৯ মাস পর সশরীরে বসলো কুমিল্লা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি
তানভীর দিপু ও মাসুদ আলম ||করোনা
সংক্রমণে থমকে যাওয়া কুমিল্লা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা ৯ মাস পর আবার
সরব হয়ে উঠেছে। এ ক’মাস জুম আপের মাধ্যমে ভার্চুয়াল সভা করার পর গতকাল
রবিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে কমিটির সব সদস্য আবারো সশরীরে বসে সভা
করেছেন। দীর্ঘদিন পর জেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চকিত হন সংসদ সদস্য,
উপজেলা চেয়ারম্যান, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিগণ।
অপরাধ এবং সামাজিক সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনায় মুখর ছিল সভা। জেলা
প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীরের সভাপতিত্বে বেলা ১১টা থেকে ৪ ঘণ্টাব্যাপী এই
সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় কুমিল্লার নবাগত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, নব-নির্বাচিত ব্রাহ্মণপাড়া ও দাউদকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যানদের শুভেচ্ছা জানানো হয় ।
সভা
শেষে কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর জানান, সভার সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী, ইজারাদার ছাড়া গোমতী নদী থেকে আর কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও
মাটি কাটতে পারবে না। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থাকবে।
ওয়াজ মাহফিলের বিষয়ে কড়াকড়ি নির্দেশনা দিয়ে সভায় জানানো হয়, অনুমতি ছাড়া
কোথাও কোনো প্রকার ওয়াজ মাহফিল করা যাবে না। ওয়াজ মাহফিল, মসজিদ মাদ্রাসা
নির্মাণের নামে রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে চাঁদা আদায় করা যাবে না। কুমিল্লা
নগরীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে অবৈধ দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সভাসূত্রে
জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উঠে আসা
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর জানান,
কুমিল্লা নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ কাজে টমছম ব্রিজ থেকে
নোয়াগাঁও চৌমুহনী পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ
করার অভিযোগের ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ওই তদন্ত কমিটির দেয়া
প্রতিবেদনে দেখা যায়, খালটি ভরাট করা হচ্ছে না। রাস্তা নির্মাণে রিটার্নিং
ওয়াল করছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। এছাড়া কুমিল্লা শহরে সিএনজিচালিত
অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও যত্রতত্র পার্কিংয়ে শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে
সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড নির্মাণের বিষয়ে স্থান নির্ধারণে একটি কমিটি করা
হয়েছে। ইতোমধ্যে কুমিল্লা টমছম ব্রিজ থেকে বাখরাবাদ সড়কে ডাক বিভাগের পাশে
সিটি কর্পোরেশনের দেয়া জায়গার ওপর একটি স্ট্যান্ড স্থাপনের পরিকল্পনা
নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে টমছম
ব্রিজের কাঁচাবাজারসহ কুমিল্লা নগরীতে ফুটপাত ও সড়কের ওপর থেকে অবৈধ
স্থাপনা উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কুমিল্লার গোমতী নদীতে
ইতোমধ্যে একাধিক অভিযান চালিয়ে বালুমহালের চিহ্নিত সীমানার বাইরে বালু
উত্তোলনে ব্যবহৃত মেশিন ও সামগ্রী ধ্বংস করা হয়েছে। এদিকে রবিবার ও
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সময় ব্যতীত কুমিল্লা মেডিক্যাল
কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভরা যাতে প্রবেশ
করতে না পারে, সেই বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো.
নিয়াতুজ্জামান সভায় বলেন, নিষেধাজ্ঞা না মানায় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে একাধিক মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভের
জরিমানা করা হয়েছে। রোগী হয়রানি রোধে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি
জানান।
এছাড়াও জেলা টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা বাড়ানো, মসজিদসহ সকল
ধর্মীয় উপাসনালয়ে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করা, বিদ্যুৎ লাইন থেকে হুকিংয়ের
মাধ্যমে সংযোগ প্রদান প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, সরকারি
হাসপাতালে চিকিৎসকদের দুপুর ১টা পর্যন্ত বাধ্যতামূলক অবস্থান করা, অভিযানে
কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের ব্যর্থতার কথা জানান জেলা প্রশাসক।
সভায়
র্যাব কুমিল্লার অধিনায়ক মেজর তালুকদার নাজমুস সাকিব বলেন, ‘কুমিল্লাবাসী
অপরাধের তথ্য দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। আমরা আমাদের নিয়মিত অপরাধদমন
কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলীয়
চিফ হুইপ অধ্যাপক রওশন আরা মান্নান কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক
নির্মূলে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ কামনা করেন।
মেঘনা নদীতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি:
মেঘনা
উপজেলার চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ মিয়া রতন শিকদার সভায় অভিযোগ তুলে জানান,
মেঘনা নদীতে দুর্ধর্ষ নৌডাকাত দলের উৎপাত বেড়েছে। পুলিশের সহযোগিতায়
মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে আসা ডাকাত দলের সদস্যরা নদীতে কাজ করা শ্রমিকদের থেকে
চাঁদা আদায়সহ তাদের টাকা-পয়সা, সাজসরঞ্জাম ও আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
কোনো ট্রলারের শ্রমিকদের কাছে টাকা বা জিনিসপত্র না পেলে তাদের রান্না করা
ভাতে পানি বা বালু দিয়ে নষ্ট কওে তাদের মারধর করে।
এই অভিযোগের বিষয়ে
কুমিল্লার নবাগত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা
আদায়ে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে সাথে সাথে জেলা পুলিশ তার বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেবে। যারাই এই কর্মকা-ের সাথে জড়িত থাকবে, তদন্ত করে তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া নদীতে ডাকাত দলের উৎপাতের বিষয়ে
খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মেঘনা, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেন জেলা প্রশাসক।
মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণে ধীরগতি:
গতকালের
সভায় কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার চেয়ারম্যান গোলাম সরওয়ার, নাঙ্গলকোট
উপজেলার চেয়ারম্যান মো. সামছুদ্দিন কালু ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান
জাকির হোসেন বলেন, কুমিল্লা-নোয়খালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ
কাজের ধীরগতি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ আর এ
ভোগান্তি নিতে পারছেন না। মুমূর্ষু রোগীই শুধু নয়, সাধারণ সুস্থ মানুষের
হাড়গোড়ও ঠিক থাকে না এই সড়কে চলাফেরা করতে গিয়ে। সদর দক্ষিণ উপজেলার
চেয়ারম্যানের অভিযোগ, বিজয়পুরে সড়কের উপর থাকা মসজিদ ভাঙা হয়েছে, কিন্তু এই
ভাঙা ইঁট-পাথরগুলো সরানো হচ্ছে না। এতে প্রতিনিয়ত যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যানের অভিযোগ, চারলেনের উন্নীতকরণের কাজ করতে গিয়ে
সড়কের পাশে লাকসাম থেকে মনোহরগঞ্জ পর্যন্ত খাল ভরাটের কারণে কৃষকরা সেচ
সংকটে পড়েছেন। এই এলাকায় ধান চাষ হচ্ছে শত শত হেক্টর জমিতে। তাই দ্রুত
খালটি পুনর্খননের দাবি জানাচ্ছি।
এই ধরনের অভিযোগের বিষয়ে কুমিল্লা
জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর জানান, জমি অধিগ্রহণ, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ,
বিদ্যুতের খুঁটি সরানোসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চারলেনের কাজ দ্রুত
সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। লাকসাম থেকে মনোহগঞ্জ সড়কের কাজে ভরাট হয়ে পড়া
খালটি সওজের। তারপরও কৃষক ও কৃষি জমির কথা চিন্তা করে সড়কের পাশে আবার খাল
খননের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
অনুমোদনহীন কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন:
গতকালের
আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় দাউদকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান মেজর মোহাম্মদ
আলীসহ উপস্থিত একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান অভিযোগ তুলেন বলেন, করোনার কারণে
স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কওমি মাদ্রাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ বাসা-বাড়িতে হুমড়ি
খেয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থী ভর্তি করার জন্য। এক দাউদকান্দি উপজেলাতেই
নামে-বেনামে ২২২টি কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে জানিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা
প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন জেলা প্রশাসক আবুল ফজল
মীর উপস্থিত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ভ্যাট কর্মকর্তাকে নির্দেশ
দেন, এক মাসের মধ্যে গ্রামগঞ্জসহ প্রান্তিক এলাকা থেকে শহর পর্যন্ত
কুমিল্লা জেলায় কতগুলো কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, তার তালিকা করার জন্য। এছাড়া
ভ্যাট কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে বিনা অনুমতিতে গড়ে ওঠা
ওইসব বাড়ির মালিক ও প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস সম্পর্কে জানার জন্য।
কমিল্লার
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় আরো উপস্থিত
ছিলেন কুমিল্লার সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা,
কুমিল্লা জেলা পিপি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম, কুমিল্লা জেলা মৎস
কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন, কুমিল্লা জেলা আনসার ভিডিপির কর্মকর্তা মো. মোস্তাক
আহমদ, কুমিল্লা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল
লতিফ, কুমিল্লা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এড. আমিনুল ইসলাম টুটুল, লাকসাম
উপজেলার চেয়ারম্যান এড. ইউনুছ ভুঁইয়া, হোমনা উপজেলার চেয়ারম্যান রেহানা
বেগম, বুড়িচং উপজেলার চেয়ারম্যান আখলাছ হায়দার, চান্দিনা উপজেলার তপন বকসী,
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান এম. এ জাহের, বরুড়া উপজেলার চেয়ারম্যান এ
এন এম মইনুল ইসলাম, মেঘনা উপজেলার চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ মিয়া রতন শিকদার,
মুরাদনগর উপজেলার চেয়ারম্যান ড.আহসানুল আলম সরকার কিশোর, কুমিল্লা
কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহম্মেদ, কুমিল্লা হাইওয়ে
পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম, কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির
সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. জহিরুল, কুমিল্লা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক
মো. জসিম উদ্দিন, কুমিল্লা বিভাগীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা নুরুল করীমসহ
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও
জনপ্রতিনিধিবৃন্দ।