রেজাউল করিম শামিম ||
চলমান জীবনের বাকে বাকে থাকে কতনা ঘটনা। এসব ঘটনার কোন কোনটি চলমান পথকে বদলে দেয় কি নিপুন ভাবে। নিজের অজান্তেই যেন। আর তা ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন। তেমনি একজন ভালোলাগা নেতার সান্নিধ্যও জীবনের চলার পথে বাক হয়ে উঠতে পারে। অন্তত আমার েেত্র ঘটেছে তেমনি ঘটনা। তেমনি একজন নেতা ছিলেন,আমাদের কুমিল্লার সর্বজন প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় নেতা অধ্য আবুল কালাম মজুমদার। ওনার অনুপস্থিতি কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনতো বটেই, সামাজিক অঙ্গনের স্বাভাবিক চলমান ধারার েেত্রও অনেকটা ছন্দপতন ঘটেছে। সবকিছু অনুকুল থাকা স্বত্বেও কুমিল্লা যেভাবে এগুনোর কথা,সেভাবে চলতে পারছেনা। অনেকেই সুযোগ্য এবং ভারসাম্যের নেতৃত্বের অভাব বোধ করেন। তা যাই হোক এই নেতার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই রাজনীতিকে সাথী করে আমারও পথ চলার সূচনা। আবার এই নেতার জীবনাবাসের মধ্যদিয়েই সেই পথে বিচ্ছেদ। যেন ছন্দ পতন। নতুন করে আমার যাত্রা শুরু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে। তারপর আরো কতটা সময় তলিয়ে গেছে দিকচক্রবালে।
এমনি আরো শতকথা মনে এসে ভিড় জমায়, সেদিন কুমিল্লার এতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ‘লালমাই কলেজ‘ অঙ্গনে পা রেখে। দেখলাম কলেজটি সুন্দর আর বিরাট সব ইমারত সাদালাল রঙের অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল মাটির উপর। কলেজটির জন্মের পর পরই জীর্ণশীর্ণ টিনের ঘর ছিলো এর অস্থিত্ব। কালাম ভাইয়ের সাথে কত শতবার যে সেখানে গেছি। কলেজের বিশাল মাঠের পূর্বাংশে মাটি কেটে কেটে পশ্চিমাংশ ভরাট করে ভিত উচুঁ করা হয়। তখন থেকে শুরু করে প্রশাসনিক বা বিজ্ঞান ভবন পাকা করা অবধি দীর্ঘ সময় সেখানে আসাযাওয়া,নানা উত্থান-পতন,দেনদরবার,কোন্দল-কোলাহল এখনো কানে বাজে। কালাম ভাই যখন কলেজ ভবন পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলছিলেন,তখন মূল প্রবেশ পথের দু‘পাশে সারিবদ্ধ গাছের চারা রোপন করেছিলেন। সেগুলো এখন বিশাল বৃ হয়ে অপরূপ সন্দৌর্য ফুটিয়ে তুলেছে।আর মাঠের নিচু অংশে গড়ে তোলা হয়েছে ‘শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম‘। সবই বেশ পরিকল্পিত সাঁজানো গোছানো। আর কলেজটির প্রতিষ্ঠিাতা কালাম ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো পূর্ণতা পেয়েছে, তাঁরই অকৃত্রিম বন্ধু, বর্তমানে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল এমপির সার্বিক প্রচেষ্ঠায়। কলেজটির পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে কালাম ভাইয়ের প্রতিচ্ছবির ম্যুরাল সম্বলিত চমৎকার স্মৃতিস্তম্ভ। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী, কুমিল্লার কৃতিসন্তান, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্টজন উত্তম গুহের শৈল্পীক চিন্তা আর সযতœ-হাতের স্পর্শে গড়ে উঠেছে এই স্তম্ভ। আর এর মাধ্যমেই রয়েছে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্য,স্বনামধন্য রাজনীতিবীদ, জাতীয় শিা কমিশনের সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য কালাম মজুমদারে স্মৃতিকে ধরে রাখার আন্তরিক প্রয়াস।
কালাম ভাই কলেজটি কত কষ্ট করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন “৭৩ সাল থেকে তা ঘনিষ্ট ভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এখনো সেই সময়কার কলেজের অনেক শিকের কথা মনে আছে -যারা বেতন পেয়ে, না পেয়ে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মতো করেই আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গেছেন কালাম ভাইয়ের দিকে চেয়ে। তাদের অনেকেই এখন স্ব স্ব েেত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে কানন সাহা আর নুরজাহান আক্কাসের কথা খুব করে মনে পড়ে। তারা শিা বোর্ডসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ছুটাছুটি করতেন। তাছাড়া, আলী হোসেন চৌধুরী, মোমিন, মতিন, ছাত্তার, রৌফ, সালামত, শিখা,আয়েশা এমনি অনেক সম্মানিত অধ্যাপক, যাদের নামে এই মুহূর্তে মনে করতে পারছিনা। এদের বাইরে কর্মী হিসাবে সোলেমান সলু ও আমিনের কথা খুব মনে পড়ে।
সেসময় বিভিন্ন স্থানে কালাম ভাই তাঁর পরিচিতদের কাছ থেকে আর্থীক সহায়তা ছাড়াও প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ করে কলেজটি দাঁড় করিয়েছেন।দূর্ভাগ্যজনক হলো কালামা ভাইকে, বিরোধী দলীয় অবস্থানে থেকে অত্যন্ত প্রতিকুল অবস্থায় এসব কাজ করতে হয়েছে।এটা সম্ভব হয়েছিলো তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, ব্যপক জনপ্রীয়তা আর সততার কারনেই।
প্রয়াত নেতা কালাম ভাইয়ের সাথে আমি ছাড়া আমার ক‘জন বন্ধুও ঘনিষ্ট ছিলাম।এই কলেজ আঙ্গিনায় তাদের সাথে সময় সময় কালাম ভাইয়ের কথাবর্তা, আলাপ হতো খুবই খোলামেলা এবং সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো অধ্যাপক আবদুল ওহাব,জহিরুল হক দুলাল,আলী হোসেন চৌধুরী,আনোয়ারুল হক,শওকত আহসান ফারুক,আলাউদ্দিন তালুকদার,টিটু ভূইয়া,অসকার রোজারিও,সানাই দাসগুপ্ত, কল্যাণ মিত্র রতন প্রমুখ। অবসর সময় যারা বিবাহিত ছিলো তারা তাদের স্ত্রীদেরও নিয়ে আসতো সাথে করে। এখানকার মনোরম পরিবেশতো ছিলো অবসর বিনোদনের জন্য অত্যন্ত আদর্শ। সকলে সেই সুযোগটি কাজে লাগাতো অবসরে। এসব আলাপচারিতায় কালাম ভাইয়ের হৃদয়ে লালিত অনেক সুপ্ত পরিকল্পনা বেড়িয়ে অসতো। তিনি বলতেন,আমিতো বরাবরই বিপরীত স্রোতে নৌকা বেয়ে চলেছি,প্রতিকুলোতা-প্রতিবন্ধকতাকে সযতেœ সরিয়ে আমার চলার পথ করে নিতে হয়।পথ তৈরিতেই আমার কর্মস্পীহা,আমার কাজের গতী স্লথ হয়ে আসে।ফলে সেসব কাজকর্মে মনমতো প্রতিফলন পাওয়া যায়না। কিন্তু দেখে নিও। আমাদের এমনি দূর্দিন চিরদিন থাকবেনা। দল তায় যাবে। তখন সুযোগ আসবে সৃজনশী কাজকর্মগুলো মনের মতো করে করার। দলের তেমনি সূবর্ণ দিন এসছে ঠিকই । কিন্তু ততদিনে তিনি আমাদের ছেড়ে ,সব কিছু ছেড়ে আজ শুধু স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে রয়েছেন।
কলেজকে ঘিরেও কালাম ভাইয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো। তিনি বলতেন,এই পাহাড়ের আড়ালে সবুজে ঘেরা বিস্তৃর্ণ এই এলাকায় কলেজ গড়ে তোলার পেছনে একটি সুদূরপ্রসারি চিন্তা রয়েছে। শহরের কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি এলাকাটি লেখাপড়ার জন্যে উপযুক্ত স্থান।এখানে ‘শানিতনিকেতন‘এর আদলে খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত স্থানে প্রকৃতির সান্নিন্ধ্যে লেখাপড়া আর তার ফাঁকে ফাঁকে সাংস্কৃতিক চর্চা,চিত্তবিনোদন,মেলাসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা এবং তা সমন্বিত ভাবেই লেখাপড়ার একটি অনুকরণীয় স্থান হিসাবে গড়ে তোলা হবে লালমাই কলেজকে। তবে কালাম ভাই তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপ পূর্ণ করে যেতে পারেননি। কলেজে বর্তমান কাঠামোতে তার পরিপূর্ণ ছোঁয়া হয়তো নেই। কিন্তু, কলেজ থেকে একটু দূরেই এই লালমাইতেই পাহাড়ের বাক ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল একটি নান্দনিক স্থান। এখানে না আসলে তা উপলদ্ধিই করাই যেতোনা। প্রায় ত্রিশ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত এই বিনোদন পার্কটির নাম দেয়া হয়েছে ‘লালমাই লেকআইল্যন্ড‘।কুমিল্লার মহানগরীকে ঘিরে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিরাট বিরাট বিনোদন পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। বেশ ব্যয়বহুল সেইসব পার্কের ক‘য়েকটি আগেই ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে । সেসব পার্কে কোথাও কৃত্রিম পাহাড়,লেক,বানানো হয়েছে। লাগানো হয়েছে নানা গাছগাছালী। কিন্তু, লালমাইয়ের পার্কটির বৈশিষ্ট যা দেখলাম -তা মনে রাখার মতো। প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠা পাহাড়ের বাক,কোথাও ১৫/২০মিটার নিচে সমভূমি, অনেকটা প্লাবন ভূমির মতো। আবারো তার পাশেই সুউচ্চ পাহাড়। এসব ঘিরে প্রাকিতিক ভাবেই গড়ে উঠা নানা ধরনের গাছের সবুজ শ্যমলিমা চোখ জুড়িয়ে যায়। শাল-সেগুন-কড়াই,একাশিয়া-বাবলা আর অর্জুন ইত্যাদি নানা প্রজাতির গাছতো আছেই। এর মাঝেই আবার আছে তাল-খেঁজুরের মতো গাছ। আছে বাঁশঝাড়। যেখানে গাছি, খেঁজুর গাছে উঠে রস সংগ্রহের আয়োজন করেন। তাকে ঘিরে মৌমাছির আনাগোনা। পড়ন্ত বেলায় বিভিন্ন পাখির কিচিরমিচির কলতান শুরু হওয়া।
আর পার্কের নানা ধরনের বিনোদনের আধুনিক সব সরঞ্জামতো রয়েছেই। ট্রয় ট্রেন থেকে শুরু করে, ইলেক্ট্রিক নাগরদোলায় চড়ে উপর থেকে নিচের নান্দনিক বাহারি গাছের বাগান, লেকে বৈদ্যুতিক চলমান রাজ হংস সব কিছু ছবির মতোই দৃশ্যমান। পার্কটির অন্যতম সত্বাধিকার হাজী রহিম, নিজে উপস্থিত থেকে সব ঘুরে দেখালেন। জালালেন, পরিকল্পনা অনুযায়ি পার্কটি পূর্ণতা পায়নি।এখনো নির্মাণাধীন। করোনার কারণে তাদের ব্যবস্যার যেমনি তি হয়েছে। তেমনি নির্মাণ কাজেরও। হাজী রহিম কালাম ভাইয়েরই অনুসারীদের একজন। এখন কুমিল্লা সদর দণি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। তিনি আশাবাদি যে, অল্প সময়ের মধ্যেই পার্কটি সম্পূর্ণ হলে,দর্শনার্থীরা ঘুরতে এসে হতাশ হবেন না।
ফেরার পথে ভাবছিলাম,কলেজকে ঘিরে কলেজ আঙ্গিনায় যেমনি পরিবেশের কথা কালাম ভাই স্বপ্ন দেখতেন, বিশাল কলেজ তার অদূরেই ঐতিহ্যবাহী লাল মাটির পাহাড় আর সবুজে ঘেরা,কোলাহল মুক্ত পরিবেশের নান্দনিক স্থাপনাটি তার কিছুটা হলেও আজ বাস্তব। সব মিলিয়েই নেতাকে স্মরণে রাখার মতো করে তাঁর অনুসারী,বন্ধু,সুভানুধ্যায়ীরা সচেষ্ঠ রয়েছেন। খুবই ভালো লাগলো।