অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে যে কোন টিকারই সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। আমাদের দেশে কভিড’১৯ টিকা দেয়ার পর মাত্র ৪৫৫ জনের মাঝে মৃদু পার্শ্বপতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং মারাত্মক কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নি। গত ২৭জানুয়ারি ২০২১ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টিকাদানের উদ্বোধনী ঘোষণা করেন। ২৮ জানুয়ারি’২১ পাঁচশত লোকের উপর পরীক্ষামূলকভাবে টিকা প্রয়োগ করা হয়। পরীক্ষামূলক প্রয়োগ সন্তুষজনক হওয়ায় ৭ই ফেব্রুয়ারি’২১ সমগ্র দেশজুড়ে টিকাদান কার্যক্রম আরম্ভ হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রে বলা হয়েছে ১৫ই ফেব্রুয়ারি’২১ পর্যন্ত গোটা দেশে ১১ লক্ষ ৩২ হাজার ৭১১ জন টিকা নিয়েছেন। গত ২৭শে জানুয়ারি টিকার ইতিহাসে অগ্রসেনানীর খেতাব অর্জন করেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়ার স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। তারপর থেকে তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছেন। ঐদিন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: নাসিমা সুলতানাও টিকা নেন। টিকা নেয়ার পর তিনি অধিদপ্তরে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁহার কোন সমস্যা হচ্ছে না। পরবর্তীতে ৭ই ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: এবিএম খোরশেদ আলম, বিএমএ সভাপতি ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের অধ্যাপক ডা: ইকবাল আর্সলান, মহাসচিব অধ্যাপক ডা: এম.এ. আজিজসহ আরও অনেকে। টিকা নেয়ার পর তাঁহারা সবাই সুস্থ্য স্বাভাবিক আছেন। সামান্য ব্যথা ছাড়া কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় নি। টিকা নেয়ার পর স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য অধ্যাপক ডা: কনক কান্তি বড়–য়া।
টিকা নেয়ায় এগিয়ে রয়েছেন পুরুষরা। ১৫ই ফেব্রুয়ারি’২১ (সোমবার) টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৮ জন। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৫৫ জন পুরুষ এবং ৪৭ হাজার ২৬ জন নারী। এ পর্যন্ত ঢাকায় টিকা নিয়েছেন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫০২ জন যার মধ্যে পুরুষ ১ লক্ষ ৪৭৬ জন এবং নারী ৪৭ হাজার ২৬ জন। প্রান্তিক এলাকার তুলনায় শহরে টিকা নেয়ার হার বেশি। আর ছোট শহরের তুলনায় বড় শহরগুলোর হারও বেশি। যেখানে ঢাকায় ১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছেন ২৯ হাজার ৫৫ জন সেখানে শরিয়তপুরে নিয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৮৭ জন। এ পর্যন্ত সবচেয়ে কম টিকা দিয়েছে বান্দরবানে। শুরু থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন মাত্র ৩৫৬ জন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত টিকা বাংলাদেশ ব্যবহার করছে। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হচ্ছে প্রথম ডোজ ও দ্বিতীয় ডোজ টিকার সময়ের পার্থক্য ৪ থেকে ১২ সপ্তাহ হতে হবে। দুই ডোজের বিরতি কম হলে টিকার কার্যকারিতা কম দেখা যায়। সময়ের পার্থক্য ১২ সপ্তাহ হলে ভাল ফল পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একমত। টিকা পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন এনেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আগে বলা হয়েছিল টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। কিন্তু এখন তা পরিবর্তন করে আট সপ্তাহ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: এবিএম খোরশেদ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার সময়ে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ইতিমধ্যে যারা টিকা দিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজের জন্য একমাস পরের তারিখ দেয়া হয়েছে। সে তারিখ ও বদলে দেয়া হবে বলে মহাপরিচালক জানিয়েছেন। মহাপরিচালক অধ্যাপক খুরশীদ আলম বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা একটি নতুন টিকা। এবিষয়ে কারো কোন অভিজ্ঞতা নেই। নানা ধরনের পরিবর্তন এতে হবে। তিনি বলেন, যাদের ১ মাস পর টিকা নেয়ার তারিখ দেয়া হয়েছে তাদের সবাইকে পরবর্তী সময় এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো: সায়েদুর রহমান বলেন, সরকার আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় আমি খুশী। দুই ডোজের সময়ের পার্থক্য বেশি হওয়া দরকার। সেটাই বিজ্ঞানসম্মত। তবে দুই ডোজের পার্থক্য ১২ সপ্তাহ হলে আরো ভাল হত।