ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
পথহারা জাতির কথা
Published : Tuesday, 20 September, 2022 at 12:00 AM
পথহারা জাতির কথাশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
১৯৬৯খ্রি: গণঅভ্যুত্থানের প্রবল প্রতিরোধ ও উত্তাপে আইয়ূব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল আসামিকে মুক্তি দেয় ২২ ফেব্রুয়ারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম কমিটি শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা জানায় এবং কমিটির আহবায়ক ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমদ জনসমুদ্রে নেতার নতুন নামকরণ করেন- ‘বঙ্গবন্ধু’। তখন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ নামেই পরিচিত বিশ্ববাসীর কাছে। যেহেতু ‘বঙ্গের বন্ধু’ তাই তো জাতিসত্তা একটি পরিচিতিতে স্থির হয়ে যায় ‘বাঙালি’ শিরোনামে। তখন থেকে আমাদের আর অন্য কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব রইল না। ১৯৭০ খ্রি: এই সামষ্টিক শক্তির মহান বিজয় হলো নির্বাচনে, অর্থাৎ বাঙালি জয়লাভ করল নিরঙ্কুশভাবে। এই জয়কে প্রতিষ্ঠিত ১৯৭১ খ্রি: নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছিল। ৩০ লক্ষ বাঙালি শহিদ হলো, তিনলক্ষ মা-বোন ইজ্জত হারালো। সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হলো। বঙ্গবন্ধু এই নয়মাস পাকিস্তানের কারান্তরালে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে অতিবাহিত করলেন। অবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ খ্রি: মুক্তমানুষ মহামানব মর্যাদায় স্বদেশে স্বভূমিতে স্বজনের কাছে এসে পৌঁছালেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেলাম, তাঁকে জাতির পিতা আসনে অধিষ্ঠিত করলে বাঙালি। এ এক অভাবিত পরিক্রমা।
এখন প্রশ্ন- বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার না হতেন। অন্য নেতাদের মতো পালিয়ে ভারতে চলে যেতেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতো, তবে কি নয়মাসের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হতো ? যুদ্ধ কি দীর্ঘস্থায়ী হতো না ? দেশের অভ্যন্তরে লোকক্ষয় কি কম হতো ? ভারত সরকারের সঙ্গে বুঝাপড়া কিরূপ হতো ? স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে পূর্বের ন্যায় মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশনায়কের মতো যেসব অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের জন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তা কি সম্ভব হতো ? চক্ষুলজ্জা বলি, কৃতজ্ঞতা বলি, দায়বদ্ধতা বলি, অসমশক্তির কাছে সাহায্য বলি- পরবর্তী নেতৃত্বে কি কিছু ঘাটতি পড়ত না ? জানি, এ আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক, তারপরও বলছি এজন্য যে আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও ভারতের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন বাংলাদেশের কোনো কোনো সরকার নানা করণেই নমনীয় হয়েই দেশ পরিচালনা করতে হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের তো দোষের অন্ত নেই। তারা ভারত-ঘেঁষা, ভারত-প্রেমিক, ভারত সরকার-নির্ভর ইত্যাদি। তবে একথা তো ঠিক যে, অন্তত বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় ভারত কোনো হস্তক্ষেপ করতে সাহস পায় না, পরামর্শও দেয় না, স্বাধীনভাবে চলার ক্ষেত্রে দাদাগিরি করার ভূমিকাও যাপন করে না। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ- বাংলাদেশের উন্নয়নশীলতার পরিক্রমায় যে কারিশমা, তা থেকে ভারত শিক্ষা নিচ্ছে, অনুকরণ করছে। একটি জায়গায় পরিবর্তনশীল ভারত সরকার ভাবনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে উঠছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সমকালে যেসব ঘটনা ঘটছে ক্রমান্বয়ে এবং ধর্মীয় জাতি- গোষ্ঠির উত্থানে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে, এক্ষেত্রে বর্তমান ভারত সরকারও ধর্মীয় জাতিসত্তার উত্থানে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশ্বের কিছু দেশ ধর্মীয় জাতিসত্তায় গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে অস্থির করে তুলেছে, তার উত্তাপ যেন ভারতেও পেয়ে বসেছে। এটা অবশ্যই ভাববার বিষয়।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সাজিয়ে তুলেছিলেন নতুন আঙ্গিকে ও আদর্শে। তিনি ১৯৭২খ্রি: সংবিধান প্রণয়ন করলেন। দেশকে চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়া করালেন নতুন সংজ্ঞায়।
