায় মনে নেই। কুমিল্লার কবি এবং পরিচিত তরুণ কবিদের নিয়ে আমরা একটা একুশের সংকলন বের করেছিলাম। কুমিলার কবিদের মধ্যে ছিল ইসহাক সিদ্দিকী, ফখরুল ইসলাম রচি, বাবুল ইসলাম, রেজা সেলিম, মমিন সাহগীর, মনসুর হেলাল, প্রবীর বিকাশ সরকার প্রমুখ। আর তাদের বন্ধুরা একুশ জনের একুশটি কবিতা নিয়ে বেরিয়ে ছিলো পকেট মারা প্যাকেট। একুশ টুকরো একটি প্যাকেট।
সংকলনে একজন ইংরেজ কবি বন্ধু টভেন ইয়ং এর একটি কবিতাও ছিল। কবিদের আড্ডায় দেখতাম শামসুর রাহমান আসলে আসর বেশ জমে উঠত। শ্রদ্ধা এবং বন্ধুত্ব দুটোর সংমিশ্রণে বই মেলার আমেজটা অন্যরকম হয়ে যেতো।
কবি লেখকদের কাছাকাছি হওয়ার একটা সুবিধা আমার ছিল। একেই তো নাটক করতাম তার উপরে আলোকচিত্রী হিসেবে সব আড্ডাতেই আমি ছবি তুলতাম আর পরের আড্ডায় তা কবি লেখকদের দিয়ে দিতাম। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার এ দু’দিন আমার বিচরণ ছিল বইমেলায়। তবে মেলার শেষ দিকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে চলে যেতাম ঢাকায়। বই মেলায় আমার সব’চে বড় প্রাপ্তি মরহুম শওকত ওসমানের স্নেহ পাওয়া। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ’৯৪ এর বই মেলায় তার ‘জয় বাংলার জয়’ বইটিতে লিখে ছিলেন, ‘শাহজাহান চৌধুরী, কল্যাণীয়েষু’। ময়নামতির রাজা সন্ন্যাসী গোপী চাঁদের আজও আমি প্রত্যাশী। শওকত ওসমান ১২/২/৯৪ খ্রি.।
ঢাকা বদলীর পর পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় যাদুঘর কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলোয় আমি উপস্থিত থাকতাম।
একবার শওকত ওসমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কুমিল্লার সাবেক এসপি মালিক খসরুর সঙ্গে দেখা। কবি শামসুর রাহমান সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। উপস্থাপক ছিলেন আমাদের কুমিল্লার ছেলে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার আবুল কালাম আজাদ (আবুল আজাদ)। অনুষ্ঠান শেষে মালিক খসরু কবিকে তার শ্যামলীর বাসায় পৌঁছে দেন। আমি, মালিক খসরু, কবির বাসায় গেলাম। কবি আমাকে নামেও চিনতেন কুমিলার শাহজাহান হিসেবে। ১৯৯৯ সালে চারিদিকে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে তখন কবিকে সামনে রেখে আমরা মৌলবাদ বিরোধী অনেক কর্মকাণ্ড করেছি। কবি শেষবারের মত ক’বছর আগে কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং কুমিল্লা শহীদ মিনারে বক্তব্য রেখেছিলেন।
এক সময় আমি দেশের সাড়া জাগানো ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র কনটিউবিউটার ছিলাম তখন তিনি আমাকে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট দিতেন। সে সময় তার স্বাক্ষরিত একটি পরিচয়পত্র তিনি আমাকে দেন। যার সিরিয়াল ছিল ১২ কবির সঙ্গে শেষ দেখা ‘আমাদের সময়’ পত্রিকা অফিসে। ‘আমাদের সময়’ কবিকে সংবর্ধনা দিয়েছিল এবং সেই অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন কবি আল মাহমুদ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের ক’দিন পর কবিকে ছবিগুলো দিয়ে আসি। এরপর কুমিল্লায় চলে আসি। কবির সাথে আর দেখা হয়নি। কবি চলে গেলেন, গাজীর আবেগ, বাবুল ইসলাম, বিজন, দীপ্র আজাদ কাজল আর শুভ্র’র কণ্ঠের আর্দ্রতায় বোঝা যায় কবি কতটুকু প্রভাবিত করতে পারতেন অনুজ কবিদের। তার মৃত্যুতে দেশের কাব্য জগতের যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা কতোদিনে কাটিয়ে উঠব তা আমরা জানি না। শুধু জানি, ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ আমরা হৃদয়ে ধারণ করে রাখবো।
লেখক: অভিনেতা ও আলোকচিত্রী নাট্যসংগঠক