ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
পাঠকের প্রতিক্রিয়া
মোতালেব শাহ আইয়ূব’র কাব্যগ্রন্থ ‘একলা মানুষ’
Published : Thursday, 27 October, 2022 at 12:00 AM, Update: 27.10.2022 1:24:34 AM
মোতালেব শাহ আইয়ূব’র কাব্যগ্রন্থ ‘একলা মানুষ’আনোয়ারুল হক ||
মানুষের মধ্যে থেকেও কোন্ মানুষ একলা নয়?
সচেতন মানুষ জানে ‘মনের মানুষ’ থাকে মনে মনে । সে ধরা দেয়, সে ধরা দেয় না। দোলাচলের মধ্যে, তাই সে একা। টানাপোড়েন কোথায় নেই? রাষ্ট্রে, সমাজে, সংসারে, মানুষে মানুষে, মনে-মনে সবখানে যেখানে-সেখানে। দ্বন্দ্ব দানা বেঁধে আছে। নিজদেশে, দেশের বাইরে শান্তি কোথায়! সেক্ষেত্রে একলা মনে ডুব দিয়ে অতলান্তে একটু প্রশান্তি খোঁজার মানুষও আছে। তাদেরই একজন সুখপাঠ্য কবিতার কবি মোতালেব শাহ আইয়ূব। প্রতিষ্ঠিত এই কবির কবিতা আমি আগে কখনো পড়িনি। স্বীকার করি, এ আমারই অপারগতা। দেখতে পাচ্ছি, ইতোমধ্যে একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ “মুক্ত ডানার প্রজাপতি” সহ (২০০৬) তাঁর আরও সাতটি কাব্যগ্রন্থ ‘অচল আধুলি’ (১৯৯৭), ‘ঘরমুখো প্রজাপতি’ (১৯৯৯), ‘ভার্জিন ভোর’(২০০২), ‘দুঃখ আছে, কষ্ট নেই’ (২০০৪), ‘বৃষ্টির উৎসব’ (২০০৫) ও ‘কোথাকার আমি’ নামে প্রকাশ পেয়েছে।
মোতালেব শাহ’র ‘একলা মানুষ গ্রন্থের প্রথম পাঠে তাঁকে চিনে নিতে নিতে, আমার রসনায় কবির কবিতানুভব, ভাবনা-বিষয়ের পরিমিতি বোধ, শব্দ ব্যবহারে ভালোলাগা দানা বাঁধতে সময় নেয়নি খুব একটা। বুঝা যায় কবির জাত যা সচরাচর নয়। অবয়বে ছোট, বাহাত্তরটি কবিতার মনোলোভা বুননের সঙ্গে ছবির ভাষায় বর্ণনার মুন্সিয়ানাতে, ভাবের পরিধি ছোট, তথাপি মুক্তো দানার মতো কবিতার শব্দস্বর নানা রঙের ঔজ্বল্যে মন কেড়ে নেয়। একলা মানুষের জীবন, প্রবাসে আরও বেশি একলার অস্তিত্ব জুড়ে কবির কান্নার শব্দ নিঃশব্দ, যা শব্দের চেয়েও ততোধিক বাক্সময়, পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় মনে করি। যেমন, আমাকে ছুঁয়েছে।
চিরকালের কবি হয় সময়ের, সচেতন চিতের, হৃদয়-সংবেদী কবিতা প্রেমিকের। যেভাষায়, যেভঙ্গীতে, কবি কথা বলে, তাঁর সেই জীবনের রেখাচিত্র আর দশজনের চেয়ে আলাদা, সন্দেহ নেই। অন্যজীবন কবির জীবন । আমরা নিশ্চিত, এই জীবন কখনোই দোয়েলের, শালিকের নয়। এই জীবন মানুষের। যেমানুষ ঘুম ভেঙে চারপাশে দেখে গাঢ় হিম, মুখে কবরের মাটি লেগে আছে অথচ কতো আয়োজন চারপাশ জুড়ে মানুষের। জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানে কতটুকুই বা সময় (কবরের মাটি) এক একটি জীবনের! কাব্যের শুরুতেই থাকা না থাকার অস্তিত্বের এই অনুভব ভিন্ন ভিন্ন নামের কবিতায় আছে, সেই সঙ্গে আছে ব্যক্তি প্রেম, ধানী জমির উপরে জোছনায় লাল-সবুজের পতাকার একটি দেশ, বাংলাদেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার ছবি, এই দেশের মাটি ও মানুষের জন্য হাহাকার, প্রবাস জীবনে থেকে যা অনিবার্য বেদনার যাপিত জীবন, ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা রেখাচিত্র।