১. গণতন্ত্রের সংজ্ঞা তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেভাবে উল্লেখ আছে, বঙ্গবন্ধু সে তত্ত্বে গেলেন না, তিনি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিলেন- ‘প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ’, কাজেই এর চেয়ে স্বচ্ছ সংজ্ঞা কী হতে পারে। এই মালিকেরাই দেশ পরিচালনা করবে।
২. সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা তিনি বিদেশ থেকে আমদানি করলেন না। তিনি বললেন, দেশ হবে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে’ দীক্ষিত। তিনি সমাজতান্ত্রিক দেশের জনগণের অধিকার বিষয়ে উপলব্ধি করলেন, সেখানে প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। তাত্ত্বিক গ্যাঁড়াকলে নিষ্প্রাণ জীবন যাপন করতে হয়, মানুষের যে মৌলিক সৃজনশীলতা আছে, তাকে বিকশিত করার সুযোগ নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের জনগণকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন- তাঁর দেশের প্রতিটি মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, যেমনটি তিনি যাপন করতেন, বিশ্বাস করতেন অকৃত্রিমভাবে।
৩. বাংলাদেশে তো একটিই জাতি-বাঙালি। পাবর্ত্য জনগোষ্ঠী যখন নিজেদের স্বাতন্ত্রিক অবস্থানের কথা বলতে চাইল, তিনি বললেন- ‘তোরা বাঙালি হয়ে যা’। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি আমরা বাঙালি সত্তার কথা ভুলে যাই, তখন আমাদের অপমৃত্যু হবে। বাংলাদেশ তো বাঙালিদের স্বর্গরাজ্য। তিনি বলেছেন- ‘আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাবো।... এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ তোমাদের মনে রাখতে হবে।’
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয় তা মূর্খরা বুঝে না, বুঝে নাই, বুঝতে চাইবে না। কারণ, তারা ধর্মান্ধ।
আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এই চারটি স্তম্ভই ভেঙ্গে গেছে। জনগণ আর দেশটির মালিক নয়। জনগণ যাদের নির্বাচিত করে দেয় নির্ধারিত সময়ের জন্য দেশ পরিচালনা করতে, তারাই তখন মালিক বনে যায়। এবং এভাবে মালিক থাকার জন্য এখন গণতন্ত্রের মৌলিক উৎসকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ মালিকগণ আর জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করে না, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, ক্ষমতায় আরোহণ করার জন্য চোরাগলিতে হেঁটে চলেছে। বাহিনী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র অনেক আগেই কবরস্থ হয়ে গেছে। এখন শুধু কবর জিয়ারত চন্দ্রিমায়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য নেই, জীবনমানের সমতা নেই, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি-বিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠায়, ১৯৭৫খ্রি: ১৫ আগস্ট থেকে হয়ে যায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭৫খ্রি: পর থেকে হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভাসছে। এবং একটি ধর্মীয় বিশ্বাসী লোকেরাই প্রাধান্য বিস্তার করে দেশকে যেমন অপরিচিত করে তুলেছে, নিজেরা হয়ে গেছে ধর্মান্ধ। বাংলাদেশে এখন বাঙালি জাতিসত্তা বলে কিছু নেই। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা এখন একটি অচল আধুলি। বাজারে তার প্রচলন নেই।
কাজেই যে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে, বাঙালিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠাতা দিতে বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, আজ তাঁর বাংলাদেশে তিনি নেই। যে দেশে নেতার আদর্শ উপেক্ষিত, তাঁকে খুঁজে পাবো কই ?
আমি জানি ও দেখেছি- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে শিরোধার্য করেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন ভারত সরকার ছিল অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি। ১৯৭৫খ্রি: পর ১৯৯৬খ্রি: পর্যন্ত অর্থাৎ ২১ বছর আমরা ছিলাম নামহীন পাকিস্তানের শাসনে। ১৯৯৬খ্রি: থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ২০০১ খ্রি: আবার পাকিস্তানি মনোভাবান্ন শক্তি চক্রান্ত করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। ২০০-২০০৬খ্রি: হলো বাংলাদেশের জন্য কালো অধ্যায়, ২০০৮খ্রি: থেকে আবার আওয়ামী লীগ সরকার অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সরকার। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের মধ্যে মনোগত পরিবর্তন ঘটে যায়। বর্তমানে ১৪ বছর আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায়। অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, নিজের ভাগ্য নির্মাণে এতটা সফলতা অর্জন করেছেন, তা মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগার বলতে যা বুঝায় এ সংখ্যাটা এতটাই হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের কথা বললেই তথাকথিত আওয়ামী লীগার নয়, আওয়ামী লীগ রাজনীতি যারা করেন, তারা আতংকে শিহরিত হতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে তাদের বিকল্প ঠিকানা এখন কানাডা-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-মালয়েশিয়া- হেথা নয় অন্য কোথা। এসব এখন পুরানো কথা। হিন্দুরা নির্যাতনের ভয়ে ভারতবাসী, তথাকথিত আওয়ামী রাজনৈতিকরা প্রাণের ভয়ে হবে দেশ ছাড়া।
আমার ভয় অন্যত্র। মূল্যায়নে অনেকেই একমত হবেন না, তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে দেশ পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। আমাদের বার বার মনে রাখতে হবে-
১. একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
২. বাঙালিরা এবারই প্রথম স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিতি লাভ করেছে।
৩. এই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৪. বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তাকে চেতনায় ধারণ করে। পাকিস্তানি ধর্মীয় মূল্যবোধকে মুছে ফেলা হয়েছে।
৫. আমরা স্লোগান দিয়েছি- ‘এক নেতা এক দেশঃ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা: পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘এক  জাতি এক দেশ ঃ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, ইত্যাদি।
সুতরাং নীতি-আদর্শের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনই একটি দেশের ভিত্তি। বাংলাদেশ এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২খ্রি: ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে ভঙ্গুর দেশের হাল ধরলেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫খ্রি: হত্যা করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- পৃথিবীর অনেক বরেণ্য স্বাধীনতাকামী বা অর্জনকারী জাতীয় নেতা ও পিতাকে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয়েছে। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, চিলির আলেন্দ, আমেরিকার জন, এফ কেনেডি, লুথারকিংক, মিশরের আনোয়ার সাদাত, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং অনেক বরণীয়-স¥রণীয় রাষ্ট্রনেতাকে। এ কাতারে বঙ্গবন্ধুকে আমি সামিল করতে চাই না।
আমার প্রশ্ন-বাংলাদেশের এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যদেশের রাষ্ট্রনায়কদের অপসারণের মতো তো নয়। এখানে এককভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, তাঁকে নির্বংশ করার সর্বোচ্চ প্রয়াস চালিয়েছে ঘাতক ও তাদের দোসর আন্তর্জাতিক চক্র। তারা জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করেছে, রাতের অন্ধকারে স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রগণ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে এবং এ ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় শেখ হাসিনাকে ২০০৪খ্রি: ২১ আগস্ট হত্যা করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়। কোটলিপাড়ায় হত্যার উদ্দেশ্যে শক্তিশালী বোমা স্থাপন করে রাখে। এ প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৪ বছর যাবত এককভাবে ক্ষমতায় রয়েছে। এরই মধ্যে দলে ঢুকে পড়েছে অনুপ্রেবেশকারী তারা। দৃশ্যত আওয়ামী রাজনীতি করে কিন্তু আওয়ামী লীগার নয়- একথা স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায়। তারা প্রশাসনের উচ্চমহলে খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তা ধারণা করা যায়। এক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ বিএনপি বা জাতীয় পার্টি অথবা বামদলগুলোকে কীভাবে বিবেচনায় ধারণ করছেন, তা জাািন না। তবে এতটুকু বুঝতে পারি- তারা ক্ষমতা দখল করতে চায়, ক্ষমতার অংশীদারত্বের ভাগ চায়। এজন্য গণতন্ত্রের কথা বিশ্বাস-অবিশ্বাস দ্বন্দ্বে উচ্চারণ করে থাকেন। কাজেই তাদের দ্বারা দেশের শাসন-ক্ষমতা পরিবর্তনের একটা ন্যূনতম ধারাবাহিকতা উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু প্রধান শত্রু যারা তাদেরকে আমরা কিন্তু আমলে নিতে চাচ্ছি না। এখানেই ভয়-মহাভয়। সেই বণচোরাদের মুখের বুলির সঙ্গে অন্তর্গত যাপিত বিশ্বাসের কোনো মিল নেই।
কিছুকথা সাহস করেই বলতে হয়। বিগত ১৪ বছরে যারা আওয়ামী রাজনীতি করছেন, মূলত আওয়ামী লীগার নন, তারা অনেক বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে গেছেন। তাদের পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে থাকেন না, কারণ, ভবিষ্যতের যেকোনো ঘটনা উদ্ভব হলে নিজেরা অসহায় হয়ে পড়বেন। এবং এজন্য তাদের ধনসম্পত্তি দেশের মধ্যে রাখা নিরাপদ মনে করেন না বলেই বিদেশের ব্যাংকে জমা করে রেখেছেন। তাদের দেশে দৃশ্যত তেমন ধনসম্পত্তি নেই, শুধু রাজনীতি করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমানে যে উন্নয়ন ধারায় ধনসম্পত্তির পাহাড় দেখতে পাই, যা সরকার নিজের অর্জিত সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছে তাদের ব্যক্তিমালিকানা কারা একটু খোঁজ নিলেই স্পষ্ট ধরা পড়বে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-ব্যাংক-বীমা-ভূমির মালিকানা কাদের কব্জায় আবদ্ধ হয়ে আছে ? তাদের ধনসম্পদ দেশের বাইরে কম। এজন্য ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা শক্তপোক্ত।
অন্যদিকে চাকরি ক্ষেত্রে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা নানা কৌশলে পুলিশ বাহিনীতে, প্রশাসনে, শিক্ষাবিভাগে ঢুকে গেছে। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাদের পথ পরিক্রমা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা অনেকক্ষেত্রে বিশ্বাসের জায়গায় পৌঁছে গেছে। জঙ্গীরা হয়ত সহায়ক শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান অনুঘটনার সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। মূল পরিকল্পনাকারীরা মূল বাতিঘরে নিরাপদে থেকে যাবে, যাচ্ছে। দৃশ্যমান শত্রু গুপ্ত মিত্র থেকে অনেকটা নিরাপদ। একটি গল্পবলি-
‘এক শকুনের বাচ্চা তার বাপের কাছে বায়না ধরলো, ‘বাবা, আমি মানুষের মাংস খাব, এনে দাও না প্লিজ।’ শকুন বললো, ‘ঠিক আছে বেটা, সন্ধ্যার সময় এনে দেব।’ সন্ধার সময় শকুনটা ছেলের জন্য শূকরের মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বললো, ‘বাবা, এটা তো শূকরের মাংস, আমি মানুষের মাংস খেতে চাই।’ বাপ বললো, ‘ঠিক আছে বেটা, এনে দেবো।’ এবার আসার সময় শকুনটা একটা মরা গরুর মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বললো, ‘আরে, এটা তো গরুর মাংস নিয়ে এসেছো, মানুষের মাংস কোথায় ?’ তখন শকুনটা উড়ে গিয়ে শূকরের মাংস একটা মসজিদের পাশে আর গরুর মাংস একটা মন্দিরের পাশে ফেলে দিয়ে চলে এলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েকশ মানুষের লাশ পড়ে গেল, আর বাপ বেটায় মিলে খুব তৃপ্তিতে মানুষের মাংস খেলো। বাচ্চাটা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা, এত মানুষের মাংস এখানে কী করে এলো ?’ শকুন বললো, ‘এই মানুষ জাতটাই এরকম। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বানিয়েছেন, কিন্তু ধর্মের নামে এদেরকে জানোয়ার থেকেও হিংস্র বানানো যেতে পারে।’ বাচ্চা বললো, ‘তোমার অনেক বুদ্ধি বাবা।’ শকুন বললো, ‘আরে ধুর, এটা তো আমি মানুষের কাছ থেকেই শিখেছি, এদের একটা অংশ যখনই কোনো অনিষ্ট করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়, তখনই সহজ রাস্তা হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে।’
বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রটি প্রায় এরূপই বলা যেতে পারে। এতে লাভ-ক্ষতি কাদের হচ্ছে, জানি না ? এতটুকু জানি একটি জাতি যখন অধ:পতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, তখন রাষ্ট্রক্ষমতাও ভোঁতা হয়ে যায়। তখনই বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে, বেশি করে মনে পড়ে।
বিজ্ঞান চায় প্রমাণ, দর্শন যাচাই করে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে, আর ধর্ম শুধুমাত্র বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যখন অন্ধ হয়ে যায়, তখন মানুষ, রাষ্ট্র সবকিছু অসহায় হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সেজন্যই ধর্মকে রেখেছিলেন মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কঠিন আভরণে, তাকে সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মিশতে দেননি। এজন্যই কি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে ? আজ কী দেখছি- যারা রাজনীতি করছেন, দেশশাসন করছেন, তাদের প্রাথমিকভাবে প্রমাণ দিতে হয়- তিনি বা তারা কতখানি ধার্মিক। এজন্য চলনে-বলনে-পোশাকে-আচরণে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। স্বীকার তো করতে হবে বাংলাদেশ গণপ্রজাতান্ত্রিক দেশ, তার শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য পবিত্র সংবিধান রয়েছে, বাংলাদেশ ধর্মতান্ত্রিক দেশ নয়। বঙ্গবন্ধু সে দেশ স্বাধীন করেননি। সংবিধানে প্রক্ষিপ্তভাবে ধর্মীয় শব্দ জুড়ে দিলেই তা মৌলিক চেতনাকে স্তব্ধ করা যায় না।
এজন্যই ভয়, বড় ভয়, বঙ্গবন্ধুর প্রজন্মের জন্য অহেতুক অজানা আতংক ও ভয়। বঙ্গবন্ধু যাদের ক্ষমা করেছেন, তারাই তাঁকে নির্বংশ করতে চেয়েছে ও সফলকামও হয়েছে, অন্তত বাংলাদেশ-বাঙালিজাতি-বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার যে মৌলচেতনা, তা অনেকটা বিতর্কিত করতে পেরেছে, যে বাংলাদেশে এখন বাস করছি আর চারপাশে যে সকল বাঙালিকে দেখছি-তাদেরকে তো চিনতে পারছি না। এ-ভাষা-এ পোশাক-এ আচরণ তো বাঙালির নয়। এখানেই ভয়, এখানেই আতংক, এখানেই সংশয়।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