এ কে এম আতিকুর রহমান ।।
চীনের অংশগ্রহণে মিয়ানমারের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে গত মঙ্গলবার। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রসচিব মাসুক বিন মোমেন জানিয়েছেন, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ আগামী এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে বাংলাদেশ সতর্কভাবে আশাবাদী। এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘ প্রদত্ত বিবৃতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি যথার্থই বলেছেন যে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের কুতুপালং না নোয়াখালীর ভাসানচরে থাকল, তা জাতিসংঘের দেখার বিষয় নয়। এটিকে বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ উদ্যোগ হিসেবেও তিনি উল্লেখ করেছেন। সত্যি বলতে কুতুপালং ও ভাসানচর—দুটি স্থানই বাংলাদেশের ভূখ-ে অবস্থিত এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ। বাংলাদেশ যখন তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছে, তখন তাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব অবশ্যই বাংলাদেশের রয়েছে। আর সার্বিক বিবেচনায়, বিশেষ করে পরিবেশগত দিক থেকে কুতুপালংয়ের চেয়ে ভাসানচর ঢের ভালো জায়গা।
জাতিসংঘের সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার েেত্র এ ধরনের কোনো শর্ত কোথাও আছে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গারা যেখানেই থাকুক তাদের সাহায্য দেওয়াটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য এবং দায়িত্বও বটে। তবে তাদের কর্মসম্পাদনের েেত্র কোনো সমস্যা হলে তা নিয়ে প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপরে সঙ্গে আলোচনা করতেই পারে। আর বাংলাদেশ অবশ্যই তার সার্বভৌমত্ব, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জাতিসংঘকে সব সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটার কথা নয়। বাংলাদেশ যেভাবে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের কষ্ট লাঘবে সার্বণিক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, একটি ছোট্ট উন্নয়নশীল দেশের পে তা কম কথা নয়। রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের এই মানবিক ভূমিকাকে শুধু প্রশংসা করেই শেষ করা যায় না।
ওই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় একই প্রসঙ্গে বড় বড় পশ্চিমা দেশ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মনোভাবের পরিপ্রেেিত বলেন, ‘আপনাদের এত শখ তো ওদের (রোহিঙ্গাদের) নিয়ে যান। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ এ বিষয়ে তিনি আরো কিছু কথা বলেছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কার্যকর কৌশল অবলম্বন করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
৩০ ডিসেম্বর ২০২০ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ৪ ডিসেম্বর শুরু হওয়া স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নীতির ভিত্তিতে হয়ে আসছে এবং যথাসম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত। এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের ওই শুভ উদ্যোগকে প্রশংসা করার পরিবর্তে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মনগড়া ভুল তথ্য পরিবেশনের আশ্রয় নিয়েছে। যাই হোক, বাংলাদেশ মিয়ানমারের এই বাস্তুচ্যুত এবং নির্যাতিত নাগরিকদের তাদের দেশে দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃশ্যমান আলোচনা আশা করে।
এ কথা না বললেই নয় যে তাঁরা সঠিক কথাই বলেছেন, কোনো অযৌক্তিক বা অবান্তর কথা উচ্চারণ করেননি। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষও হয়তো একইভাবে ওই কথাগুলোই উচ্চারণ করবেন। এ কথাগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অবমাননা বা অবজ্ঞা নেই। এমনকি তাদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসার এবং সহমর্মিতার কমতিও নেই। সে বিষয়টিই স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের চোখে-মুখে। একটা সুন্দর পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনায় বসবাসের সুযোগ পেয়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করেছে, উচ্ছ্বসিত হয়েছে। এমনকি কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানকারী অনেক রোহিঙ্গাই এখন ভাসানচরে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে।
আজকে যদি কক্সবাজারের ক্যাম্প এলাকায় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, তাহলে কি আমরা তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব? তাদের কি আমরা বাংলাদেশের নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে নেব না? আমরা কি জাতিসংঘ বা কোনো এনজিও কি বলবে না বলবে সে অপোয় বসে থাকব? বাংলাদেশের মানুষের কি এতটুকু বোধশক্তি নেই যে ওই অবস্থায় কী করতে হবে? এই রোহিঙ্গারা যখন মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছিল, তখন কি আমরা মিয়ানমারের সৈন্যদের বন্দুকের মুখে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলাম? বাংলাদেশ তা করেনি, তাদের পরম উষ্ণতায় আশ্রয় দিয়েছে নিজেদের হাজার সমস্যার মধ্যে। তাহলে ওই সব বিবৃতি বা প্রশ্নের অভ্যন্তরে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা স্বার্থ নিহিত রয়েছে?
একটি ইংরেজি দৈনিক গত ৭ ডিসেম্বরের সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ভাসানচর আ হ্যাভেন ফর রোহিঙ্গা’ হেডলাইন দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে প্রথম দফায় (৪ ডিসেম্বর) ভাসানচরে স্থানান্তরিত এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গার মধ্যে কয়েকজনের সাাৎকারের বর্ণনা রয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, ভাসানচরে তাদের যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা তারা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। পৃথিবীর অন্য কোথাও তারা এমনভাবে থাকতে পারত না। তাদের কাছে ভাসানচর স্বর্গ মনে হয়েছে। তারা এখানে খুবই সুখে-শান্তিতে আছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পে থেকে যাওয়া তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও তারা ওখানে নিয়ে আসার কথা ভাবছে। বসবাসের এত সুন্দর পরিবেশ তাদের জীবনকে যে আনন্দে ভরে দিয়েছে, তা তাদের কথাবার্তায় ফুটে উঠেছে। এদিকে গত ২৯ ডিসেম্বর আরো এক হাজার ৮০৪ জন ভাসানচরে পৌঁছেছে এবং কয়েক হাজার এরই মধ্যে ওখানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে।
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ বাংলাদেশ সফরকালে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাাতের সময় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রতি তুরস্কের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, বিশ্বসম্প্রদায়ের এই বোঝা বহনে অংশ নেওয়া উচিত। তিনি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের থাকার সুন্দর ব্যবস্থার প্রশংসা করেন এবং ওখান থেকেই তারা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। শুধু তুরস্ক কেন, ভারতও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করাকে সমর্থন দিয়েছে।
বাংলাদেশ এবং তার জনগণ তাদের নানা অভাব-অভিযোগের মধ্যেও অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় কারো সাহায্যের আশায় অপো করেনি। কারণ আমরা জানি জন্মভূমি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা কত! ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানেই সেই আশ্রয় শিবিরগুলোর অবস্থান ছিল। সেদিন এ নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করেনি। দেশ স্বাধীন হলে আশ্রয় নেওয়া সবাই দেশে ফিরে এসেছিল।
এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু বিষয়ক প্রস্তাবটি ১৩২-৯ ভোটে গৃহীত হয়। যে ৯টি দেশ মিয়ানমারের পে ভোট দেয় তাদের মধ্যে ভেটো মতাপ্রাপ্ত চীন ও রাশিয়া রয়েছে। তবে কোনো পইে ভোট না দেওয়া ২৫টি দেশের মধ্যে ছিল জাপানসহ সার্ক সদস্য ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এসব ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। এটি সত্যিই দুঃখজনক যে সার্কের সদস্য দেশগুলোও আমাদের সমর্থন দিচ্ছে না। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে আমাদের অহংকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে তলানিতেই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু রাশিয়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিপে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটাতে পারলে যে রোহিঙ্গা সমস্যা ঝুলেই থাকবে। শুধু বাংলাদেশকেই নয়, বিশ্ববাসীকেও এর সমাধানের পথ খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিতে হবে। তবে কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। বিষয়টির সমাধান মতাশালী দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্কের নানা সমীকরণে আবদ্ধ হয়ে আছে।
তাই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের কোন স্থানে রাখা হলো তা নিয়ে অযথা বাগিবত-া না করে বরং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করুন। মনে রাখবেন, জীবন বাঁচাতে এসব নিপীড়িত মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের মাতৃভূমিতে ত্বরিত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নিন। এদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের ওপর অযথা খবরদারি না করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজটি করতে সম হলে সেটিই হবে সবচেয়ে উত্তম এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি মমত্ববোধ দেখানোর সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। আর এ েেত্র মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া ছাড়াও তার শক্তিশালী বন্ধুদের সম্মত করানোর কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আর যদি সে কাজটি করতে না পারেন, তাহলে আপনাদের দেশে এদের আশ্রয়ের ব্যবস্থাটাও করতে পারেন। তাতে বাংলাদেশের কাঁধ থেকে অন্তত কিছুটা ভার লাঘব হতে পারে। আপনাদের দেশে তো জায়গার অভাব নেই। সেখানে গিয়ে তারা কাজকর্ম করুক, তাদের সন্তানরা স্কুল-কলেজে যাক, তারা ভালো থাকুক। আমাদের এই ছোট্ট দেশের পে সত্যিই এত মানুষের অনিশ্চিত সময়ের জন্য আশ্রয় দেওয়া খুবই কষ্টকর। আমরা যা করে যাচ্ছি তা মানবতার খাতিরে, মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য।
আমরা সত্যিই চাই না রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করুক। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, বড় দেশগুলো এবং এনজিও তাদের সংযোগ, প্রচেষ্টা এবং প্রভাব ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা যাতে সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে অতি তাড়াতাড়ি তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে, সেই কাজটি করতে পারে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব