ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক কেন কিনতে হবে?
Published : Saturday, 13 February, 2021 at 12:00 AM
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক কেন কিনতে হবে?মো. রহমত উল্লাহ্ ।  ।
নতুন বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য কী যে আনন্দের বিষয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়! নতুন বই হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের এই আনন্দ-উল্লাসের ছবি প্রতি বৎসর আমরা দেখতে পাই জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে। এই অফুরন্ত আনন্দের উৎসমূলে রয়েছেন আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিগত ৮ বছর ধরে তিনি বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নতুন পাঠ্যপুস্তক; যা বর্তমান পৃথিবীতে একটি অনন্য উদাহরণ। কোভিড ১৯ এর ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ২০২১ সালেও প্রায় সাড়ে চার কোটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তুলে দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি নতুন পাঠ্যপুস্তক। ধন্যবাদ শিক্ষাবান্ধব আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
প্রতি বৎসর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে যারা বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই হাতে পেয়েছেন তাদের আনন্দ উল্লাসটুকুই আমরা বেশি করে দেখেছি, প্রকাশ করেছি, প্রচার করেছি। কিন্তু এই আনন্দের দিনে যে সকল শিক্ষার্থী নতুন বই হাতে পায়নি তাদের সবার কষ্টটুকুর খোঁজ খবর তেমন নেইনি এবং সেই কষ্ট লাঘবের কার্যকর কোন পদপেও আমরা নেইনি।
অপরদিকে যে সকল শিক কিছু কিছু শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিতে বিলম্ব করেছেন তাদের সুবিধা-অসুবিধা গুলোও আমরা খতিয়ে দেখিনি, আলোচনা করিনি, আমলে নেইনি, সমাধানের চেষ্টা করিনি। প্রায় প্রতি বৎসরই জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এমন কিছু সংবাদ আমরা পড়েছি যে, এই এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এত টাকা করে দিয়ে বই নিতে হয়েছে এবং যারা টাকা দিতে পারেনি তারা বই পায়নি। যারা নতুন বই পায়নি তাদের কষ্টের কথা বলে শেষ করার উপায় নেই! যারা বিনামূল্যের সরকারি বই টাকা দিয়ে নিয়েছে তাদের কষ্টটাও কিন্তু কম নয়!
সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে এর মূল্য বাবদ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টাকা আদায় করবে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেটি হোক সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে এমনটি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়ে থাকলে তা অবশ্যই অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর যদি বকেয়া বেতন-ফি বাবদ কোন টাকা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকে তো সেটি বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়োজন আছে।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত বেসরকারি বা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব একরকম নয়। আবার সকল বেসরকারি বা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানর অবস্থাও একরকম নয়। ভাল প্রতিষ্ঠান নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি তেমন বকেয়া থাকে না। ভর্তি বাতিল হবার ভয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ সেসব স্কুলের বেতন-ফি না চাইতেই দিয়ে দেন। তাই তাদের বেতন-ফি আদায়ের জন্য তেমন কোনো কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন পড়ে না। তাদের শিক্ষার্থীদের কোন বকেয়া বেতন-ফি থাকে না, নতুন বছরের শুরুতে কেউ ভর্তিবিহীন থাকেনা। তাদের শিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য অর্থসংকটও থাকে না। তাদের শিক্ষার্থীরা নতুন বই নিয়ে চুপিচুপি অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। তাই তাদের বই দেওয়ার েেত্র শিকদের কোন ভিন্ন চিন্তা বা অনীহাও থাকে না। শিক্ষা বিভাগের চাহিদা অনুসারে যে কোন সময় তাদের ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী এবং বিলিকৃত বইয়ের হিসাব দিতে কোন অসুবিধাও হয় না।
যে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম ও শিক্ষার্থী সংখ্যা অপোকৃত কম তাদের অভিভাবকগণ নিয়মিত বেতন-ফি পরিশোধ না করার কারণে, নতুন বছরের শুরুতে ভর্তি নিশ্চিত না করার কারণে, নতুন বই নিয়ে চুপিচুপি অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাবার সম্ভাবনা থাকার কারণে; বর্তমান প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তা আদায়ের চেষ্টা করতে হয়। কেননা, এই টাকা দিয়েই দিতে হয় শিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতা, মিটাতে হয় প্রতিষ্ঠান অন্যান্য খরচ।
এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের শিক-কর্মচারীরা সারা বছর অপোয় থাকে বার্ষিক পরীার পরে কিছু বেতন ভাতা পাওয়ার জন্য। তাই তারা বাধ্য হয়েই সাময়িকভাবে কিছু শিক্ষার্থীর প্রমোশন ফল আটকে রেখে, নতুন বই প্রদান বিলম্বিত করে ও অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করে চেষ্টা করে থাকে বিগত বছরের বকেয়া বেতন-ফি আদায়ের জন্য এবং নতুন বছরের ভর্তি নিশ্চিত করে নতুন বই প্রদান করার জন্য। তা না হলে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বিগত বছরের বকেয়া বেতন-ফি আর কখনোই আদায় করা যায় না এবং শিক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের প্রাপ্য বেতন-ভাতাও প্রদান করা সম্ভব হয় না!
অপরদিকে ভর্তি বা পুনঃভর্তি ব্যতীত সকল শিক্ষার্থীকে বই বিতরণ করতে গেলেও বেকায়দায় পড়তে হয় শিকদের। তা করতে গেলে শিক্ষা বিভাগের চাহিদা অনুসারে বিনামূল্যে প্রদত্ত সরকারি পাঠ্যপুস্তকের শ্রেণিভিত্তিক বিলীকৃত সংখ্যা এবং প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত/ বিদ্যমান শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা মিলিয়ে সমান করে সঠিক হিসাব প্রদান করারও কোনো উপায় থাকে না। অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা কোনভাবে নতুন বই পেয়ে গেলে ভর্তি বা পুনঃভর্তি নাহয়েই কাস করতে থাকে মাসের পর মাস!
এমন উদাহরণ থাকে যে, বিগত বছরের জানুয়ারিতে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থী আর কোনোদিন কাস করেনি, বেতন-ফি দেয়নি, সাময়িক পরীা দেয়নি; অথচ ডিসেম্বর মাসে এসে বার্ষিক পরীা দিয়ে ফেল করে বা পরীক্ষা না দিয়ে প্রমোশন নিতে চায়, বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবইও নিতে চায়। শক্তিশালী সুপারিশও থাকে তার প!ে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও নিজেদের চাকরি ধরে রাখার স্বার্থে সবই করতে বাধ্য হন বেসরকারি ও প্রাইভেট স্কুলের শিকগণ! এটি হলো গতানুগতিক চিত্র। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে এই অবস্থা আরো অনেক বেশি ভয়াবহ! তেমনভাবে আলোচিতও হয় না, সহানুভূতির সাথে দেখাও হয় না অসহায় শিকদের এই দুরবস্থার দিকটা!
অনেকেই হয়তো বলবেন, সরকারি বই আটকে রেখে শিক্ষার্থীদের বকেয়া বেতন-ফি আদায়ের কৌশল নিবেন কেন শিকগণ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটি করতে বাধ্য হচ্ছেন বা করার সুযোগ পাচ্ছেন কেন শিকগণ? বিনামূল্যে সরকারি পাঠ্যপুস্তক বিতরণের একটা সুষ্ঠু নীতিমালা যদি জারি করা থাকতো তাহলে কি শিকগণ কোন অজুহাতে পারতেন এই বই আটকে রেখে বা বিলম্বে দিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে? কী কী যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থী কোন শ্রেণির নতুন পাঠ্যপুস্তক জানুয়ারি মাসের ১ তারিখেই হতে পাবে তার কি কোন ব্যাখ্যা কোথাও পরিষ্কারভাবে দেওয়া আছে?
যেসকল শিক্ষার্থী উপরের শ্রেণিতে প্রমোশন পায়নি; কিন্তু পরবর্তীতে যে কোন উপায়ে প্রমোশন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বা নেই তাদেরকে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে কোন শ্রেণির বই প্রদান করা হবে? যে সকল শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানে পুনঃভর্তি নিশ্চিত করেনি এবং যারা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে বা আর লেখাপড়া করার সম্ভাবনা নেই তাদেরকে কিসের ভিত্তিতে, কী ভরসায় ১ তারিখে নতুন বই প্রদান করা হবে?
যারা জানুয়ারি মাস জুড়ে ভর্তি হয় না, কাস করে না, বই নেয় না তাদের বই দেওয়ার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে? নতুন পাঠ্যবই বিতরণের হিসাব কখন, কিভাবে প্রদান করতে হবে? এ সকল প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করে, সাধারণ শিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক দিক বিবেচনা করে, বিনামূল্যে সরকারি পাঠ্যপুস্তক বিতরণের জন্য একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা আবশ্যক।
আমরা যে যাই বলি না কেন, আলোচিত বর্তমান বাস্তবতায় জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে শতভাগ শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের সরকারি পাঠ্যবই উঠছে না এটাই সত্য। মাঠ পর্যায়ের এই সত্য কথাটি আমরা কেউ বলছি না, প্রকাশ করছি না, স্বীকার করছি না! আসলেই জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে (প্রায়) শতভাগ শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের সরকারি পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার মতো অত্যন্ত কঠিন কর্মটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা বাস্তব ভিত্তিক নীতিমালা ব্যতীত অসম্ভব।
প্রতি বৎসর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখেই শতভাগ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হতে না পেলে বা না নিলে অর্থাৎ কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী যৌক্তিক কারণে কয়েকদিন পরে বই হাতে পেলে বা নিলে বিনামূল্যে বই প্রদানের কৃতিত্ব সরকারের থাকবে না এমনটি ভাবা/বলা সঠিক নয়। বরং মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার আলোকে প্রাপ্যতার ভিত্তিতে সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা সম্ভব হলে সরকারের সুনাম আরো বৃদ্ধি পাবে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রকাশিত থাকলে তা অনুসরণ করে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে নতুন বই দেওয়া-নেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে শিক ও শিক্ষার্থী। তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বই উৎসবের দিন প্রায় শতভাগ পাঠ্যপুস্তক বিতরণ।

লেখক : সাহিত্যিক এবং অধ্য কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।