এরই ধারাবাহিকতায় মোতালেব শাহ আইয়ূব’র কবিতায় উঠে এসেছে তাঁর নিজ দেশের রাজনীতি সৃষ্ট বিপর্যয়, না কি নিয়তি! না কি অসহিষ্ণু সময়, যার পরিণতি কোন এক ‘শ্রাবণের ভোর মিটিং মিছিলে’র প্রান্তে লেগে থাকা ‘ঝুলন বাড়িতে কমরেড বাবুল দত্তের লাশ।’ যেকারণে ‘লোকজন, পথের গল্প’ তাই আর পথের গল্প থাকে না, তা হয়ে উঠে পথিকেরও। ফলে দেখা পাওয়া যাবে, এই শহরে মন খারাপ থাকে না কার। মনের ভাব মনে লুকিয়ে রেখে এক জীবন পার করে দেয় কত কত পথের মানুষ। বৃষ্টিহীনা শুকনো আকাশে মেঘের সেখানে ছিটেফোঁটাও নেই, এখানে দুঃখের রাতগুলি তাই দীর্ঘ হয়, যেমন আছে এই কবিতায়-
চারদিক সুনসান, মৃত্যুর জন্য শোক
মানুষ মরে না, বেঁচে আছে আশায়-
জুয়া খেলে জীবনের সাথে
রাত কত দীর্ঘ হয়!
আজ রাতে কে ঘুমাবে! (পৃষ্ঠা-১২)
পড়তে পড়তে এগিয়ে যাই। দেখি, একলা মানুষ’র পুঁতির দানার মতো কবিতাগুলো কবির আর একলা থাকে না। আমাদেরও হয়ে যায় যখন তাঁর কবিতার শরীরে জমে থাকা ভালোবাসা নুয়ে পড়ে মানুষের দিকে । কেননা, ‘কবির ফুসফুসে যে ভালবাসার বাস’ (বাঙালিয়ানা) তা তো তাঁর বাঙালিয়ানার জন্য! তারই কামড়ে একলা মনে কবির ‘কারো কথা জানতে ইচ্ছে হয়। জীবনবাদী কবি’র ‘ভালবাসার দিন আর রাত’ জুড়ে সেই ইচ্ছেটা তখন এরকম, কেউ একজন-
আমি কেমন আছি জানতে চায়
আমারও মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে
তিতলিকে মনে পড়ে
ঝুলন বাড়ির হলদে শাড়ি
সাকরাইনের সন্ধ্যা
ছাদে ছাদে মানুষ উৎসব মুখর
আমার দিকে হাত। (পৃষ্ঠা-১৪)
সেসময় অনিবার্য ভাবেই মনে পড়ে, ‘তার চলে যাওয়ার দিন’, ‘কালো কফির ধোঁয়া’য়’ মনের গভীর থেকে উঠে আসে নিঃসঙ্গ শহরে ততোধিক একাকী মন, না কি কবিতা-
মনে হয় জয়ার কাছে ফিরে যাই’। যে-
জয়ার কপালে মেরুণরঙের টিপ
গলায় জুঁই ফুলের মালা
পড়নে ঢাকাই শাড়ি। (পৃষ্ঠা-২০)
লক্ষ করি, কবিতা থেকে, নিত্যদিনের জীবন থেকে এমন কি ‘জয়া’র (মানসপ্রিয়া) মানস বৃত্ত থেকে এই কবির পালিয়ে যাবার উপায় নেই। আর সব কবিরই যেনো নিয়তির মতো তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একজন ‘নীরা’, ‘সুলতানা’ (হালিম আবদুল্লাহর ‘রঙওয়ালা’), একজন ‘লাবণ্য’ কিংবা আলোচ্য কবি মোতালেব শাহ আইয়ুবী’র ‘জয়া’। দেখা অদেখায় ‘জয়া’ আছে সবখানে,
এক.
