বাবার মৃত্যুর পর কেরলের শিক্ষিকা সিরিয়ান খ্রিস্টান মেরি রায় দেখলেন
যে, পৈতৃক সম্পত্তি থেকে তাঁর ভাই তাঁকে আইনি পথেই বঞ্চিত করছে। কেরলে
সিরিয়ান খ্রিস্টানরা ত্রিবাঙ্কুর (১৯১৬) আর কোচিনের উত্তরাধিকার আইন
(১৯২১)-এর আওতায় পড়েন, যেখানে বাবা নির্দিষ্ট ভাবে উইল করে না গেলে সিরিয়ান
খ্রিস্টান মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অংশ পাবেন না। অথচ দেশের অন্যত্র
খ্রিস্টানরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত ভারতীয় উত্তরাধিকার আইন (১৯২৫)-এর আওতায়
পড়েন, যা মেয়েদের প্রতি অনেকটাই সদয়। মেরি আদালতের দ্বারস্থ হলেন— নিম্ন
আদালত থেকে হাই কোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট। ১৯৮৬ সালে মামলা করে শেষ অবধি
২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়। তবুও কি পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার পেলেন
মেরি? এই রায়ের বিরুদ্ধে কেরলের সমস্ত খ্রিস্টান এককাট্টা— মামলা করার
জন্যে মেরি একঘরে। রাজ্য জুড়ে আন্দোলন! সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করার
জন্য এক্সিকিউশন পিটিশন ফাইল করে ২০০৯ সালে সম্পত্তির অংশ পেলেন মেরি।
হিন্দু মেয়েদের ক্ষেত্রে বাবা যদি উইল করে মেয়েকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে
বঞ্চিত করেন, মেয়ের সেই বৈষম্য হজম করা ছাড়া আর কোনও পথ থাকে না। কিন্তু
মুসলমানদের ক্ষেত্রে, ছেলেরা যা পাবে, মেয়েরা তার অর্ধেক পাবেই। শরিয়তে
মেয়েদের প্রতি গভীর বৈষম্য থাকলেও উত্তরাধিকারের অংশ, অর্ধেক হলেও, পাওয়াটা
নিশ্চিত।
আমরা সবাই ভারতীয় নাগরিক হলেও, ঘরের বাইরে বেরোলে আমাদের সবার জন্য এক
আইন, আর ঘরের মধ্যে থাকলে ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে আইনগুলো আলাদা। আমি মরে
গেলে আমার নিজস্ব সম্পত্তি কে পাবে, তা নির্ভর করে আমার ধর্ম কী, তার উপরে।
উত্তরাধিকার ছাড়াও পারিবারিক বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে বিয়ে, বিচ্ছেদ,
সন্তানের দত্তক, হেফাজত ও অভিভাবকত্ব, খোরপোষ। সেই জন্য ঘরের বাইরের মতোই
ঘরের ভিতরে, পারিবারিক বিষয়গুলোতে ধর্মনিরপেক্ষ সমান আইনের দাবি বহু
দিনের।
দেশের সব পারিবারিক আইনেই মেয়েদের প্রতি বঞ্চনা রয়েছে, কম বা বেশি।
কারণ, সব পারিবারিক আইনই ধর্মগ্রন্থে কী লেখা রয়েছে, তার ভিত্তিতে তৈরি; আর
সব ধর্মই মেয়েদের দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে। তাই সব পারিবারিক আইনেই মেয়েরা
পিছিয়ে, যা আমাদের দেশের সাংবিধানিক সমানাধিকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে খাপ
খায় না।
কিন্তু পারিবারিক আইনে সমতা আসবে কী করে? আমাদের সংবিধান প্রণয়নের সময়
এই প্রসঙ্গটিকে ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপ্লস বা নির্দেশমূলক নীতির অন্তর্গত
করা হল। বলা হল, রাষ্ট্র ‘চেষ্টা করবে’ সব নাগরিকের জন্য সমান পারিবারিক
আইন প্রণয়নের। কিন্তু সেটা এখনও হয়নি। বরং স্বাধীনতার পর থেকেই লোকসভায়
গৃহীত সব কেন্দ্রীয় পারিবারিক আইনেই দেশের কোনও না কোনও জায়গাকে, গোষ্ঠীকে
ছাড় দিয়েছে। যেমন ছিল জম্মু-কাশ্মীর, ছিলেন পুদুচ্চেরির ‘অস্বীকারপন্থী’রা।
এই পারিবারিক আইনগুলো, সে ভাবে আইনে উল্লেখ করা না থাকলেও আবার গোয়া, দমন
আর দিউতে প্রযোজ্য নয়।
গোয়া, দমন, দিউতে পর্তুগিজ শাসকরা তিনটি অঞ্চলের জন্যই পারিবারিক
প্রথাগুলিকে সঙ্কলন করে লিসবন থেকে রাজার সনদ এনে আইনের মর্যাদা দেয়। ১৯১০
সালে পর্তুগালে ধর্মনিরপেক্ষ বিয়ে আর ১৯৪৬ সালে চার্চের বিয়ের বৈধতা মেনে
আইন এল, সেগুলি গোয়া দমন দিউতেও চালু হল, কিন্তু স্থানীয় প্রথার ওই ছাড়টা
রয়েই গেল।
স্বাধীনতার পর যখন এই অঞ্চলগুলো ভারতের সঙ্গে যুক্ত হল, গোয়া-দমন-দিউ
প্রশাসনিক আইন ১৯৬২ পরিষ্কার করে লিখে দিল যে, “আগে থেকে প্রচলিত আইনগুলি
চালু থাকবে, যত ক্ষণ না কোনও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সেগুলিকে সংশোধন বা বর্জন
করছেন।” সুতরাং এই তিন অঞ্চলে প্রচলিত প্রথা, ১৯১০ আর ১৯৪৬ সালের বিবাহ
আইন, পর্তুগিজ সিভিল কোড চালু থাকলে কেন্দ্রীয় পারিবারিক আইনগুলি প্রযুক্ত
হতেই পারে না। ২০১৯ সালে দমন আর দিউকে দাদরা আর নগর হাভেলির সঙ্গে যুক্ত
করে একটিই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের পর সেখানে কোন আইন চলবে, তা এখনও
স্পষ্ট নয়। গোয়ার একক দেওয়ানি বিধি নিয়েও প্রশ্ন আছে।
নাগাল্যান্ড আর মিজোরাম এই সব কেন্দ্রীয় পারিবারিক আইন থেকে ছাড় পায়
সংবিধানের ৩৭১এ আর ৩৭১জি ধারা অনুসরণ করে। লোকসভা প্রণীত পারিবারিক আইনের
মধ্যে হিন্দু বিবাহ আইন ১৯৫৫ থেকে সাম্প্রতিক মুসলিম নারী (বিবাহকালীন
সুরক্ষা) আইন ২০১৯ পর্যন্ত রয়েছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পরে জম্মু ও
কাশ্মীর (পুনর্গঠন) আইন ২০১৯ বলেছে, সব কেন্দ্রীয় পারিবারিক আইন সেখানে
প্রযুক্ত হবে আর স্থানীয় আইন ও প্রথাগুলি বাতিল হবে। তার ফলে পারিবারিক
বিষয়গুলি নিয়ে পনেরোটি স্থানীয় আইন বাতিল হয়েছে।
সংবিধানের ৪৪ ধারা, একক দেওয়ানি বিধি, দেশের ঐক্য, মেয়েদের অধিকার
ইত্যাদির কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা কি সবার আগে কেন্দ্রীয় পারিবারিক
আইনগুলিকে দেশের সর্বত্র কার্যকর করার দাবি তুলবেন? কেন দেশের কিছু অঞ্চলে
মেয়েরা বাতিল-হয়ে-যাওয়া বিদেশি আইন বা প্রাগৈতিহাসিক দেশীয় প্রথার চাপে
ঝুঁকে থাকবেন? সংবিধানের প্রতিশ্রুত আইনের সমতা বা সমান আইনি সুরক্ষার দাবি
তো সকল নাগরিকের সমান ভাবেই রয়েছে। বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা অঞ্চলের মেয়েরা
কেন সেই মৌলিক অধিকার পাবেন না? এমনকি যে নারীবাদীরা আশির দশক পর্যন্ত
সংবিধানে প্রতিশ্রুত একক দেওয়ানি বিধি নিয়ে সরব ছিলেন, তাঁরাও নব্বইয়ের দশক
থেকে পিছু হটে ‘এই দাবি তোলার সময় এটা নয়’ বলেছেন। সারা দেশে প্রচলিত
আইনগুলোই সমান ভাবে প্রয়োগ হোক, এটা তো তার থেকে অনেক সহজ দাবি। এই দাবি
তোলার পথে বাধা কোথায়?