আলমগীর হোসেন,দাউদকান্দি ।।
কুমিল্লার
কৃতী সন্তান, কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার, রচয়িতা, চলচ্চিত্র পরিচালক,
প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি
রাজিউন। রবিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর নিজ বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে
পড়েন তিনি। পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শেষ
নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
গাজী
মাজহারুল আনোয়ারের পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মালীগাওঁ
ইউনিয়নের তালের ছেও গ্রামে। এই কিংবদন্তির মৃত্যুতে কুমিল্লাসহ দেশবিদেশের
সাংস্কৃতিক অঙ্গণ, বন্ধু -বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের মাঝে
শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার পারিবারিক লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে,
দেশ-বিদেশে থাকা স্বজনদের সাথে আলোচনা করে জানাজা ও দাফনকাজ সম্পন্ন করা
হবে। এর আগে মরহুমের লাশ হিমঘরে রাখা হবে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়,
‘অসুস্থ অবস্থায় রবিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে গাজী মাজহারুল আনোয়ার কে
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক দেখে বলেন তার পালস
পাওয়া যাচ্ছে না। এর কিছুক্ষণ পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ গাজী
মাজহারুল আনোয়ার স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণাগ্রাহী
রেখে গেছেন। তার মেয়ে দিঠি আনোয়ার একজন কণ্ঠশিল্পী। বর্তমানে দেশের বাইরে
আছেন তিনি। তিনি দেশে ফিরলে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের দাফন সম্পন্ন হবে বলে
জানা গেছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা
জেলার দাউদকান্দি উপজেলার তালের ছেও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে
তিনি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন।
সুভাষ দত্তের ‘আয়না
ও অবশিষ্ট’ চলচ্চিত্রে ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি দিয়ে
চলচ্চিত্রের গান লেখা শুরু করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তার রচিত গানের
সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম,
বিরহ, স্নেহ, অনুভূতির কথা উঠে এসেছে তার গানে।
বিবিসির জরিপে
সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে তিনটি গানের রচয়িতা গুণী এই গীতিকবি।
গানগুলো হচ্ছে- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার
বল’ ও ‘একবার যেতে দে না’।
তিনি একজন সফল কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও
পরিচালক। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দেশ চিত্রকথা থেকে ‘শাস্তি’, ‘স্বাধীন’,
‘শর্ত’, ‘সমর’, ‘শ্রদ্ধা’, ‘ক্ষুধা’, ‘স্নেহ’, ‘তপস্যা’, ‘উল্কা’,
‘আম্মা’, ‘পরাধীন’, ‘আর্তনাদ’, ‘পাষাণের প্রেম’, ‘এই যে দুনিয়া’ নামের
চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার গীতিকার
হিসেবে ৫ বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয়
সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক ২০২১ ও একুশে পদক ২০০২ প্রাপ্ত, ১৯৭২
সালে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক, এস এম সুলতান স্মৃতি পদক, একাধিকবার বাচসাস ও
বাসাপ পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন এই কিংবদন্তী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
তিনি বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদের উপদেষ্টা ছিলেন।
তার লেখা কিছু কালজয়ী
গান হলো-‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার
ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না
আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে
একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শীষ
দিয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘চলে আমার সাইকেল
হাওয়ার বেগে’ প্রভৃতি।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে গাজী
মাজহারুল আনোয়ারের ছেলে সরফরাজ আনোয়ার উপল সাংবাদিকদের জানান, আগামীকাল
সোমবার বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। তিনি আরও
জানান, সোমবার বেলা ১১টায় প্রথমে প্রখ্যাত এই গীতিকারের মরদেহ শ্রদ্ধা
নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। তারপর নেওয়া হবে বাংলাদেশ
চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। সেখানে তার প্রথম নামাজে জানাজা
অনুষ্ঠিত হবে।