বুকের মাঝখানে সেলাই
হারমোনিয়ামের রিডে জয়ার আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছে- (সাদা-কালো হয়ে, পৃষ্ঠা-২২)
দুই.
জয়ার সাদাকালো শাড়ির ভাঁজ
ইট-পাথরের শহরে আসে ফিরে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা । (স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, পৃষ্ঠা-২৩)
আরও একটি কবিতার নাম ‘জয়ার রোমান্টিক’। হিতে-বিপরীতে কবি, যে কি না ‘জয়ার ‘রোমান্টিক স্কুলের লোক’ তাঁর কবিতা ‘ঘরে শীতের রাত, বাইরে তৃষার ঝড়’ ঠেলে ‘জয়ার সঙ্গে পাশাপাশি’ (অন্ধকার) এগিয়ে যায়, অবশেষে জয়ার বুকে ঠাঁই নেয়,
শার্টের বোতাম খোলা
জয়া, তোমার বুকে ঠাঁই নেব অবশেষে
মৃত্তিকার আঁকা ধূসর চোখে জন্ম নিবে কবি
মাটির ভাষায় ফিসফিসিয়ে কথা বলবে। (পৃষ্ঠা-২৪)
আর এভাবেই স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে কবি বেড়ে ওঠে, এই শহরে। মানুষের জঙ্গলে, না কি অমানুষের! যেখানে লক্ষ কোটি চোখের সামনে, খোলা আকাশের নিচে একটি মৃত পা পড়ে থাকে, হারাম আর হালাল। এই দ্বিধাবিভক্ত জাতির ক্যানভাসে লেগে থাকে পোড়া জিনসে লাল রঙের ছিটেফোঁটা, কোথাও টয়লেটের কোণায় ছেঁড়া তারের গিটার’ সঙ্গীতবিহীন (সুর-তাল-লয়হীন) আমাদের বেতাল জীবন, তবুও, ‘জ্যোৎস্নার মতো এক জোড়া কবিতা’ লেখার প্রত্যাশায় কবির যৌবন নিবেদিত-বলছেন,
সুগন্ধ বাতাসে বেড়ে ওঠা যৌবন
ঘন হয়ে আসে ভালোবাসায়
জুঁইফুলের বিছানায় শুইয়ে দিই ‘জ্যোৎস্নার মতো এক জোড়া কবিতা ।’(পৃষ্ঠা-২৭)
বলেছি অন্যত্র, ‘একলা মানুষ’ কাব্যগ্রন্থের কবির জীবন দূর প্রবাসের। জন্মভূমি বাংলাদেশের সঙ্গে যার টান নাড়ির। ফলে প্রায় কবিতায় কী দয়িতার সঙ্গে, কী মা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে ভালোবাসা বিনিময়ে, সান্নিধ্যের আকূল আকাক্সক্ষায় কবির আত্মিক হাহাকার কবিতার পংক্তিতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। যেমন,
সিগন্যালের লাল-সবুজ-হলুদ বাতি
শেষ ট্রেনের জানালা থেকে প্রিয় কবি সরদার ফারুকের কবিতা নাচানাচি করে
টুকরো টুকরো কবিতা বুকের গহীনে
ভালোবাসা ঘুম ভেঙে ছুটে যায় প্রিয় বাংলাদেশে। (টুকরো টুকরো কবিতা, পৃষ্ঠা-৩১)
কবি মোতালেব শাহ রাজনীতি সচেতন। নিস্পৃহ বৃদ্ধিজীবীর মেরুদণ্ডহীন জীবন-যাপন, গণতন্ত্রহীন জন- জীবনের অসন্তোষ, অশান্তির আগুনের আঁচ তীব্র হলে যেমন দূর থেকে টের পাওয়া যায় তেমনি প্রবাসে অবস্থা করলেও কবির কবিতা নির্লিপ্ত থাকে না নিজদেশের এইসব নিত্য বিপর্যয়ের বিষয়ে। অসচেতন নয় কবি, তাঁর চোখে পড়ে জাল বাঙালিয়ানার চালচিত্র। ফলে দেশপ্রেমিক যৌবনের জয়ার ডাক পড়ে শেষের উৎসবে’, কেননা,
জনগণ অপেক্ষায় রুদ্ধশ্বাসে
এরপর কখন কোথায় হলুদ চোখ, ধূপকাঠি, গোলাপজল!
গরিব চায় সাদা ভাত আর শাক
স্বপ্নের প্রবেশ এরপর লাশ ঘর
আড়াই হাজার বছরে ফিরে যাব। (শেষের উৎসবে, পৃষ্ঠা-৩৩)
যেজন্যে বলি, একলা মানুষ, একলা কবি নিজের কাছে একলা হলেও জনসম্পৃক্ততা থেকে দূরে নয় সে। একথা সত্য। তবুও, প্রকৃতিগত ভাবে সব কবির জীবন নিরবের, নিভৃতের। তাঁকে কেউ সঙ্গ দিতে পারে না, ছুঁয়ে যেতে পারে না। অধরাকে পাবার সাধনায় নিয়োজিত থাকে বলেই কি না সে নিজেও অধরা। তাই সে একলা মানুষ, জীবন ওর ‘নীল ধুলোমাখা জীবন’ (পৃষ্ঠা-৩৭), বাঁধা ‘কালো কাপড়ের নলে’ (পৃষ্ঠা-৩৯), যে জীবন ‘ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আসে’ (পৃষ্ঠা-৪২), সেই সাহসী পরিবর্তনের মিছিলে মৃত্যু ভয়ে পালাতে যার ঘেন্না হয়’ (পৃষ্ঠা-৪৫), ‘এই সময়’ যদিও চারিদিকে ‘গাঢ় অন্ধকার’।
এমন তো হবার কথা ছিল না! কবি নির্দ্বিধায় বলে,
প্রিয় বাংলাদেশ, যে মাটির নিচে আমার ‘বাবার মাথার খুলি’ প্রোথিত আছে, সেই মাটির বুক থেকে ‘পেছনে জয়ার বাড়ি’ রেখে ‘কফিনের কেবিনে’ দুই বিরোধী রাজনীতি ঢুকে পড়ে, সেখানে আনন্দের বৈশাখি মিছিলে ‘ছেঁড়া তনুর মুখ’ স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরালে’ জেগে থাকে তাকে ভুলে থাকা যায় না। ফলে রাতের পর ‘রাত বুকের ভিতর’ কষ্ট জেগে থাকে, যে কষ্টে ‘ভালোবাসার স্বপ্ন ছিল’, আর এই একটিমাত্র কারণে কবির অঙ্গিকার ‘তোমার ছিলাম, তোমার আছি’, তা জয়ার কাছে হোক কিংবা নিভৃতের কাছে।
কেননা, কবি প্রতারণা করে না, জানেও না। সে ফিরে আসে বারবার, ‘প্রতীক্ষার জ্যোৎস্নায়’ যেখানে পরবাসে রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই কবির আহ্বান,
পরবাসে কত যুগ
এসো জয়া, দীর্ঘ প্রতীক্ষার জ্যোৎস্নায় আমাদের ক্ষতগুলো দেখি।’ (পৃষ্ঠা-৬১)
কবিতা ও ছবিতার পাতায় পাতায় শব্দের অনুরাগ ছড়িয়ে দিয়ে ‘একলা মানুষ’র কবি মোতালেব শাহ আইয়ুব পাঠকের কাছে ভালোলাগা থেকে এককদমও দূরে নয়। থাকবে না সে। আপনার মনে একাকি পুড়ে পুড়ে তাঁর শব্দচয়ান, অনুভবের প্রিয় বিষয়ের আমাদের আনন্দ দেবে, আমার বিশ্বাস।
কাব্য গ্রন্থটির চমৎকার প্রচ্ছদ মাসুক হেলাল’র, অলংকরণ শ্যামল হুদা’র আর সবমিলিয়ে ঝকঝকে ছাপার প্রকাশনা শিল্পটি ‘জোড়া শালিক, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা প্রতিষ্ঠানের। ৮০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির বিনিময় মূল্য ২৫০ টাকা। না পড়েও শুধুমাত্র হাতে নিলে ভালোলাগার মতো সুন্দর আঙ্গিকের, কবিতায়ও মনোরম ‘একলা মানুষ’ কাব্য গ্রন্থটি পাঠক প্রিয়তা পাবে এমন কথা বলতে আমি কোন দ্বিধা বোধ করছি না।