ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মানুষের কল্যাণে শুভ শক্তির রাজনীতি
Published : Monday, 4 January, 2021 at 12:00 AM
মানুষের কল্যাণে শুভ শক্তির রাজনীতিড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ||
পুরনোকে ইতিহাসের জাদুর আয়নায় আটকে আমরা নতুনকে স্বাগত জানাই। এটিই পৃথিবীর চিরায়ত নিয়ম। নতুন শব্দটির মধ্যে এমন এক অভূতপূর্ব শক্তি আছে, যা অন্য কিছুতে নেই। নতুনের আগমন আমাদের জীবনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেয়। এই নতুন দিনের প্রতিধ্বনি ও পদচারণকে প্রথাগতভাবে না দেখে একটু ভিন্নভাবে দেখতে কার না মন চায়। ব্যতিক্রমের ধারণা তো দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা থেকে আসে। সেটি যা-ই হোক না কেন। যেমন হোক না কেন। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দুই ধরনের হতে পারে। মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আর ফলিত দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকটা মৌলিক ও ফলিত গবেষণার মতো। নতুন বছরে সম্ভাবনাময় চোখ দেখছে অনেক নতুন নতুন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন জীবনের নান্দনিকতায় একটা পরশ বুলিয়ে যায়। এই নতুন বছরের সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মৌলিক ও ফলিত দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। একসময় মনে করা হতো, বিদেশ থেকে সাহায্য না পেলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেই ধারণা যে যৌক্তিক নয়, তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু গড়ার আগেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায় বিদেশি দাতাগোষ্ঠী পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না বলে ঘোষণা করল। সবাই ভাবল, আশা-জাগানিয়া স্বপ্নটি গতিপথ হারিয়ে পথভ্রষ্ট হলো। জীবনের সঙ্গে জীবনের মহামিলনের যাত্রাটা হয়তো থমকে দাঁড়াল নিঃশব্দে। না, যেমনটি সবাই ভেবেছিল, তা ঘটেনি। বরং মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সেই ধারণাকে বদলে দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমাদের নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করা হবে। সবাই বিস্মিত। এটিও কি সম্ভব? অনেকে ভাবল, এটি নিছক রাজনীতির একটি কৌশল। এই ঘোষণাকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হলো। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে নেতিবাচকতাকেই যেন সবাই প্রাধান্য দিতে শুরু করল। তবে সব অনিশ্চয়তা ও ষড়যন্ত্রকে পিছে ফেলে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু গড়ার কাজে হাত দিলেন। একটির পর একটি স্বপ্ন মানুষের চোখে-মুখে আশা-জাগানিয়া শক্তি নিয়ে বাস্তবে পরিণত হলো। স্বপ্ন হলো সত্যি। দৃশ্যমান পদ্মা সেতু এখন দুই তীরের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে মহামিলনের ডাক দিয়েছে। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল কিভাবে আমাদের প্রাণের মাতৃভূমি বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এটিই প্রধানমন্ত্রীর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির অভূতপূর্ব শক্তি, যা এমনটি আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। এখানে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন যেমন সম্ভব হয়েছে, তেমনি বাঙালির আত্মবিশ্বাস আর মনোবলেরও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এই ধারণা অর্থনীতির ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষের জীবনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবান্বিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনে নতুন উপাদান চিহ্নিত করেছেন, যা আগে সেভাবে ভাবা হয়নি। এই ধারণাটি যে কিছু মৌলিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ঘটছে, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টির পারস্পরিক সমন্বয় ঘটেছে এই বহুমাত্রিক চিন্তাধারায়। এ ক্ষেত্রে তিনি খাদ্য, পানি ও অভিবাসন এই তিনটি উপাদান জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যের মান এই দুটি মৌলিক উপাদান বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়। এর ফলে নিরাপদ ও সুপেয় পানির অভাব দেখা দেয়, যা মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আবার জলবায়ু পরিবর্তনে আন্তর্জাতিকভাবে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে। এটির সরাসরি প্রভাব রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর, যা নিরাপত্তায় নতুন উদ্বেগ। এসব প্রভাবের কারণে সম্পদের ওপর চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনসহিষ্ণু শস্যব্যবস্থা, পানির যথাযথ ব্যবহার ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনায় একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠনের ধারণা প্রধানমন্ত্রীর সৃজনশীল চিন্তাধারারই প্রতিফলন।
