আন্নের তুলা গাছ সমীরণ দত্ত ||
স্মৃতির ধুলো - ১
ছবিটা পাঁচ ডিসেম্বর শনিবার তোলা, দিদিদের বাড়ির সামনে। আমাকে এগিয়ে দিচ্ছিলো ওরা। আমি গোয়ালিয়া রওনা দিয়েছিলাম।
সকালে তৈরি হয়ে ওদের বাড়ি গিয়ে যখন জানালাম 'বাড়ি' যাবো, ওরা বেশ অবাক হয়েছিলো, 'আজই যাবি!'
বড়দি বললো, আমারও খুব ইচ্ছে হয় বাড়ি যেতে!
ছোড়দি বললো, একদিন আগে জানলে তোর সাথে আমি চলে যেতাম রে!
দু'জনের গলায় স্পষ্ট আর্দ্রতা। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, দিদি আয় ছবি তুলি,জেঠিমাদের দেখাবো।
কান্না
তো আমারও পাচ্ছিলো! তেত্রিশ বছর আগে শেষবার গিয়েছিলাম সেখানে। সব মিলিয়ে
আড়াই তিন ঘন্টার দুরত্ব ঘুঘুশাল থেকে। একই দেশে, এতো কাছাকাছি থেকেও এতগুলো
বছর নিজের ভূমিষ্ঠ হবার বাড়িটিতে, প্রিয়তম গ্রামটিতে যেতে পারিনি, এ নিয়ে
গ্লানির অন্ত ছিলোনা। গোপনে কতোবার কেঁদেছি।আজ কান্না পাচ্ছে আনন্দে! আর
কয়েকঘন্টা পরেই গোয়ালিয়ার মাটিতে পা ফেলবো আমি। এক্কেবারে ছোট্টটি হয়ে
যাবো! জেঠিমা, দাদারা, বন্ধুরা শৈশবের ডাকনাম ধরে ডাকবে আমাকে! চেনা পথগুলো
এতদিনে নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছে। কিন্তু আমার পা ঠিকঠাক সে-সব পথ চিনে
নেবে!
আমার আর তর সইছিলনা। দ্রুত বিদায় নিয়ে নাওড়া রেলগেট থেকে অটোতে
কালিয়াপাড়া। বোগদাদ ধরে কুমিল্লা বিশ্বরোড। সরাসরি সোনাগাজী যাবার বাস
পাবোনা জেনে চট্টগ্রামের বাসে চড়ে মহীপাল নামলাম।
মন মিয়ার আবদার বড়ো বিচিত্র।
'যদি লক্কড়ঝক্কড় মার্কা একটা বাস পাই ভালো লাগবে!'
পেলাম ও। ভাঙাচোরা গাড়িগুলো নাকি নির্দিষ্ট সময়েই চলাচল করে। তা-ই হলো।
বন্ধু বশির
বলেছিলো
ডাকবাংলো নেমে সিএনজি অটোতে ভোরবাজার পৌঁছতে। কুড়ি টাকায় কুড়ি মিনিটের পথ।
আমি নেমে পড়লাম ধলিয়ায়। মন মিয়া চাইছে একটা পায়ে চাপা রিকশা পেতে।
স্ট্যান্ডে নেমে সেই জিনিস চোখে পড়লো না। হতাশ না হয়ে পাকা রাস্তার পাশ ধরে
হাঁটতে শুরু করলাম। বামে কোথাও একটা পথ পাবো, মাঠ চিরে চলে গেছে মহদিয়া
পোল পর্যন্ত। 'রহস্যময়' তুলা গাছটার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে কতোবার আসাযাওয়া
করেছি ওই পথে। বামে মহদিয়া, ডানে সাহেবের বাজার,সোজা চলে গেলেই ভোরবাজার।
ছোটবেলার হিসেব মতো মাইল তিনেক পথ হেঁটে যেতে আমার একটুও কষ্ট হবে না। বরং
ভালোই লাগবে।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো বামে নেমে যাওয়া পথটা খুঁজে পাচ্ছি
না। ভুল করেছি কি-না সেটা বোঝার জন্য পেছনে তাকালাম। তাকিয়েই দেখি একটা
পায়ে চাপা রিকশা এদিকেই আসছে। খুশিতে মনটা ভরে গেলো। চালকের বয়স আমার চেয়ে
বছর দশেক বেশি হবে, চেহারায় বেশ বাবা বাবা একটা ভাব আছে। দারুণ হলো! যদি
রাজি হয় পুরনো দিনের গল্প শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে।
'কাকা যাইবেন্নি?'
'কন্ডে যাইবেন বাবা?'
'ভোর বাজার'
'যামু। কত দিবেন?'
'কাকা আম্নে কন'
'একশ টেঁয়া দিয়েন'
'ঠিকাছে। আঁরে কিন্তু তুলা গাছের লগের রাস্তাদি' নেঅন লাইগবো'
'বাবা আম্নে যেন্নে কইবেন হেন্নে যামু'
'আঁই হিয়ানে এক্কানা দেরি করমু,ছবি উডামু, তুলাগাছ ধরি কান্দুম'
উনি আমার দিকে স্নেহ মেশানো চোখে তাকালেন,
'বাবা আম্নের বাড়ি কন্ডে?'
'কাকা চানপুর, কুমিল্লা চানপুর। আঁই গুয়াইল্লা গেরামের হোলা। হঁচাশি সালে বাড়ি বেচি গেছি আন্ডা।'
'আইচ্ছা আইচ্ছা বুইজ্জি। আন্নে ছিটে উডি বইয়েন।'
সেই
আঁকাবাঁকা পথ। তবে মেঠোপথের বদলে পিচঢালা। রিকশাটাকে,রিকশার চালককে, এই
পথটাকে এতো বেশি আপন মনে হচ্ছিল, কান্না গোপনের কোনো চেষ্টাই করলাম না।
একসময় রিকশাটা থামিয়ে ড্রাইভার কাকা বললেন,
'বাবা আন্নের তুলা গাছ।'
জিলিানী আলম ||
সময়
এবং দূরত্ব কবি লেখক শিল্পীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি পিয়াস মজিদ
তাঁর কর্ম জীবনের কারণে ঢাকায় অবস্থান করেন। প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন
স্থানে এবং বিদেশে অবিরাম সফর করছেন। সময় এবং দূরত্বের কথা বলছিলাম, কবি
এক সময় কুমিল্লায় ছিলেন। ত্রিশ বছর ছিলেন। এই কুমিল্লা তিনি ছেড়ে গেছেন
বলেই ছেড়ে যেতে পারেন নি। অন্যরুপে অন্য অনুভবে বারবার তিনি কুমিল্লায়
অবস্থান করেন। কুমিল্লায় রয়েছে তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাই এক সময়
অভিজ্ঞান হয়। পিয়াস মজিদের হয়েছে কবিতা। কাব্যজলে তিনি সাঁতার পারঙ্গম।
তাই কুমিল্লাবাসী তাদের পরিচিত শহরকে একজন কবির অভিজ্ঞানের ভেতরে নতুন করে
বুঝে নেবার সুযোগ পান। আমি (জিলানী আলম) শুধুমাত্র এর বাহির রাঙিয়েছি।
অন্তর রাঙিয়েছেন কবি পিয়াস মজিদ। আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আনন্দিত।
পিয়াস মজিদের পরিচয় ম-লে অনেক শিল্পী ছিলেন,কোন একজনকে বললেই রাঙিয়ে দিতেন।
কারণ কবি অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ এবং গদ্যগ্রন্থের স্রষ্ঠা। ইতোমধ্যে তাঁর
পরিচয়ের ব্যপ্তি বেড়েছে। কিন্তু কবি পিয়াস মজিদ কুমিল্লা শহর ভুলতে পারছেন
না বলেই বোধ হয় আমাকেও তুলি ধরতে হয়েছে।
এর ছবি তোলার কাজটি দক্ষ হাতে করেছেন ডাক্তার কায়সার হেলাল।
গোমতী
নদী, দাদার দোকান, ভিক্টোরিয়া কলেজ নানুয়া দিঘি, রাণীর দিঘি, জিলা স্কুল,
ডেলনি হাউস, রাজগঞ্জ বাজার, ঈশ্বর পাঠশালা Ñ এমন পনেরোটি কবিতা রয়েছে
পনেরোটি চার রঙা চিত্রসহ। হয়তো অদূর ভাবিকালে, কালের লোকদের অবাক হতে
হবে, যখন নুতুন কোন প্রয়োজনে এসব বদলে যাবে কিন্তু এ কাব্যগ্রন্থ থেকে
যাবে।
আমরা পিয়াস মজিদের কিছু কাব্যোদ্ধৃতি দেখি: তিনি তাঁর গোমতী কবিতায় বলেন,
‘শুধু এই জলজনমে
তোমাকে অতিক্রম করার মতো
ডাঙার জন্ম যেন না হয়।’
‘
জিলা স্কুল’ কবিতায় তিনি আমৃত্যু বালক বাউল থাকতে চান। ‘ ডেলনি হাউস’
কবিতায় তিনি ব্যক্তিগত বন্দিত্বের প্রশ্ন তুলেছেন মীরা মল্লিকা পল ডেলনির
নিকট। একই সঙ্গে জানতে চেয়েছেন,
‘আমাদের কয়েকশ বছরের বুকের ভেতর
কতটা গার্বেজ কয়টা পুর্ণিমা।’
‘রাজগঞ্জ
বাজার’ কবিতায় বিশ্ব বাজার , ছোট মাছ, লেবু পাতা ইত্যাদি এমন নরম সরল
সহজভাবে বলেছেন, বাজার নিয়ে এমন কবিতার পাঠ পূর্বে আমার শিকে ছিঁড়েনি। কবি
বলেন,
‘বাজার শাসিত দুনিয়ায়
আমার বাজারের ধারণা
ছোট মাছ লেবু আর ধনে পাতা
এই কিছু কেনাকাটা টুকটাক’
একটু
বাড়তি কথা বলতে হয়, সভ্যতা আজ বেপরোয়া Ñ বাজার আধিপত্যের সিনাসিনি। বাজার
যেন বলছে, সবার উপর বাজার সত্য তাহার উপর নেই। কিন্তু আমাদের প্রিয় কবি
পিয়াস মজিদ যেন বলেন, রাজগঞ্জ বাজারের ধনে পাতা লেবু ছোট মাছ, শুধু জিবে
লেগে থাকবে না। মগজেও লেগে থাকবে কাব্যাকারে।
বাজার আধিপত্য ধনে পাতা পর্যন্ত না পৌঁছলে হয়।
‘ঈশ্বর পাঠশালা মাঠ’ কবিতায় কেউ নিশ্চয় বলেছেন,
‘পিয়াস সবুজ ঘাসের মতো উঁচু হউ
আজদাহ দালানের মতো নীচু আর ধূসর দাস হয়ো না’
‘নানুয়া দিঘি’ কবিতায় কবি Ñ সাদিক ও জেবার বাসায় ‘গৃহী আর অতিথি শব্দের বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন। তিনি তাঁদের আত্মার মানুষ।
২.
বইটির সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছেন, নামলিপিতে হিমেল হক। চুলাস গ্রামে কবি বসে আছেন, ভেতরের ফ্যাপে, ছবিÑতাইফুল নিষাদ।
বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে, সময়ের তিন তুমুল আড্ডাবাজ জসিম উদ্দিন
অসীম, মামুন সিদ্দিকি এবং কাজী মোহাম্মদ আলমগীর, তিন বন্ধুকে। বইটির
প্রকাশক, সত্তর বছরের অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ, স্টুডেন্ট ওয়েজ, প্রকাশক মোহাম্মদ
লিয়াকতউল্লাহ। বইটি সঙ্গে রইলে মনে হয় ছোটখাটো একটা কুমিল্লা শহর সঙ্গে
আছে। চার রঙা, অফসেট গ্লসি পেপারে ছাপনো, ছবি ও কবিতা হাত ধরাধরি করে চলা এ
বইটির মূল্য দুইশত টাকা। কুমিল্লায় সম্ভাব্য প্রপ্তিস্থানঃ নির্বাচিত।
আমি কবির সাফল্য ও বইটির প্রসার কামনা করছি।
লেখক: শিক্ষক, চারুকলা।
করোনা ভাইরাস আজফার আজিজ ||
কাল রাতে পূর্ণিমা গেছে,
হলদে লাল রাকার আর্তনাদে
মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে অগণিত লাশ।
ওদের প্রশ্ন ছিল, কেন?
কি কারণে গোগ-মাগোগ তাদের হত্যা করেছে
করোনা ভাইরাসে?
মাংস পঁচা ঘ্রাণে বাতাস সন্ত্রস্ত হয়ে
কুয়াশাকে বলেছিল, 'কাঁদো। শিশির হয়ে কাঁদো।
কাঁদো সব মৃতবৎসা নারীদের শোকে
যারা করোনার কাছে ভ্রুণ হারিয়েছে।'
ডাস্টবিনগুলো থেকে গলিত ভ্রুণের দলও এসেছিল
মায়ের দুধের বদলে
শিশির আর জোৎস্নায় জীবনের পিপাসা মেটাতে।
তরুণরাও ছিল সেই দলে,
পূর্ণচন্দ্রে ওরা ভালোবাসার মুখ দেখছিল
অনিমেষ চোখে ।
মাঝরাতে হা হা করে হেসেছিল শকুন-শকুনী।
বুড়ো লোকগুলো ভয়ে কাঁপছিল,
আক্ষেপ করছিল অসমাপ্ত কাজের কথা ভেবে।
কাল রাতে
আকাশে উঠেছিল
কি সুন্দর করোনা ভাইরাস।
কমলাঙ্ক(কবি ইসহাক সিদ্দিকীকে)
আজফার আজিজ ||
ধন্যবাদ, মৃত্যু, আবার আমাকে
ফিরিয়ে এনেছ বলে কমলাঙ্কে।
নিরুত্তর কিছু প্রশ্ন, কিছু অসম্পাদিত কাজ
এখনো আমার বাকি আছে
এই কমলের কোলে।
ধন্যবাদ, জীবন, এত দীর্ঘ কাল আমায়
আত্মভোলা রেখেছিলে, তাই।
দেশ-বিদেশে বেরিয়েছি খুঁজে
যা মা রেখেছে গোপনে, যতনে
সনাতন সিন্দুকে তুলে।
তালা সহজিয়া, চাবি প্রেম,
তদুপরি, সংসার তাকে সর্বদা আবৃত রাখে।
তা -ই দিতে আবারও একবার
কমলা কি ডেকেছে আমাকে?
আজও মানুষ হইনিআজফার আজিজ ||
(রুবেল কুদ্দুসকে)
আমাকে হত্যা করো,
আমায় কুরবানি দাও,
আমি আজও মানুষ হইনি।
আমাকে হত্যা করো,
আমায় পঙ্গু করে দাও,
যদি তুমি শান্তি আর ভালবাসা চাও।
লক্ষ জরায়ু ঘুরে আমি আজ
তোমাদের মাঝে।
আমাকে অন্ধ করো, বন্ধ করো,
বোবা করে দাও,
যা কিছু লিখেছি, তাও
টুকরো টুকরো করে
ভাসিয়ে দাও ধর্মসাগরে
কারণ, এখনো আমি মানুষ হইনি।
নেশাআজফার আজিজ ||
ফেটে যাচ্ছে রঙ,
গলে যাচ্ছে,
ঝরে পড়ছে টুপটাপ।
উদ্গ্রীব আমি বিপুল তৃষ্ণায়
পান করে চলি বিন্দু বিন্দু রাগ।
নদীর মতো আনন্দে বরণ করি
সূর্যাস্তের লাল আর ভোরের হলুদ।
কি পিপাসার্ত মন, এই প্রান্তিক জীবন,
নেশা মেটে না কখনো।
শুধু কান্তি আর তোমার ভালোবাসা নিয়ে
মধ্যরাতে বাড়ি ফিরি।
স্বাক্ষী চাঁদ, শীতের কুয়াশা,
আমি তোমার রঙে রঞ্জিত আপাদমস্তক।