ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
৫০বছরেও স্বীকৃতি পাননি দেবিদ্বারের ১০ মুক্তিযোদ্ধা
Published : Saturday, 30 January, 2021 at 12:00 AM
শাহীন আলম, দেবিদ্বার।
আবদুল লতিফ মোল্লা (৮৫)। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একজন কর্মক্ষম মুক্তিযোদ্ধা। তিন বছর আগে প্যারালাইজড হয়ে অচল দু’পা। বর্তমানে তার সময় কাটে ঘরে শুয়ে-বসে। টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সনদ পাননি কেন! এ প্রশ্ন করতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি। তিনি বলেন, সনদ পাবো এ জন্য সংগ্রাম করেনি, এখন দেশ স্বাধীন, আপনারা সবাই ইচ্ছেমত স্বাধীন দেশের আলো-বাতাস নিতে পারছেন, আর আমি আজ ঘরবন্দী। মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না পাওয়া বাঘমারা গ্রামের এ মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন,‘ মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিলে আমাদেরকে মেরে ফেলবে এমন ভয় দেখাইছিলো আমরা ভয়ে সনদ নেয়নি’। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে স্বীকৃতি নিয়ে মরতে চাই।
লতিফ মোল্লার মত মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পাননি বরকামতার অন্তত আরও ৯জন মুক্তিযোদ্ধা। তারা হলেন, মৃত মনিরুল ইসলাম (মাস্টার), আবদুল বারেক, সাইদুর রহমান, মৃত আব্দুর রউফ (রব), মৃত আব্দুর রাজ্জাক, খোরশেদ আলম, মৃত আবদুল হাকিম, আবদুল মজিদ ও রমিজ উদ্দিন। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামের একটি বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় তালিকায় অর্ন্তভুক্ত না হওয়া বরকামতার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে।
বাঘমারার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারেক বলেন, আমরা ২নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। বরকামতা গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম। অথচ এ গ্রামের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ৫০ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি। মানুষের দ্বারে দ্বারে অনেক ঘুরেছি কিন্তু কাজ হয়নি। জীবনের শেষ সময়ে এসে স্বীকৃতি পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়ক মফিজের নেতৃত্বে আমরা চান্দিনা ও ইলিয়াটগঞ্জের দুটি ব্রীজ ধ্বংস করি, এরপর বরকামতা, সাদফপুর ও পান্তি গ্রামের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছি।    
মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন বলেন, ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী গাড়ি বহর যাতে চান্দিনার সাহা পাড়া (পুলঘাটা) ব্রীজ পার হয়ে আসতে না পারে সেজন্য ভারতের মতি নগর ক্যাম্পের ৪ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টন মতিনের পরামর্শে বাঘমারার মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমরা প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক দিয়ে ব্রীজ ধ্বংসে ব্যর্থ হই, পরে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের নায়েক মফিজ ও তাহেরের সহায়তায় ২২ এপ্রিল পুলঘাটা ব্রীজ ধ্বংস করি। পরের দিন ২৩ এপ্রিল আব্দুর রব, মনিরুল ইসলাম, সাইদুর রহমান, নায়েক তাহের, মফিজ, আব্দুর রাজ্জাকসহ আমরা ইলিয়াটগঞ্জ ব্রীজ ধ্বংস করি। এভাবেই আমরা শত্রুর মোকাবেলা করি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে চান বলেও জানালেন ৭৫ বছরের রমিজ উদ্দিন।
মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিনের মত ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে বীরত্বের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ছোটনা গ্রামের আবদুর রউফ (রব)। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তিনিও। স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে ১৩ বছর আগে মারা যান রউফ। তার মেয়ে নিগার সুলতানা বলেন, বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি। বাবাকে বলতাম, তোমার সনদ কোথায়? বাবা বলতেন, সনদের জন্য তো যুদ্ধ করেনি মা, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে, সনদ দিয়ে কি করব ? নিগার ক্ষোভ নিয়ে আরও বলেন, অনেক রাজাকার তালিকায় স্থান পেয়েছে, আমার বাবা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তালিকায় নেই।
জানা যায়, বরকামতা গ্রামের মুক্তিবাহিনীর হামলার শিকার হয়ে রাতের অন্ধকারে শতাধিক বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেয়াসহ ১১জন কিশোর ও যুবক ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেন পাকবাহিনী। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তালিকায় স্থান না পেয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
এ ব্যাপারে দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাকিব হাসান জানান, আজ ৩০ জানুয়ারি যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠিত হবে। এ সংক্রান্ত তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি বিষয়টি তদারকি করবেন।