প্রধানমন্ত্রীর বহুমাত্রিক চিন্তাধারার ইতিবাচক শক্তির প্রভাবে মানুষ অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা রাখবে। অর্থনীতির সঙ্গে শিক্ষার যোগসূত্র ঘটাতে সক্ষম হবে। মানবিক মূল্যবোধ ও উদার চিন্তাধারায় মানুষ নিজেকে গড়ে তুলবে। সব ধরনের নেতিবাচকতাকে পেছনে ফেলে মানুষ আলোর পথযাত্রী হবে। স্বার্থপরতা ত্যাগ করে আরো মানবিক হয়ে উঠবে। জঙ্গিবাদ, মাদক ও সন্ত্রাসের মতো নেতিবাচক ধারণাগুলো সমাজ থেকে অপসারিত হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সোনার মানুষ তৈরি হবে। মুক্তবুদ্ধি ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মানুষ তার চিন্তার শক্তিকে সর্বজনীন সত্তায় পরিণত করবে। মানুষ বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করবে। মানুষ সততা ও নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সব অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দেবে মানুষ।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সব মানুষ পারস্পরিক আত্মার আত্মীয় হয়ে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ভাগ করে নেবে। সব ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা, ধর্মান্ধতা সমাজ থেকে অপসারিত হবে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত হবে। নতুন নতুন শিল্প-ভাবনার মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। বেকারত্ব দূর হবে। যোগাযোগব্যবস্থার দৃশ্যমান উন্নয়নগুলো এ বছরে আরো গতি লাভ করুক। সমুদ্র জলসীমার সমুদ্রসম্পদের ব্যবহার ও ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে তরুণরা তাদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করুক। অর্থনীতি উন্নয়নের সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন যোগসূত্র তৈরি করে মানবিক অর্থনীতির ধারণায় দেশকে এগিয়ে নিক। তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ে তাঁর আদর্শ ও দর্শনকে জীবনে ধারণ করে এগিয়ে যাক। স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস পড়ে তরুণরা নিজেদের সত্যের শিকড়কে খুঁজে বের করে আনুক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ বছরেই আমরা উড়োজাহাজ ও যুদ্ধজাহাজ তৈরির সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস। জিডিপির সূচক আরো বাড়ুক এ বছরেই। করোনার এই মহাদুর্যোগেও আমরা প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছি, যা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশও পারেনি। আমরা করোনার সঙ্গে লড়াই করে জীবনকে এগিয়ে নিচ্ছি। এই ধারা অব্যাহত থাকুক এই নতুন বছরে। তবে মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব নিয়ম মেনে চলুক, নিজেকে এই ক্রান্তিকালে সুরক্ষিত রাখুক। মানুষ সব অন্ধকার, কুসংস্কার ও প্রথাগত নেতিবাচক ধারণাকে ত্যাগ করে উন্নত মানবিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা প্রভাবিত হোক।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারেনি-এ বিশ্বাস আমার ছিল।’
রাজনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মহৎ অর্জনের জন্য মহাত্যাগ চাই। সুতরাং ভোগ নয়, ত্যাগের মনোভাব নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশে রাজনীতি দুই ধরনের-একটি ভোগের রাজনীতি আর অন্যটি হলো ত্যাগের রাজনীতি। ভোগের রাজনীতির উদ্দেশ্যই হচ্ছে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া, পদ-পদবি নেওয়া, সামাজিক স্ট্যাটাস নেওয়া। এটি হলো এক ধরনের রাজনীতি।
কিন্তু যে রাজনীতি আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, শিখে এসেছি, যে আদর্শ ধারণ করেছি, সেটি হলো ত্যাগের রাজনীতি। এর অর্থ হলো মানুষের জন্য কাজ করা। নিজের ভোগের জন্য সেই রাজনীতি নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিতে নতুন বছরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মানুষ অর্থতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারণা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে আত্মত্যাগের রাজনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে। রাজনীতি পেশিশক্তির বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের কল্যাণের রাজনীতিতে পরিণত হবে। রাজনীতির শুভ শক্তির দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়ে নিজেদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। শুধু চাকরির ওপর নির্ভর না করে মানুষ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর