ড. মো. সহিদুজ্জামান ||
বছরজুড়ে কমবেশি জ্বরে ভুগতে হয় আমাদের। কখনো কখনো পুরো পরিবারকে জ্বরে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। জ্বর হলে প্রথম সপ্তাহ বিছানায়, পরের সপ্তাহ কাশ ও দুর্বলতায় কেটে যাচ্ছে আক্রান্তদের। তবে এই জ্বর শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী মা, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, লিভারের অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিসহ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দিন দিন এসব জ্বরের তীব্রতা বেশি বা আক্রমণাত্মক বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পুরনো সেই ভাইরাসগুলো নতুনরূপে আক্রমণ করছে, বেড়ে গেছে ভোগান্তি, বাসা বেঁধেছে আতঙ্ক। করোনায় এই আতঙ্ক যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ কিছু ভাইরাস জ্বর। নিপাহ ভাইরাসের আতঙ্কও কম নয়, বিশেষ করে শীতকালে। ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবে জ্বর-সর্দি-কাশি হচ্ছে ঘরে ঘরে। করোনাভাইরাসে আতঙ্কের কারণে অনেকেই সাধারণ ঠা-াজ্বর হলেও ভয় পাচ্ছে। ফলে সাধারণত কেউ হাঁচি বা কাশি দিলেই তার দিকে আড়চোখে দেখছে সবাই। ফলে সাধারণ ফুকে করোনা ভেবেও কেউ কেউ হয়ে যাচ্ছে প্যানিক। ভাইরাস জ্বরের আতঙ্কে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আক্রান্ত পরিবারগুলো। এ ছাড়া এসব জ্বরে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার মানুষ ও পরিবেশের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আমাদের দেশে সচরাচর মানুষের যে মৌসুমি জ্বর হয়, তা সাধারণত ইনফুয়েঞ্জা টাইপ ‘এ’ বা টাইপ ‘বি’ ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। টাইপ ‘বি’ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হলেও টাইপ ‘এ’ পশু-পাখি থেকে আসতে পারে এবং দ্রুত ছড়ায়। সম্প্রতি টাইপ ‘বি’ কুকুর, শূকর ও ঘোড়ায় পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মশাবাহিত রোগ, যেমনÍডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইবোলা ও নিপাহ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলেও জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। গবেষকদের মতে, প্রতিনিয়ত জিনগত পরিবর্তন ও নতুন নতুন পোষকে বা প্রাণীতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এসব ভাইরাসের।
আমাদের দেশে এসব ভাইরাসজনিত রোগ বিস্তারের সম্ভাব্য কারণগুলো হিসেবে অধিক জনসংখ্যা, ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও অব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার ও পয়োনিষ্কাশনের অভাব উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বিশ্বায়নের ফলে মানুষ ও দ্রব্যাদির দ্রুত স্থানান্তর, অনিয়ন্ত্রিত সীমান্ত, জলবায়ুর পবিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে মশা ও ভাইরাসের প্রজনন বেড়ে যাওয়া এবং কৃষিকাজে পোকা-মাকড় দমনে অপরিমিত কীটনাশকের ব্যবহারে মশার প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে গিয়ে এসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও বন্য প্রাণীর অযাচিত নিয়ন্ত্রণ, তাদের প্রকৃতি ও পরিবেশে হস্তক্ষেপ, অবৈজ্ঞানিক গৃহপালন ও ভক্ষণ মানব সম্প্রদায়কে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ করোনাভাইরাসসহ সার্স, মার্স, বার্ড ফু, সোয়াইন ফু ইত্যাদি।
বলা যায়, আমাদের দেশে বর্তমানে ভাইরাস জ্বর একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মৌসুমি জ্বরকে শুধু সাধারণ জ্বর বা ফু হিসেবে বিবেচনা না করে প্রকৃত জীবাণুর অনুসন্ধান প্রয়োজন। প্রয়োজন জ্বরের প্রকৃত উৎস খুঁজে বের করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ও পশু-পাখির স্বাস্থ্যকে আর আলাদা করে না দেখে ‘এক স্বাস্থ্য বা ওয়ান হেলথ’ হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে। স্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যথায় নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। পশু ও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধিত হবে।
যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর বা নিয়ন্ত্রণের পূর্বশর্ত হলোÍসঠিক সময়ে রিপোর্টং করা, গুরুত্বসহকারে বিষয়টি আমলে নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করা, তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সেই অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
আমাদের দেশে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত রোগীর দেহে যে ভাইরাস রয়েছে, তাদের জিনগত বৈচিত্র্য নিরূপণ করা প্রয়োজন। রি-অ্যাসোর্টেড বা সংকর ভাইরাস আছে কি না, থাকলে তা কোন প্রজাতির তার শনাক্তকরণ প্রয়োজন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে, সেটিও আমাদের আমলে নেওয়া উচিত। শুধু করোনা নয়, যেকোনো ভাইরাস জ্বর মোকাবেলায় বিশেষ সার্ভেইল্যান্স টিম গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিশেষ গবেষণা। করোনার টিকা পেলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা ও ধারাবাহিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সম্প্রতি গবেষকরা পরিষ্কার উপলব্ধি করেছেন যে ভাইরাস জ্বরের জীবাণু শুধু মানুষ নয়, গৃহপালিত ও বন্য পশু-পাখি এগুলোর ধারক ও বাহক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। তাই ‘এক স্বাস্থ্য পরিকল্পনা’ (ওয়ান হেলথ স্ট্র্যাটেজি) গ্রহণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে ইনফুয়েঞ্জা ভাইরাস নিয়ে বা ভাইরাস জ্বরের জীবাণু নিয়ে শুধু মানুষের ডাক্তারই নন, টিকা উৎপাদনকারী গবেষক, ভেটেরিনারিয়ান, বায়োটেকনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই যৌথ গবেষণা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে মানুষ ও পশু-পাখির স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের যেসব রোগবালাই হয় তার প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে পশু-পাখি থেকে। তাই ওয়ান হেলথ ইস্যুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এই খাতে আলাদা অর্থ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
বিপন্ন, বিরল ও সুরক্ষিত প্রজাতি শিকার ও বিক্রয় নিষিদ্ধের পাশাপাশি বন্য প্রাণীর পরিবেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ব্যবহার, গৃহপালন ও ভক্ষণ বন্ধ করতে হবে। বিদেশিদের খাদ্যাভ্যাস পূরণে হোটেল বা রেস্টুরেন্টে এসব প্রাণী যাতে সরবরাহ না হয় সেদিকে খেয়াল বা সতর্ক থাকতে হবে।
উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে দেশের সরকারি ও বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমকে অ্যাক্রেডিটেশন প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তবে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে আলাদা কাউন্সিল গঠন করে দেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে অন্যান্য দেশের মতো অ্যাক্রেডিটেশনের (স্বীকৃত) আওতায় আনা দরকার। স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে এর কোনো বিকল্প নেই। সরকার এসংক্রান্ত একটি ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন করতে পারে এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা হাসপাতালগুলোকে বাধ্যতামূলক অ্যাক্রেডিটেশনের আওতায় আনতে পারে। অ্যাক্রেডিটেশনের শর্ত মেনে যাতে এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান চলমান থাকে। যত দূর জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাক্রেডিটেশন আইন, ২০১৫’ প্রণীত হওয়ার খবর অনেক আগে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই আইনের আওতায় ‘স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান’ নামে পৃথক একটি কমিশনের মাধ্যমে সারা দেশের হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মনিটর, সুপারভিশন ও মান নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারে এসব ভাইরাস থেকে। মাস্ক ব্যবহার, হ্যান্ডশেক (করমর্দন) না করা, দিনে কয়েকবার হাত-মুখ ধোয়াÍএসব জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নিজের জীবাণু যাতে অন্যরা না পায়, সে জন্য জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাবধান থাকতে হবে, নিজের রোগ গোপন না রেখে তা প্রকাশ করে চিকিৎসাসহ অন্যকে সাবধান করে দিতে হবে। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের নিত্যদিনের কর্মকা- চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