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের টিকা নেয়ার পর বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন গণমাধ্যমকে বলেন, ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে কোভিড’১৯ টিকার দ্বিতীয় চালান আগামী ২২ শে ফেব্রুয়ারি আসবে। সরকার সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে তিন কোটি অক্সফোর্ডের টিকা কিনেছেন। কোভিশিল্ড নামে এ টিকা বাজারজাত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, সেরাম ইন্সটিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকো প্রতি মাসে ৫০ লাখ টিকা সরকারের হাতে পৌছে দেয়ার কথা। প্রথম চালানের ৫০লাখ টিকা গত মাসের নির্ধারিত সময়ে সরকারের হাতে পৌছেছে। কিন্তু এ মাসে চুক্তি অনুযায়ী সব টিকা আসছে না। নাজমুল হাসান বলেন, সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে ২১-২৫শে ফেব্রুয়ারি’২১ মধ্যে ২০ থেকে ৩০ লাখ টিকা আসবে। তবে ২২শে ফেব্রুয়ারি’২১ আসার সম্ভাবনা বেশি। টিকা কেন কম আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা ব্যবহারের গতি একটু কম। যে টিকা আছে এগুলো তারা দিয়ে শেষ করতে পারছে না। এ কারণে টিকা কম আনা হচ্ছে। সরকার চাইলে চুক্তির টিকা সময়মত আনার কোন সমস্যা নেই।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার অংশ হিসেবে টিকা দেয়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের অনেক দিনের। দেশব্যাপী টিকা দেয়ার আগের অভিজ্ঞতা বর্তমানে কাজে লেগেছে। এরপরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরন করে পরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। টিকাদান সঠিকভাবে পরিচালনার স্বার্থে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ডিসেম্বর’২০২০ এ জাতীয় টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ১২৯ পৃষ্ঠার সেই পরিকল্পনায় টিকা সংগ্রহ, কেনা, সংরক্ষণ, প্রয়োগ ও বিতরণের ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এছাড়া টিকা কেন্দ্র স্থাপন, টিকা দেয়া এবং এব্যাপারে সতর্কতাসহ সার্বিক অধ্যায়সমূহে নির্দেশনাপূর্ণ পুস্তিকা ছেপেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এনিয়ে সমগ্র দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সমাপ্ত হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক মুশতাক হুসেন বলেন, “নিবন্ধনের সংখ্যা আরও বাড়াতে সামাজিক শক্তি ও সংগঠনসমূহকে কাজে লাগাতে হবে। যাঁর দরকার, তিনি যেন টিকা পান, সে বিষয়ে আরও মনযোগ দিতে হবে।” সুরক্ষিত থাকতে সবাইকে করোনা ভাইরাসের টিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, “টিকা নিয়ে শারিরীক কোন সমস্যা অনুভব করছি না। আমি টিকা নিয়েছি, আপনারাও নিন।”
কভিড’১৯ টিকার সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, “করোনার টিকার ৭৫ শতাংশ মাত্র ১০টি দেশের হাতে। অথচ ১৩০টি দেশ টিকার একটি ডোজও পায়নি।” তিনি সতর্ক করে বলেছেন, টিকাদানের ক্ষেত্রে অসমতা পুরো বিশ্বকেই ঝুঁকিতে ফেলবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ১৭ই ফেব্রুয়ারি’২১ এর এক বৈঠকে বিশ্ব সংস্থাটির মহাসচিব এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যুক্তরাজ্যের আহ্বানে করোনার টিকা নিয়ে এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বলা হয়, এ মহামারি প্রতিরোধে বিশ্বের একসঙ্গে কাজ করা একটি নৈতিক দায়িত্ব। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে ২৪ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে এ করোনায়।
বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, জরুরী ভিত্তিতে একটি বৈশ্বিক টিকাদান পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার; যাতে বৈজ্ঞানিক দক্ষতা, সক্ষমতা, উৎপাদন ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এক কাতারে নিয়ে আসা যায়। গুতেরেস আরও বলেন, করোনা ভাইরাসকে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে দিলে এটি বারবার রূপ বদলাবে। এভাইরাসের যে সব নতুন ধরন দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আরো বেশি সংক্রামক, আরও প্রাণঘাতী এবং বর্তমান টিকার কার্যকারিতা ও রোগ নির্ণয় ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলতে পারে। ইউনিসেফ প্রধান হেনরিয়েটা ফোর বলেন, এ মহামারি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ আমাদের সবার জন্য টিকা সহজলভ্য করা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্টমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, তাঁর দেশ কোভ্যাক্স কর্মসূচীতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তিনি আরও বলেন, সব দেশকে মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে। এদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, “টিকা জাতীয়তাবাদ প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।” মেক্সিকোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিকার সরবরাহ ও প্রাপ্তি বৈষম্যের বিষয় বলে আখ্যায়িত করে বলেন ধনী দেশগুলোর “টিকা একচেটিয়া করনের” ফলেই তা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় করোনার টিকা দান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী “কোভ্যাক্স” কর্মসূচির আওতায় এ বছর ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। অতিরিক্ত আরও ১০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহেও পরিকল্পনা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তবে সহায়তা দানকারী সংগঠন ও সংস্থাগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে তহবিল ঘাটতির কারণে অনেক মানুষ টিকা না-ও পেতে পারে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল